শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৫ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

চালের দামে ‘জটিলসূত্র’

চালের দামে ‘জটিলসূত্র’

চালের বাজারে অস্থিরতা কমছে না। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হলেও প্রতিনিয়ত প্রধান খাদ্য (ভাত) চালের দাম বাড়ছে। গেল তিন মাসে চালের দাম বেড়েছে দুইবার। আর মাসখানেকের ব্যবধানে চিকন চালে ৫ থেকে ৭ টাকা ও মোটা চালে ৩ থেকে ৫ টাকা বেড়েছে। এমনিতেই মুদ্রাস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে, তার ওপর নিত্যপণ্যের দামও নিম্নবৃত্তের নাগালের বাইরে যেতে শুরু করেছে। এর ওপর চালের দাম বাড়ায় নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের নাভিশ্বাস উঠছে।

সূত্রমতে, গত প্রায় দেড় যুগে চালের দাম বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। ২০০৫ সালে মোটা চালের দাম ছিল ২৪ টাকা কেজি। সেই চাল এখন ৫৫ টাকা। অর্থাৎ কেজিতে বেড়েছে ৩১ টাকা। আগামী রমজান মাসকে সামনে রেখে চালের দাম বেড়ে চলেছে বলে জানাচ্ছেন ভোক্তারা। এ বিষয়ে খাদ্যসচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম জানান, উৎপাদনের অনুপাতে ভোক্তা বেশি হওয়ায় চিকন চালের দাম বেড়েছে। তবে মোটা চাল তেমন বাড়েনি।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুনে চালের মূল্যস্ফীতির হার ছিলো ১৫ দশমিক ১৮ শতাংশ। আগস্টে ১৫ দশমিক ৬২। তখন জাতীয় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৫৪। চলতি অর্থবছরের জুলাইয়ে পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে চালের গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিলো ১৫ দশমিক ৮২ শতাংশে। যা সাম্প্রতিক সময়ের সর্বোচ্চ। অথচ গত এপ্রিল ও মে মাসে চালের মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১২ দশমিক ৪৫ ও ১২ দশমিক ৭৮ শতাংশ।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যানুযায়ী, ২০০৫ সালে প্রতি কেজি চালের গড় দাম ছিল ২৪ টাকা। ২০১০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৫ টাকা ও ২০২২ সালে তা ৫৫ টাকায় উন্নীত হয়েছে। গত ৫০ বছরে দেশে চালের উৎপাদন বেড়েছে তিন গুণ। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে দামও। গত ৫০ বছরে হেক্টরপ্রতি উৎপাদন বেড়েছে চার গুণ। আগে যেখানে প্রতি হেক্টরে এক টন চাল উৎপাদন হতো সেখানে বর্তমানে ৪ টন হচ্ছে। তবে এর পরও খাদ্যঘাটতি থাকছে। বিদেশ থেকে কিনতে হচ্ছে চাল।

আরও পড়ুনঃ  ভ্যাকসিনকে বিশ্বজনীন পণ্য হিসেবে ঘোষণা করা উচিত: প্রধানমন্ত্রী

গত বছরের ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক কৃষি সেবা বিভাগের ইউনাইটেড স্টেটস ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রিকালচারের (ইউএসডিএ) ‘খাদ্যশস্য: বিশ্ববাজার ও বাণিজ্য’ শিরোনামের প্রতিবেদনে চাল আমদানিতে বাংলাদেশকে বিশ্বের দ্বিতীয় স্থানে দেখানো হয়েছে। তাদের হিসাবে, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে চাল আমদানি করা হয় ২৬ লাখ ৫০ হাজার টন। আর ফুড এগ্রিকারচাল অর্গানাইজেশন-এফএও’র ‘গ্লোবাল ফুড আউটলুক-জুন ২০২১’ এর প্রতিবেদনে বিশ্বে চাল উৎপাদনে ইন্দোনেশিয়াকে পেছনে রেখে বাংলাদেশ তৃতীয় স্থানে রয়েছে। এর আগে বাংলাদেশের বৈশ্বিক অবস্থান ছিল চতুর্থ। উৎপাদন ও আমদানিতেও শীর্ষের ১ থেকে ৪ মধ্যে থাকায় বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবনায় ফেলে দিয়েছে।

দেশের অন্যতম পাইকারি বাজার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে বিভিন্ন দোকানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আটাশ চালটি বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকা কেজিতে। স্বর্ণা ৫০, মিনিকেট ৬৫ হতে ৭০, বাসমতি ৭৫ টাকা কেজি। মনসুর আহমেদ গত ৭ বছর যাবত এখানে চালের ব্যবসা করেন। তিনি জানান, মিনিকেট চাল বেশি চলে। তবে মোটা চালও বেশ ভালোই চলে। তিনি নাজিশাইল চাল বিক্রি করেন ৭০ টাকা কেজিতে। এখানে কথা হয় ফুলটনের সঙ্গে। তার দোকানে মোটা চাল বিক্রি হয় ৪৮ টাকা, বিআর-২৮ বিক্রি হয় ৪৬ টাকায়। বাজারে চালের ঘাটতি নেই বলে জানান ফুলটন। তবে দাম বাড়ানোর বিষয়টি ব্যবসায়ী নেতাদের ওপর নির্ভর করে কিনা জানা নেই তার।

রাজধানীর কাঁঠালবাগান বাজারে কথা হয় সজীব ও আবু সাঈদের সঙ্গে। দীর্ঘদিন যাবৎ চালের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তারা। বলেন, চালের বাজার প্রতিনিয়ত বাড়ে। এতে সাধারণ মানুষ পড়ে বিপাকে। তারা জানান, রাজধানীর এই বাজারটিতে স্বর্ণা ৫০, বিআর-২৮ চাল ৫৫ ও মিনিকেট ৬৫ ও বাসমতি ৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আবার হাতিরপুলে মুদি দোকানগুলোতে প্রায় একই দাম এসব চালের।

আরও পড়ুনঃ  মিঠাপুকুরে উপজেলা চেয়ারম্যান হলেন আওয়ামীলীগ নেতা কামরুজ্জামান

গত ১৫ জানুয়ারি দৈনিক আনন্দবাজারে দেশের ৮ বিভাগে খুচরা পর্যায়ে মোটা চালের বাজার দর নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তাতে দেখা যায়, ঢাকায় ৫৫, চট্টগ্রামে ৪৭, রাজশাহীতে ৬২, খুলনায় ৪৪, বরিশালে ৪২, রংপুরে ৪০, সিলেটে ৪৫ ও ময়মনসিংহে ৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।

কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, খাদ্য মন্ত্রণালয় ও টিসিবির বাজারদরের তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ সালের অক্টোবরে চালের দাম ছিল বেশ কম। তখন প্রতি কেজি মোটা চাল ছিল ৪৪ টাকা, মাঝারি ৪৭ ও সরু ৫৯ টাকা। তখন বোরো ধান ওঠার আগে হঠাৎ বন্যায় দর বৃদ্ধি পায়। এতে মোটা চাল ৫২ থেকে ৫৫ ও সরু নাজিরশাইল চালের দর ৭০ থেকে ৭২ টাকা পর্যন্ত উঠে। তবে ২০১৭ সালে গড় দরে মোটা চাল ৪০ টাকা, মাঝারি চাল ৪৬ ও সরু চাল ৫৩ টাকা। ২০১৫ ও ২০১৬ সালে দাম ছিল কিছুটা কম। এ দুই বছর কেজিপ্রতি গড় দর মোটা ২৯ টাকা, মাঝারি ৩৬ ও সরু ৪৪ টাকা। ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত চালের গড় দর ছিল মোটা ৩০ থেকে ৩৩, মাঝারি ৩৫ থেকে ৪০ ও সরু ৪৩ থেকে ৪৬ টাকা কেজি। ২০০৯ সালে মোটা চাল প্রতি কেজি সর্বনিম্ন ২৮ থেকে সর্বোচ্চ ৩৫ টাকায় বিক্রি হয়। তখন সরু চাল সর্বনিম্ন ৪০ থেকে সর্বোচ্চ ৪৫ টাকায় পাওয়া যেতো।

বাংলাদেশ কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের গতকাল শুক্রবারের বাজারদর অনুযায়ী আমন মোটা চাল ৪৫ টাকা, সরু ৫৫ টাকা, বোরো ৪৫ টাকা, আমন চিকন ৬৫, বোরো চিকন ৬৩ টাকা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এটি বাজারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে প্রায় ৯ লাখ টন চাল আমদানি হয়েছে।

আরও পড়ুনঃ  সৌভাগ্যের এই রজনীতে ঘরে বসেই ইবাদতের আহ্বান

গত বুধবার খাদ্যসচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম জানান, দেশের সরকারি গুদামে খাদ্য মজুতের পরিমাণ ১৯ লাখ ৯৫ হাজার ৫৪৯ টন। এরমধ্যে ২ লাখ ৪৮ হাজার ৫৫৭ টন হচ্ছে গম। আমন মৌসুমে ৭ লাখ ২০ হাজার টন লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে এরইমধ্যে ৬ লাখ ২৯ হাজার টন চাল সংগ্রহ করা হয়েছে।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন