করোনাময় এখন সারা দেশ। এমন পরিস্থিতিতে মিলছে না পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা। এমন অবস্থায় চিকিৎসা সেবায় ও গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন জীবপ্রযুক্তিবিদ বা বায়োটেকনোলজিষ্টরা এমনটাই মন্তব্য করেন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মেহেদী হাসান খান (অধ্যাপক ও ডিন, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় )।
তিনি বলেন, ‘পুরো বিশ্ব আজ স্তব্ধ হয়ে আছে, একেকটি দেশ যেন একেকটি মৃত্যুপুরী। ‘করোনা ভাইরাস’ ছোট্ট একটি অনুজীব, প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর কারণ হচ্ছে। বাংলাদেশেও আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে প্রতিদিন। অপ্রতুল চিকিৎসা সামগ্রী নিয়ে করোনার বিরুদ্ধে লড়ছি আমরা। মাস্ক, পিপিই, টেস্ট কিট ইত্যাদির সংকট তো আছেই আর উপর অবাক করার বিষয় হলো দক্ষ জনবল সংকট।
করোনা ভাইরাস টেস্ট করার জন্য পাওয়া যাচ্ছেনা পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত জনবল। অথচ অবস্থা হবার কথা ছিল ভিন্ন। দেশে প্রায় পঁচিশ বছর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে দেয়া হয় জীব প্রযুক্তি বা বায়োটেকনোলজি শিক্ষা। দেশে রয়েছে কয়েক হাজার জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি গ্রাজুয়েট। যে রিয়েল টাইম পিসিআর বা কিউ-পিসিআর ব্যবহার হচ্ছে কোভিড-১৯ সনাক্তকরণে, তা বায়োটেকনোলজি শিক্ষার্থীদের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত, এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বায়োটেকনোলজির নানা গবেষনা করা হয়।
বায়োটেকনোলজির অনেক শিক্ষক-শিক্ষার্থী রয়েছে এ বিষয়ে প্রশিক্ষিত এবং অভিজ্ঞ। তাও কেন দক্ষ জনবল পাওয়া যাচ্ছে না! তবে কি বায়োটেকনোলজির গ্রাজুয়েটরা নেই এদেশে! নাকি একটি মহল চোখ থেকেও দেখছে না এদেশের বায়োটেকনোলজির সম্ভাবনার বিষয়টি। এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে এ দেশে বায়োটেকনোলজি সেক্টরকে ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করলে।
একুশ শতককে বলা হয় জীব প্রযুক্তির শতাব্দী। এ বিষয়কে মাথায় রেখে দেশে জীব প্রযুক্তি গবেষনা ও দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি (এনআইবি)। এর আগেই ১৯৯৫ সাল থেকে বায়োটেকনোলজি শিক্ষা শুরু হয় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাত ধরে, এরপর একে একে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সহ প্রায় ২৫ টি পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োটেকনোলজি শিক্ষা ও গবেষনার জন্য বিভাগ চালু হয়। ভর্তি পরীক্ষায় মেধার সর্বোচ্চ স্বাক্ষর রেখে ভর্তি হতে হয় ফলিত জীববিজ্ঞানের অধুনিকতম এই বিষয়ে।
প্রতি বছর পর্যাপ্ত সংখ্যক গ্রাজুয়েটও বের হয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে। যারা দেশে জীবপ্রযুক্তির নানা বিষয়ে গবেষনা এবং সংশ্লিষ্ট শিল্প প্রতিষ্টানে অবদান রাখার মাধ্যমে দেশকে টেকসই উন্নয়নের দিকে নিয়ে যেত পারতো। অথচ এ সেক্টরকে হয়তো গুরুত্বের চোখে দেখা হচ্ছে না, বা দেখলেও তা দৃশ্যমান নয়। তারই ফল হচ্ছে আজকের এই করোনা মহামারিতে পর্যাপ্ত জনবল না পাওয়া শুধুমাত্র সনাক্তকরণের জন্য। অথচ এই সেক্টরের প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দেয়া হলে, টেস্ট কিট উৎপাদন, ভেক্সিন আবিষ্কারও হয়তো করা যেত আমাদের দেশ থেকেই। এখন যার জন্য আমরা উন্নত দেশগুলোর দিকে চেয়ে থাকছি । উপরন্তু, নিজেদের দ্বায়িত্ববোধ থেকে এগিয়ে এলেও তাদের ফিরিয়ে দেয়া হয়। আরো হতাশার বিষয় হচ্ছে, কিছু গবেষনা প্রতিষ্ঠানে বায়োটেকনোলজিস্ট বা জীবপ্রযুক্তিবিদের পদ থাকার পরও সেখানে নিয়োগ পায়না বায়োটেকনোলজি গ্রাজুয়েটরা।
উদাহরণ স্বরূপ, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষনা পরিষদ (বিসিএসাইআর) এর একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে ৩ জন বায়োটেকনোলজিস্ট এর পদ পূরণ করা হয় অন্য বিষয়ের গ্রাজুয়েট দিয়ে। অন্যান্য গবেষনা প্রতিষ্ঠানের চিত্রও একই। বায়োটেকনোলজির অভিভাবক এনআইবিও এ বিষয়ের গ্রেজুয়েটদের চাকরির ক্ষেত্র তৈরি বা নিয়োগ দিতে বড় রকমের কোন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে নি। এতে যেমন এই বিষয়ের গ্রেজুয়েটরা বঞ্চিত হচ্ছে তেমনি দেশ বঞ্চিত হচ্ছে তাদের সেবা থেকে, বিশ্ব যেখানে জীবপ্রযুক্তিতে এগিয়ে যাচ্ছে অনেকদূর, আমরা আছি পিছিয়ে।
এখানে পরিলক্ষিত হচ্ছে যে, দেশের বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে ডিপ্লোমা ডিগ্রীধারীদের চাকরি দেওয়া হচ্ছে। যারা অ্যাডভান্স মলিকুলার লেভেলের কোন ধরণের টেকনোলজির সাথে পরিচিত নয়। আর তাছাড়া বিভিন্ন দুর্যোগ মুহূর্তে আধুনিক যন্ত্রপাতি ছাড়া ডায়াগনোসিস করা সম্ভব হয়ে হঠে না। সেই ক্ষেত্রে যারা বায়োটেকনোলজিস্ট, তাদেরকে নিয়োগ দেওয়া ছাড়া রোগ নির্ণয় এবং তার যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না।
সরকার যদিও এই দুর্যোগকালীন সময়ে দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় শহরের সরকারী হাসপাতালগুলোতে বি-এস-এল-২ মানের ল্যাব এবং আর-টি- পিসিআর-এর ব্যাবস্থা করেছে, সেখানে প্রশ্ন থাকে এই যে, এই রকমের গুরুত্বপূর্ণ টেস্টটি করার জন্য কোন যোগ্য ব্যাক্তিকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে কিনা। কারণ, আর-টি- পিসিআর এমন একটি পরীক্ষা, যা কিনা শুধুমাত্রই খুবই অভিজ্ঞ ও দক্ষ লোক ছাড়া করলে ভুল রেজাল্ট পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। সেই ক্ষেত্রে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজির গ্র্যাজুয়েট যারা এই টেকনোলজি সম্পর্কে জানেন এবং এটি পূর্বে হাতে কলমে ব্যবহার করে এসেছেন, তাদেরকে এই কাজে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে।
বর্তমানে অনেক বায়োটেকনোলজি গ্রাজুয়েট পাশ করে চাকুরী না থাকায় বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। এর ফলে, দেশ থেকে মেধা পাচার হচ্ছে। অনেকে পি.এইচ.ডি বা পোস্ট ডক্টরেট করে দেশে ফিরতে চাচ্ছে, কিন্তু দেশে চাকুরীর সুযোগ না থাকায় বিদেশে থেকে যেতে বাধ্য হচ্ছে। জীববিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় যেমন- বায়োকেমেস্ট্রি, মাইক্রোবায়োলজি, ফার্মেসি তাদের অবস্থা এতটা খারাপ না হলেও অনেকটা এরকমই। অথচ ভর্তি পরীক্ষার সময় সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীরা এসব বিষয়ে ভর্তি হয়।
অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে উদাহরণ আমরা নিয়ে আসি। ভারতে জীব প্রযুক্তি সেক্টরের দিকে তাকালেই বুঝা যাবে আমরা কতটুকু পিছিয়ে আছি। যার ফলস্বরূপ বিশ্বের এই দুর্যোগেও, দেশে পাওয়া যাচ্ছেনা পর্যাপ্ত জনবল, যাদের দেয়ার কথা ছিল নেতৃত্ব তারা পাচ্ছেনা সেবা দেয়ার সুযোগ। দেশ ও দেশের জনগন হচ্ছে বঞ্চিত।
সরকারের প্রতি অনুরোধ থাকবে এ বিষয় তাদের আমলে নেয়ার। দেশের বায়োটেকনোলজি সেক্টরকে যথাযথ গুরুত্বের সাথে নেওয়া। বায়োটেকনোলজি গ্রাজুয়েটদের যথাযথ চাকরির ব্যবস্থা করা, বিসিএস সহ অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানে পদ সৃষ্টি করা এবং সর্বোপরি বায়োটেকনোলজি সেক্টরকে বায়োটেকনোলজিস্টদের হাতে তুলে দেওয়া।
আনন্দবাজার/শাহী