শনিবার, ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এবার শীতের কাঁচাবাজার ছড়াবে উষ্ণতা

সবজিতে সুখবর নেই

সবজিতে সুখবর নেই

দামে উঠানামা
• দামে লাগামছাড়া ধনে পাতা
• শিমের বাজারে ডাবল সেঞ্চুরি
• ডিমের বাজারে আগের শঙ্কা

কাঁচাবাজারের সবজির দাম শুনে শুনে ক্লান্ত চাকরিজীবি নাজমুল ইসলাম। থাকেন রাজধানীর বনগ্রামে। মাথা নিচু করে বিড় বিড় করে হিসেব কষছেন। গতকাল শুক্রবার বেলা ১১টায় কথা হয় তার সঙ্গে কাপ্তানবাজারে। বলেন কষ্টের কথা। আক্ষেপ নিয়ে বলেন, সবজির দাম বৃদ্ধি শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি। বাঁচতে হবে, নিরুপায় হলেও সবজি কিনতে হচ্ছে। কারণ সীমিত আয়, প্রতিদিন মাছ মাংস কেনার মতো সামর্থ নেই। তাই সবজির ওপরেই নির্ভর করতে হচ্ছে। কিন্তু সেই সবজির দামে আগুন। হাত দেওয়া যায় না।

নাজমুল ইসলাম বলেন, পরিবারে পাঁচজন সদস্য। তার স্ত্রী কোভিডের সময় স্কুলে চাকরি হারান। পরিবারের অন্য সদস্য হলেন- দুই ছেলে এবং এক মেয়ে। সবাই পড়াশুনা করেন। একমাত্র তিনিই আয় করেন। গত তিন বছর বেতন বাড়েনি। কিন্তু লাগামহীন ভাবে বেড়েছে ব্যয়। এরপরও টেনেটুনে কোনো মতে, হিমশিম খেয়েও সংসার চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু বর্তমান বাজারের সব কিছুর দামে উর্ধ্বগতিতে অনেকটা হাঁপিয়ে ওঠেছি। অতি দামে কারণে সবকিছুই লাগারের বাইরে চলে গিয়েছে।

এমন কষ্টের কথা বলেন একই বাজারের আরেক ক্রেতা ব্যাংকার কামরুন নাহার। তিনি বলেন, পণ্যের দাম বৃদ্ধি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি, অবাকও হচ্ছে। কিছুই বলার নেই। বেঁচে থাকার তাগিয়ে সহ্য করে কোনো মতে টেনেটুনে সংসার চালিয়ে যাচ্ছি। চলতি বছরের শুরুতে ৩শ টাকায় ৮ থেকে ৯ ধরনের তাজা তাজা সবজি পাওয়া যেত। বর্তমানে সেই পরিমাণ সবজি কিনতে গুণতে হচ্ছে পাঁচশ টাকা ওপরে। পছন্দের সবজি কিনতে গুনতে হচ্ছে আরো বেশি। মাস হিসেব করলে, যেখানে শুধু সবজিতে তিন থেকে চার হাজার টাকা গুণতে হতো, সেখানে গুণতে হচ্ছে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকার বেশি। এতো শুধু সবজির বেলা। অন্য পণ্যের বেলায় দাম বেড়েছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। কিন্তু বাড়েনি আয়।

মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের কাঁচাবাজারে কথা হয় ক্রেতা রহমত রহমানের সঙ্গে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হতাশার কণ্ঠে তিনি বলেন, আমার ছোট দুটি বাচ্চা রয়েছে। একটি ছয় বছরের অন্যটি চার বছরের। তাদের প্রোটিন চাহিদা মেটাতে প্রতিদিনই ডিম থাকা লাগে। সেই ডিমে রয়েছে চড়া দাম। মাসে যেখানে ডিমের পেছনে হাজার টাকা লাগতো, বর্তমানে সেখানে লাগছে দেড় হাজার টাকার বেশি। একইভাবে প্রায় ২৫ শতাংশ খরচ বেড়েছে মাছ-মাংসের বেলায়। সবজিতে রয়েছে অতি চড়া দাম। পেঁপে ছাড়া কোন সবজি ৬০ টাকার নিচে পাওয়া যায় না।

আরও পড়ুনঃ  মাল্টা-আপেলের উচ্চলম্ফ

দাম বৃদ্ধির প্রসঙ্গে উল্টো কথা বলছেন বিভিন্ন কাঁচাবাজারের ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, সব কিছুর দাম লাগারের মধ্যে রয়েছে। কিছু দাম বেড়েছে। পরিবহন ও বেশি দামে কেনায়, বাড়াতে বাধ্য হয়েছি। আবার সবজি কম আসায় বেশি দাম দিয়ে আড়ৎ থেকে কিনতে হচ্ছে। তবে সরবরাহ বাড়লে দাম নিয়ন্ত্রেন চলে আসবে। এছাড়া বন্যার প্রভাব পড়েছে নিত্যপণ্যের বাজারে।

এদিকে, মূলত জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই চড়া সবজির বাজার। প্রায় সব সবজির দামই কমবেশি বেড়েছে। গত ৫ আগস্ট রাতে দেশে জ্বালানি (ডিজেল, অকটেন, পেট্রোল, কেরোসিন) তেলের দাম লিটারে ৪২ থেকে ৫২ ভাগ পর্যন্ত বাড়িয়েছে সরকার। তার দুই-এক দিন পর থেকেই তার প্রভাব পড়ে রাজধানীর কাঁচাবাজারে। সম্প্রতি জ্বালানির দাম লিটারে পাঁচ টাকা করে কমিয়েছে। বর্তমানে এই দাম কার্যকর হয়। জ্বালানির দাম কমলে তার প্রভাব পড়েনি সবজির বাজারে।

পাইকারী ব্যবসায়ীরা বলছেন, ৫ আগস্টে জ্বালানি নতুন দাম কার্যকরের পর ট্রাকভাড়া বেড়ে যাওয়ায় সবজির কেজিতে ২ টাকা বেশি গুনতে হয়েছিল। তবে খুচরা বাজারে যেভাবে বেড়েছিল, সেটা রীতিমতো অন্যায়। সম্প্রতি সরকার জ্বালানির দাম কমিয়েছে। পূর্বে জ্বালানির দাম বেড়েছিল সর্বোচ্চ ৫২ টাকা। কিন্তু কমিয়েছে ৫ টাকা। যেটা বাড়ানোর তুলনায় কমানো খুবই সামান্য। যা বাজারে কমার ক্ষেত্রে ভুমিকা রাখবে না। এটাই স্বাভাবিক।

সামনে সবজির দাম আরো বাড়তে পারে এমন আভাস দিয়ে পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, কারণ সামনে শীতের সবজি মৌসুম আসছে। সেখানে শীতের সবজি বীজ বপন করা হয়েছিল। কেবল চারাগুলো গজিয়ে বড়ও হয়েছিল। এমন সময় দেশের উত্তর অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিত চরমে। এতে রাজশাহী, নীলফামারী, লালমনিরহাট, সিরাজগঞ্জ, কুড়িগ্রামের প্রায় শত গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে। ওইসব গ্রামে কৃষি জমিগুলো বন্যায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। নষ্ট হয়েছে তাদের জমির ফসল। তার প্রভাব আমাদের কাঁচা বাজারে পড়বে। ধারনা করছি, পূর্বের চেয়ে সবজি সরবরাহ কমবে। আর সরবারাহ কমলে অবশ্য সবজির দাম বাড়বে।

হাতিলপুর কাঁচাবাজারে কথা হয় চাকরিজীবি নাসরিন চৌধুরী সঙ্গে। তিনি বলেন, শুক্রবার সংসারের অনেক কাজ গুজিয়ে করতে। যেহেতু চাকরি করি, তাই এদিনে সাপ্তাহিক বাজার করে থাকি। বরাবারের মতো এবারে বাজারে এসেছি। বাজারও করেছি। বর্তমান বাজার দর অতি বাড়তি। গত সপ্তাহে (১৬ সেপ্টেম্বর) যেখানে আড়াই হাজার টাকার বাজার করেছি। সেই পরিমাণ বাজার করতে এবারে চার হাজার টাকায় ঠেকেছে।

বাজার ঘুরে দেখা যায়, সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়েছে অধিকাংশ সবজির দাম। দামের দাপটের শীর্ষে রয়েছে ধনে পাতা। প্রতি কেজি ৩০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এরপর দামের শীর্ষে রয়েছে শিম। প্রতি কেজি শিম ২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। দামের বৃদ্ধির তালিকায় সমান তালে এগিয়ে আছে বিট আলু। প্রতি কেজি বিট আলু ২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। শীর্ষ দামের সঙ্গী হিসেবে রয়েছে চোখ ধাঁধানো রঙিন সবজি গাজর। প্রতি কেজি ১৬০ (চায়না) টাকায় বিক্রি হয়েছে। তবে দেশি গাজর প্রতি কেজি ১২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। শীর্ষ দামের সঙ্গে রয়েছে টমেটো ও বেগুন (গোল)। প্রতি কেজি ১২০ (চায়না) টাকায় বিক্রি হয়েছে।

আরও পড়ুনঃ  ভরা মৌসুমেও চালের দাম চড়া

সপ্তাহের ব্যবধানে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে ডিম। বেড়েছে শিম, বিট আলু ও গাজর। তবে টমেটো আগের অবস্থানেই রয়েছে। দামের দিক দিয়ে সঞ্চুরির পথের কাছাকাছিতে রয়েছে বটবটি, করলা, কাঁকরোল, লতি, কচুর ঘাডি এবং ঝিঙা। এসব প্রতি কেজি ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এদিকে ডাবল সেঞ্চুরির ওপরে থাকা কাঁচা মরিচের দাম নেমেছে অর্ধেকের নিচে। কয়েক সপ্তাহ ধরে রাজধানীর বাজারগুলো প্রতি কেজি কাঁচা মরিচ ৭০ টাকার মধ্যে ছিল। কিন্তু গতকাল মরিচের দাম বাড়তি লক্ষ্য করা গেছে। প্রতি কেজি মরিচ বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়। মরিচের ঝালের সাথে সামান্য বাড়লো শসা। তবে গরুর মাংস ও মুরগীর (পাকিস্থানি) দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।

অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, পাইকারি বাজারের তুলনায় খুচরা বাজারের ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। প্রতি কেজিতে ২৫ টাকা। বেশকিছু সবজিতে পার্থক্য আরো দ্বিগুণ। কাঁচাবাজারে নিম্নবিত্তের নাগালের বাইরে। ব্যবসায়ীরা যুক্তি দিচ্ছেন, চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় দাম চড়া। উত্তরাঞ্চলে বন্যার কারণে সবজির দাম সামনে আরো বাড়বে এমন আভাস দিচ্ছেন বিক্রেতারা।

তবে রাজধানীর ব্যবসায়ীদের যুক্তির সঙ্গে কোনোভাবেই মেলে না মফস্বলের ব্যাখ্যা। কৃষি পর্যায়ে যে পণ্য ২০ টাকা কেজি রাজধানীতে এলেই ৫০ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বেড়ে যায় তিনগুণ। সরকারের বিভিন্ন কঠোর তদারকিও সবজির দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি। এদিকে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে মিল নেই কমানোর সমন্বয়।

রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, সব সবজিই চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে। স্থানভেদে প্রতি কেজি দামে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। চড়া দাম প্রসঙ্গে শনিরআখড়ায় সবজি ব্যবসায়ী রনি বলেন, এখন ধনে পাত ও শিমের মৌসুম না। এগুলো শীতের সবজি। কিন্তু বাজারে চাহিদা রয়েছে। চাহিদা থাকায় ধনে পাতা প্রতি কেজি তিনশ এবং শিমের দাম কেজি প্রতি দুইশ টাকা।

আরও পড়ুনঃ  নীলফামারীর ৪টি আসনের ২টিতে নৌকা ও ২টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীর জয়

কাপ্তানবাজারের ব্যবসায়ী নুরুল হক বলেন, চাহিদার তুলনায় কম গাজর, টমেটো ও বটবতি বাজারে রয়েছে। যেহেতু বাজারে সরবরাহ কম, সেহেতু দাম বেশি এটাই স্বাভাবিক। বর্তমানে বাজারে গজর প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকা। টমেটো ও বটবতি বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১২০ টাকা। সবজির দাম প্রসঙ্গে একই বাজারের ক্রেতা আব্দুস সালাম বলেন, গাজরের দামে অনেক বেশি। দাম বেড়েছে লতি, বটবটি ও ঝিঙ্গার। টমেটো আগের দামেই রয়েছে।

গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন খোলাবাজার সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে রাজধানীর ডিমের হালি ৫০ টাকা। তবে কিছুদিন আগেও ডিমের হালি ছিল ৪৫ টাকা। পাইকারি বাজারের প্রতিটি ডিম বিক্রি হচ্ছে ১০ টাকা। বেশিরভাগ ব্যবসায়ী ব্রয়লার মুরগির কেজি বিক্রি করছেন ১৭০ টাকায়। আগে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর মুরগির কেজি ২০০ টাকা উঠেছিল। বেড়েছে পাকিস্তানি কক বা সোনালী মুরগির দাম। বর্তমানে মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩২০ টাকায়।

খুচরা বাজারে শসা ৬০ টাকা কেজি। ঢেঁড়শের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায়। সপ্তাহের ব্যবধানে দাম অপরিবর্তিত রয়েছে পেঁয়াজ ও আলুর। পেঁয়াজ গত সপ্তাহের মতো কেজিপ্রতি ৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আলুর কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকায়। এছাড়া লতি ৮০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া ৫০ টাকা, পেঁপের ৩০ টাকা, পটল ৬০ টাকা, বেগুন ১২০ (গোল) টাকা, বেগুন ৮০ (লম্বা) টাকা, কহি ৮০ টাকা এবং কাঁকরোল ৮০ টাকায় কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। কচুর ঘাডি এবং চিচিঙ্গা বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়। এছাড়া চালকুমড়া ৫০ টাকা, প্রতিটি ফুলকপি ৫০ টাকা, পাতাকপি ৫০ টাকা এবং লাউ ৬০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। তবে এগুলো সাইজের ওপরে দাম কমবেশি রয়েছে।

রুই মাছের কেজি বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৩২০ থেকে ৪০০ টাকায়। তেলাপিয়া, পাঙাস মাছের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৬০ থেকে ২০০ টাকায়। শিং মাছের কেজি ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা। আর ২০০ তেকে ২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে কৈ মাছের কেজি। পাবদা মাছের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা। মাছের মধ্যে চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে চিংড়ি ও ইলিশ। চিংড়ির কেজি বিক্রি হচ্ছে ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা। এক কেজি ওজনের ইলিশের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১০০০ থেকে ১৩০০ টাকা। ৭০০ থেকে ৮০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের কেজি ৭৫০ থেকে ১০০০ টাকা। আর ৪০০ থেকে ৫০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ৬৫০ টাকা।

সংবাদটি শেয়ার করুন