শনিবার, ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অপ্রতিরোধ্য হর্ন দানব

অপ্রতিরোধ্য হর্ন দানব

একবার ব্যস্ত রাস্তায় এক মোটরসাইকেল চালককে দফায় দফায় হর্ন বাজাতে দেখে তাকে ‘হর্নমাস্টার’ বলেই মনে হলো। কৌতুহলবশত কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম, এত জোরে জোরে হর্ন দিচ্ছেন কেন? বাইক চালক মনে হয় জীবনে প্রথম এমন কথা শুনলেন। খানিকটা অবাক হয়ে বললেন, জোরে হর্ন না দিলে তো পাবলিক সরে না, সাইডও দেয় না। এবার সমানে গিয়ে এক পাবলিককে ধরে বললাম, পেছনে তো হর্ন দিচ্ছে, শুনতে পাচ্ছেন? তিনি কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললেন, চারপাশে এত হর্ন, কে কোনদিক থেকে দিচ্ছে, তা তো বুঝতে পারছি না। আমার এমন অদম্য কৌতুহল দেখে একজন এগিয়ে এলেন। বিজ্ঞের মতো বললেন, হর্ন শুনে শুনে পাবলিকের কান পচে গেছে। সাধারণ হর্নে আর কাজ হয় না। তাই আরো বড় হর্ন, আরো বেশি শব্দ না হলে সড়কে দ্রুত ছুটতে পারবেন না। পেছনে পড়ে থাকতে হবে।

চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ ডা. মনিলাল আইচ লিটুর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে দিন দিন হর্ন দানবের তর্জন গর্জন বৃদ্ধির রহস্যের খানিকটা জট খুললো। তিনি দৈনিক আনন্দবাজারকে বললেন, শব্দ দূষণে শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত রোগীর সংখ্যা আগের চেয়ে মারাত্মকভাবে বেড়েছে। একটি গবেষণা থেকে পাওয়া দুঃসংবাদের তথ্য তথ্য তুলে ধরে ডা. লিটু জানালেন, রাজধানীর এক তৃতীয়াংশ মানুষের শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত। যাদের বড় একটি অংশ বধির হওয়ার পথে। সঙ্গে তিনি এটাও বললেন, কানে কম শোনা পথচারীদের জন্য অধিক জোরে হর্ন দিচ্ছেন গাড়ির চালকরা। এতে সুস্থ পথচারীদের শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এটা একটা চক্রবৃদ্ধির ঘটনা।

রাস্তায় শব্দ দূষণের দানব হিসেবে স্বীকৃতি পেতে পারে হাইড্রোলিক হর্ন। তবে উচ্চ শব্দের হুটার বা সাইরেনের শব্দ আবার কখনও কখনও হাইড্রোলিক হর্নকেও ছাপিয়ে যায়। আবার রাস্তায় প্রতিনিয়তই দেখা যায়, কেউ হাইড্রোলিক হর্ন বাজালে তার জবাবে পাশে থাকা হুটার কিংবা সাইরেন তীব্র শব্দে উপস্থিতি জানান দেয়। এরকম উচ্চশব্দে যখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা, তখন সেই শব্দকে থেকে রক্ষা পেতে হর্ন উৎসবে যুক্ত হয় বাস, ট্রাক, কার, এমনকি রিকশাওয়ালা পর্যন্ত। যাদের অনেকেই আবার জোরালো শব্দ সৃষ্টিতে উৎসবের আমেজ খুঁজে পান। এটা অনেকটা ঘর পুড়িয়ে আলু পোড়ার স্বাদ নেয়ার মতো।

আরও পড়ুনঃ  বিটিআরসির সাবেক কমিশনার ও টেলিটকের এমডিসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

কয়েকবছর আগে বেসরকারি সংস্থা ওয়ার্কস ফর বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট (ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট) পরিচালিত এক গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, রাজধানীতে শতকরা ৯৭ শিক্ষার্থীর পড়াশুনায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে গাড়ির হর্ন। সেই সঙ্গে শতকরা ৮৬ ভাগ মানুষই শব্দ দূষণকে বড় ধরনের সমস্যা হিসেবে দেখতে শুরু করেছেন। পাশাপাশি পরিবেশ অধিদপ্তরের এক জরিপ প্রতিবেদনে ঢাকাসহ দেশের আট বিভাগের শব্দ দূষণের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয়। যেখানে গাড়ির হর্নকে শ্রবণশক্তির ভয়াবহ ঘাতক হিসেবে দেখানো হয়।

সেই প্রতিবেদনে রাজধানীর শ্যামলী এলাকায় হর্ন বাজানোর চিত্রে দেখা যায়, সেখানে প্রতি ১০ মিনিটে যে ৫৯৮টি হর্ন বাজানো হয় তার মধ্যে হাইড্রোলিক হর্ন ১৫৮টি। তবে সেই ঘটনা শুধু শ্যামলীতেই সীমাবদ্ধ নয়, গোটা রাজধানীসহ আটটি বিভাগীয় শহরের চিত্র একই। তীব্রমাত্রার সেই হর্ন বাজানো থেকে ক্ষতির শিকার হওয়া রাজধানীর ৯ শতাংশ মানুষ শরণাপন্ন হচ্ছেন চিকিৎসকদের।

শুধু পরিবেশ অধিদপ্তরই নয়, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ, বিশ্বব্যাংকের একাধিক গবেষণায় সারাবিশ্বের মানুষের ৩০টি কঠিন রোগের অন্যতম কারণ হিসেবে শব্দ দূষণকে চিহ্নিত করা হয়েছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, উচ্চমাত্রার শব্দে মানুষের শ্রবণশক্তি হ্রাসসহ শিক্ষার্থীদের নিবিষ্ট চিত্তে বুদ্ধিদীপ্ত কাজ করার ক্ষেত্রে ভয়াবহ সমস্যা দেখা দেয়ায় মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শব্দদূষণের কারণে সাময়িক বা স্থায়ীভাবে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার্থী, শিশু, হাসপাতালের রোগী, ট্রাফিক পুলিশ, পথচারী ও গাড়িচালকরা।

ঢাকার নাগরিকদের শান্তিপূর্ণ বসবাস নিশ্চিত করতে মহানগরী অধ্যাদেশ ১৯৭৬-এর ২৭ ও ৩১ ধারায় অনুমোদন ছাড়া জনসভা, সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বিধিনিষেধ থাকলেও তা মানা হয় না। ১৯৯৭ সালের পরিবেশ ও বন সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকার নির্ধারিত প্রতিষ্ঠান থেকে ১০০ মিটার দূরত্ব পর্যন্ত নীরব হিসেবে চিহ্নিত এলাকায় মোটরগাড়ির হর্ন বাজানো বা মাইকিং করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হলেও তার কোনো প্রয়োগ নেই।

আরও পড়ুনঃ  চূড়ান্ত অনুমোদন পেল চলচ্চিত্র শিল্পী কল্যাণ ট্রাস্ট আইনের খসড়া

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে রাজধানীতে নিবন্ধিত যন্ত্রচালিত যানবাহনের সংখ্যা ১৪ লাখের বেশি। যার মধ্যে মোটর সাইকেল প্রায় পাঁচ লাখ। ব্যক্তিগত গাড়ি আড়াই লাখের মতো। নিবন্ধিত বাস প্রায় তিরিশ হাজার। এর মধ্যে প্রতিমাসেই ব্যক্তিগত গাড়ি দেড় হাজার করে বাড়ছে। পাশাপাশি নিবন্ধিত ট্রাক, কার্গো ও কাভার্ড ভ্যান প্রায় দুই লাখের মতো। যাদের প্রায়গুলোতেই উচ্চমাত্রার শব্দ সৃষ্টিকারী হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার করা হয়। রাস্তায় চলতে গিয়ে কারণে-অকারণে এসব হর্ন বাজানোর প্রতিযোগিতা চলে চালকদের অসচেতনতায়।

দেশজুড়ে হাইড্রোলিক হর্ন উৎসব বন্ধ করতে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর ভূমিকা তেমন দেখা যায় না। তবে ভয়াবহ শব্দ দূষণ সৃষ্টিকারী হাইড্রোলিক হর্ন বন্ধে নির্দেশনা চেয়ে গত ২০১৭ সালে যে রিট করা হয়েছিল তাতে হাইকোর্ট রাজধানীতে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হর্ন বন্ধের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সেই নির্দেশে হাইড্রোলিক হর্ন আমদানি যেমন নিষিদ্ধ করা হয়, সেই সঙ্গে বাজারে যেসব হর্ন আছে সেগুলো সাতদিনের মধ্যে জব্দ করার নির্দেশ না হয়। যদিও সেই নির্দেশনা অক্ষরে অক্ষরে পালন করার ক্ষেত্রে দারুণ উদাসীনতা দেখা যায়।

সেই উদাসীনতা লক্ষ্য করেই মাস কয়েক পর হাইড্রোলিক হর্ন উৎপাদন বন্ধ চেয়ে হাইকোর্টে আরো একটি রিট করা হয়। সেই রিটে হাইকোর্ট রাজধানীর আবাসিক ও ভিআইপি এলাকায় রাত ১০টার পর সব হর্ন বাজানো বন্ধ ও ২০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে গাড়ি চালানোয় নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। সেই সঙ্গে সড়কে তদারকি টিম গঠনের নির্দেশনা দেয়া হয়। অবশ্য তখন কয়েক দফায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয়। যার মাধ্যমে শব্দ দূষণ সৃষ্টিকারী কিছু হর্ন জব্দও করা হয়।

আরও পড়ুনঃ  মোবাইল ইন্টারনেটের দাম প্রতি জিবিতে ২০ টাকা বেড়েছে

তবে বেশ কিছুদিন তোড়জোর দেখা গেলেও হাইড্রোলিক হর্নের লাগামছাড়া ব্যবহার আবার বেড়ে যায়। ব্যক্তিগত গাড়ি, মোটরসাইকেল এমনকি আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর গাড়িগুলোতে নিষিদ্ধ হাইড্রোলিক হর্ন লাগানোর উৎসব দেখা দেয়। আমদানি আর উৎপাদন বন্ধের নির্দেশনা থাকলেও রাজধানীর বাংলামোটর, ইস্কাটন, বিজয়নগর, নবাবপুর, ধোলাইখাল এলাকায় গাড়ির যন্ত্রাংশ বিক্রির দোকানগুলোতে হাইড্রোলিক হর্ন দেদারছে বিক্রি হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের অনেকে জানেনই না, হাইড্রোলিক হর্ন আমদানি কিংবা উৎপাদন নিষিদ্ধ। আর আমদানি কিংবা উৎপাদনে কেউ হস্তক্ষেপও করছে না কেউ। যে কারণে তারা অবাধে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।

বিআরটিএর কর্মকর্তারা বলছেন, তারা হাইড্রোলিক হর্ন বন্ধ করে দিয়েছেন। তাছাড়া ভ্রাম্যমাণ আদালতও পরিচালনা করা হচ্ছে। তবে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা এব্যাপারে জনসচেতনার ওপরেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। তারা বলছেন, শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সমন্বিতভাবে কাজ করা হবে। তাহলে জনসচেতনা বাড়বে। জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি আর অভ্যাসের বদল ঘটাতে গেল কয়েক বছর ধরেই কাজ করে যাচ্ছেন পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। তবে বড় কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না।

চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের দেয়া তথ্যমতে, সহনীয় মাত্রার চেয়ে দ্বিগুণ-তিনগুণ তীব্রতার শব্দে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন রাজধানী ঢাকার অর্ধকোটির বেশি মানুষ। প্রতিদিনই নাগরিকদের বিরক্তিবোধ, মাথাধরা, মেজাজ খারাপ, ঘুমের ব্যঘাতসহ নানা মনোঃদৈহিক সমস্যা সৃষ্টি করছে এই শব্দ দূষণ। নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, এমনকি ব্যক্তির আচরণে। ঝুঁকি বাড়াচ্ছে হৃদরোগের। শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে নানামুখী আইন আর উচ্চ আদালতের দু’দফায় নির্দেশনা জারির পরেও প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না নীরব এই ঘাতককে। বরং উচ্চ শব্দের মাইক বাজানোর প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রাণ হারাতেও হচ্ছে কাউকে কাউকে।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন