শনিবার, ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দামের চাপে এক কাতার

দামের চাপে এক কাতার

মাত্র তিন বছরে সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে ৬৬ টাকা। চিকন চালে ২২, মোটা চালে ১১ টাকা ও চিনিতে ২৮ টাকা। বেড়েছে পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পেট্রোলের দামও। মানুষের আয় না বাড়লেও ব্যয়ের তালিকা হচ্ছে দীর্ঘ। ফলে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে পরিবারগুলো। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত- সবাই প্রায় একই কাতারে এসে দাঁড়াচ্ছে।

ফলে মধ্য ও নিম্নবিত্তদের ব্যয় বেড়ে জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। কোথাও নিম্নবিত্তরা হারিয়ে যাচ্ছে বাজার থেকে। গত ২০১৯ সালে বোতলজাত এক কেজি সয়াবিন তেলের দাম ছিল ১০৪ টাকা। সেটি ২০২২ সালে এসে দাঁড়ায় ১৭০ টাকা বা ১৮০ টাকায়। চাল (চিকন) ৫৩ টাকা থেকে এখন ৭৫ টাকা। মোটা চাল ৪৪ টাকা থেকে এখন ৫৫ টাকা। চিনি ৫২ থেকে এখন ৮০ টাকা।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে (ওপেন মার্কেটিং সিস্টেম-ওএমএস) ট্রাকে চাল ও আটা বিক্রি করেন বাবু। তিনি আক্ষেপ করে বললেন, গরিবের আটা ধনীর পাতে। জানালেন, সরকার ন্যায্যমূল্যে চাল, চিনি, আটা, ডাল, তেল বিক্রি করছে। তবে এসব পণ্যের মধ্যে আটা চলে যাচ্ছে ধনীদের খাবারের পাতে। তারা এসে লাইনে দাঁড়িয়ে আটা কিনে নিচ্ছেন।

একজন ক্রেতা সর্বোচ্চ ৩ কেজি আটা কিনতে পারেন প্যাকেটের। তাতে দাম পড়ে ২৩ টাকা করে। খোলা আটাও সমপরিমাণ ১৮ টাকা করে ও সর্বোচ্চ ৫ কেজি চাল কিনতে পড়ে ৩০ টাকা করে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে ধনীরা আটার জন্যে লাইনে দাঁড়ান। এ আটা দোকানে কিনতে হলে ৩৫ টাকা কেজিতে দিতে হয়। সেখানে ২৩ টাকা কেজিতে আটা কিনে নিচ্ছেন। একজনকে দু’বার লাইনে কোনো কিছু দেওয়া যায় না। তবে এটি তো সাধারণ মানুষের জন্য। অথচ অর্থশালীও এসে দাঁড়িয়ে যান। তাদের না করার উপায় থাকে না।

ওএমএসের ট্রাক থেকে তিন বছর ধরে নিত্যপয়োজনীয় খাদ্যপণ্য কিনছেন মাসুদা বেগম নীলা। ৫৫ বছরের এই নারী জানান, তার পরিবারে এক ছেলে এক মেয়েসহ ৪ জনের সংসার। স্বামী এখন অনেকটাই বেকার। অনেক কষ্ট করে সংসার চালাতে হচ্ছে। তীর্থের কাকের মতো চেয়ে থাকেন টিসিবির (ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ) ট্রাকের জন্য। ট্রাক দেখলে আত্মায় পানি আসে। তিনি বলেন, চাল ও আটা কিনেন ওএমএসের গাড়ি থেকে। সপ্তাহে একদিন বা দুইদিন গাড়িটি আসে রাজধানীর সিআর দত্ত রোডে। আর কাঁঠাল বাগানের ঢালে টিসিবির ডাল, তেল, চিনি ও পেঁয়াজ বিক্রির জন্য গাড়িটি আসে। তবে চাল ও আটার গাড়ি প্রতিদিন নয় সপ্তাহে একদিন আসে।

আরও পড়ুনঃ  একদিনে আক্রান্ত ৩৯৪৬, মৃত্যু ৩৯

টিসিবি আর ওএমএসের সুবিধা নিয়েই সংসারের জন্য নিত্যপণ্য কিনে চলে তার সংসার। যে চাল তিনি ট্রাক থেকে কেনেন তা দোকানে কিনতে গেলে ৫০ টাকা বা তার বেশি লাগে। আটা কেনেন ১৮ ও ২৩ টাকায়। সেটি দোকানে ৩৫ টাকা লাগে। তবে নীলার আক্ষেপ তেল চুরি নিয়ে। তিনি জানান, তেল নিয়মিত পাওয়া যায় না। কারণ কী? জানতে চাইলে বলেন, তেল নিয়ে বিক্রি করে দেয়। আবার লাইনে দাঁড়িয়ে তেল কিনে নেয় সেটি বিক্রি করে দেয় দোকানে।

এর সমাধানও দিলেন তিনি। বললেন, তেলের সিপি (বোতলের মুখ) খুলে বিক্রি করতে হবে। তাতে করে এই তেল দোকানে নিয়ে বিক্রি করতে পারবে না আর সত্যিকার অভাবীরাই তেল কিনতে পারবে। বললেন, তেল বিক্রির সময় বোতলের মুখটি খুলে দিলেই এ সমস্যার একমাত্র সমাধান। তা না হলে গরিবের আর তেল খেতে হবে না।

তেলের গাড়ির (টিসিবির) সন্ধানে মুখে চিন্তার ছাপ মিষ্টি বেগমের। তিনি প্রায় ১৫ দিন ধরে তেলের গাড়ি অর্থাৎ টিসিবির গাড়ির খোঁজ পাচ্ছেন না। এই গাড়ি কখন আসে কখন যায় তার হদিস নেই। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক নারীকে জিজ্ঞেস করেন, তেলের গাড়ি কখন আসে? তিনি তো খোঁজ পান না। জানতে চাইলে মিষ্টি বেগম জানান, তিনি নিয়মিতই টিসিবি থেকে তেল, ডাল, চিনির প্যাকেজ কেনেন। তবে ১৫ দিন হলো তেলের গাড়ি নিয়মিত আসে না। কখনো এলেও অল্প সময়েই বিক্রি করে চলে যায়। ফলে তাদের মতো স্বল্প আয়ের মানুষরা হদিস পান না।

মিষ্টির এক ছেলে এক মেয়ে নিয়ে তিনজনের সংসার। স্বামীর খোঁজ নেই কয়েক বছর ধরে। মেয়েটি ক্লাস এইটে পড়ে। ছেলে পড়ে ফাইভে। বাসায় ছুটা বুয়ার কাজ করে ১১ হাজার টাকা আয় করেন। আবার বাসায় সাবলেট দিয়ে কিছু টাকা পান। বাড়িভাড়া দিতে হয় সাড়ে ৬ হাজার টাকা। পরিবারের সবমিলে খরচ প্রায় ১৬ হাজার টাকা। তার মুখে চিন্তার ভাঁজ। তেলের গাড়ির সন্ধান তিনি কি আজো পাবেন প্রশ্ন চোখে-মুখে।
বলেন, সত্যি বলতে অনেক কষ্ট করে আমার সংসার চলছে। ন্যায্যমূল্যের বাজারের কারণেই তার পরিবার টিকে আছে।

আরও পড়ুনঃ  দরপতনে জ্বালানি তেলের সাপ্তাহিক বাজার

তবে তার কথা হলো এখান থেকে ২ কেজি তেল, ২ কেজি মসুর ডাল, ২ কেজি চিনি (সাদা) ও ৫ কেজি পেঁয়াজের একটি প্যাকেজ কিনতে হয়। তাতে ৬৫০ টাকা খরচ হয়। এতো টাকা অনেক সময় থাকে না। ফলে আরেকজনের সঙ্গে ভাগ করে কিনতে হয়। যদি এক কেজি করে তেল, ডাল, চিনি ও ২ কেজি পেঁয়াজ বিক্রি করতো তাতে তাদের মতো নিম্নবিত্তদের বেশি উপকার হতো। প্রয়োজনে দুটি প্যাকেজ রাখা যায় বলে মতো তার।

আব্দুল মজিদ চাকরি করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। তার মাসিক বেতন ১৫ হাজার টাকা। থাকেন আজিমপুরে। তিনি কাঁঠাল বাগানে চাল ও আটা কিনতে এসেছেন। পোশাক-পরিচ্ছদে পরিপাটি। তাকে প্রশ্ন করা হলে জানান, সংসার চালাতে তার খুব হিমশিম খেতে হয়। এই টাকা দিয়ে বাসাভাড়াসহ যাতায়াত ও অন্যান্য সব ব্যয় মেটাতে হয়। সেজন্যই ন্যায্যমূল্যের লাইনে দাঁড়িয়েছেন। চাল-আটায় কিছুটা ব্যয় কমাতে পারবেন এটিই কম কিসে? তিনি জানান, আজকেই প্রথম তিনি লাইনে দাঁড়িয়েছেন।

হোসনে আরার ঠোঁট পান-সুপারির রঙে লাল হলেও সংসার কিন্তু রঙিন নয়। তিনি ৬০০ টাকা নিয়ে কারওয়ান বাজার থেকে বাজার করে এসেছেন। তার সঙ্গে দেখা হয় ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে। তিনি একটি পাঙ্গাস মাছ, আলু, টমেটোসহ বেশকিছু পণ্য কিনে এনেছেন। এই বাজারগুলো কাঁঠালবাগান বাজার বা হাতিরপুল বাজার থেকে কিনলে তার দিগুণ খরচ হতো। কষ্ট হলেও দূর থেকে বাজার করে এনেছেন। তিনি জানান, এক কেজি মাছ কিনেছেন ১২০ টাকায়। সেটি অন্য জায়গায় কিনতে হতো ১৪০-১৪৫ টাকায়। টমেটো স্থানীয় বাজারে ৪০-৫০ টাকা। তবে এটি তিনি এনেছেন ২৫ টাকা করে। এভাবে যা বাজার করেছেন তাতে তার ৫৬০ টাকা ব্যয় হয়েছে। শারীরিক কষ্ট হলেও কিছু টাকা বাঁচাতে পেরেছেন বলেই তার আনন্দ। কেননা মেয়ে পড়ে ধানমন্ডির নিউ মডেলে ও ছেলে ল কলেজে। স্বামী বাবুর্চি। খুব টেনে-টুনে চলে সংসার।

আরও পড়ুনঃ  ক্লিন ছাড়াই ‘ক্লিন ক্যাম্পেইন’

মোহাম্মদ আতিকুল্লাহ ভূইয়া খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ওএমএস চালের ডিলার। তিনি বিক্রির জন্য ৩ টন চাল ও এক টন আটা পান। এতে চালের জন্য ৮৪ হাজার ও আটার জন্য ২১ হাজার টাকা করে জমা দেন। সেগুলো বিক্রি করেন। তবে এটি মাত্র সপ্তাহে একদিন। আতিকুল্লাহ জানান, ডিলাররা মাসে সর্বোচ্চ ৫ দিন এসব বিক্রি করতে পারেন। অথচ চাহিদা প্রচুর। মানুষ তাদের প্রতি বিশ্বাস করে কিনতে আসে কিন্তু সপ্তাহে মাত্র একদিন তারা বিক্রি করতে পারেন। এসব পণ্য বিক্রির জন্য সপ্তাহে অন্তত তিনদিন দেওয়া দরকার বলে জানান তিনি। আতিকুল্লাহ ভূইয়া নিজের ব্যয়ের একটি হিসেবও দিলেন। তার প্রতি ট্রাকে একজন চালক, দুইজন বিক্রেতা রাখতে হয়। তাদের মজুরি ও খাবার, ট্রাক ভাড়াসহ সাড়ে ৫ হাজার টাকা ব্যয় হয়।

তেজগাঁও কলেজের এইচএসসি প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আলিফ। তিনি মাঝে মধ্যে তেল, ডাল কিনেন পরিবারের জন্য। সরকারি ছুটির দিন যে ন্যায্যমূল্যের গাড়ি আসে না এতে বিপাকে পড়েছেন তিনি। ঘরের তেল ফুরিয়ে গেছে। তার আজ মনে নেই যে ছুটির দিন এসব পণ্যবাহি ট্রাক আসে না। চঞ্চল ছেলেটি মুখ পানশে করে ঘরে ফিরছে।
ডিসেন্ট থেকে একটি কেক কিনে এনেছেন জাকির। মধ্য বয়সী এই লোকটি কেন লাইনে দাঁড়িয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আটা কিনবেন। তবে আধা ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে বাড়ির পথ ধরলেন।

ওএমএসের ট্রাকে শুধু নিম্নবিত্তরাই যাচ্ছেন বিষয়টি মোটেই এমন না বলে জানালেন বাবু। তিনি বলেন, উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত সবাই ট্রাকের পেছনে লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। কীভাবে দুটা পয়সা বাঁচাবে এই চিন্তা এখন সবার। ফলে অভাবীরা এর সুবিধা পাচ্ছে না। তবে অনেকেই বলছেন, কম দামে পণ্য কেনার জন্য টিসিবির ট্রাকের সামনে দাঁড়ানোর মধ্যে লজ্জা নেই। বাজারে কম দামে পণ্য কিনে টাকা সাশ্রয় করায় তো লজ্জা নেই।

সংবাদটি শেয়ার করুন