শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৫ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মাছশূন্য হচ্ছে মেঘনা

মাছশূন্য হচ্ছে মেঘনা
  • ভিন্ন পেশায় জেলেরা

বিভিন্ন মিল ইন্ডাষ্ট্রিজের বর্জ্য, চায়না চাই জাল, নিষিদ্ধ সময়ে মাছ ধরা ও অবৈধ ভাবে মেঘনা নদী থেকে বালু উত্তোলনের ফলে দিনে দিনে মাছ শুন্য হয়ে পড়ছে সোনারগাঁ উপজেলার তীরবর্তী মেঘনা নদী। যারা এক সময় মেঘনা নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতো সেসব জেলেরা মাছ না পেয়ে এখন বাধ্য হয়ে পেশা বদলাতে শুরু করেছেন। আবার কেউ কেউ অনাহারে অর্ধহারে বাপ-দাদার পেশাটাকে আটকে ধরে তিলে তিলে নিঃশ্ব হয়ে যাচ্ছে।

জানা যায়, বিশাল জল রাশির মেঘনা নদীটি উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের মধ্যে বারদী, বৈদ্যেরবাজার, পিরোজপুর ও শম্ভূপুরা ৪টি ইউনিয়নের প্রায় ১২ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে মেঘনা নদীর অবস্থান। মেঘনা নদীকে ঘিরে চারটি উপজেলার কয়েক শত মানুষ মাছ ধরা ও বিক্রির উপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করতো। এক সময় দলবদ্ধভাবে মাছ ধরতে ধরতে বৈদ্যেরবাজার এলাকায় মেঘনা নদীর তীরে একটি বিশাল জেলে পাড়া হিসেবে গড়ে উঠেছে। যাদের বাপ-দাদারা বিভিন্ন এলাকা থেকে এসে এখানে বসতি গড়ে তুলেছেন। বর্তমানে তাদের ছেলে ও নাতিরাও মেঘনা নদীর উপর নির্ভর করে এখানে বসবাস করছেন। এছাড়া বারদী ইউনিয়নের চারদিকে নদীবেষ্টিত নুনেরটেকের মানুষেরও একসময় প্রধান পেশা ছিল মাছ শিকার।

অপরদিকে শম্ভপুরা ইউনিয়নটির দু’পাশ ঘেঁষে মেঘনা নদী প্রবাহমান বিধায় চরকিশোরগঞ্জ এলাকার মানুষও এক সময় মাছের উপর নির্ভর করেই জীবন নির্বাহ করতো। বর্তমানে উপজেলা মৎস্য অফিসের তথ্য অনুযায়ী সোনারগাঁ উপজেলায় মৎস্যজীবির সংখ্যা ১ হাজার ৭৫৮জন। যারা মেঘনা নদী ও বিভিন্ন পুকুরে মাছ চাষে কাজ করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করেন। তবে বর্তমানে মিল কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য, অবৈধভাবে বালু উত্তোলন, সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ সময়ে মা ইলিশ ধরে ইলিশের প্রজজন নষ্ট করার কারণে ও এক প্রকার চায়না চাই জালের ব্যবহারের কারণে দিনে দিনে মাছ শুন্য হচ্ছে মেঘনা নদী। মাছ শুন্য হওয়ার কারণে ও অপ্রয়োজনে তুলনায় কম মাছ পাওয়ার করার কারণে মাছ বিক্রি করে সংসার চালাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে মেঘনা পাড়ের জেলেদের। এতে অনেক জেলে মাছ শিকার ছেড়ে দিয়ে বিভিন্ন কলকারখানা, গার্মেন্ট ও অটোরিক্সা চালানোর মতো পেশা বদলাচ্ছেন।

আরও পড়ুনঃ  ভালুকায় কঠোর অবস্থানে সেনাবাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসন

বৈদ্যেরবাজার মাছ ঘাটের ব্যবসায়ী তপন বর্মন (৬৫) জানান, তিনি যখন বুঝতে শিখেছেন তখন দেখেছেন তার দাদা-বাপ ও চাচারা দিন রাতে মেঘনা নদীতে নৌকা নিয়ে জাল ফেলে মাছ ধরতেন। তারা বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে ২/৩ দিনের জন্য নৌকা ভরে জাল নিয়ে মেঘনা নদীতে যেতেন মাছ ধরতে। ২/৩ পরে বড় বড় রুই, কাতল, বোয়াল ও নৌকা ভর্তি ইলিশসহ বিভিন্ন মাছ নিয়ে বাড়িতে ফিরতো। সেই মাছ তারা বাজারে বিক্রি করে যে টাকা পেতেন সেই টাকা দিয়ে চাল, ডালসহ সংসারের অন্যান্য জিনিসপত্র কিনে নিয়ে আসতেন। তখন মেঘনা নদীর গভীরতা ও আয়তনেও ছিল বিশাল। এপার থেকে দাঁড়ালে ওপারের মানুষ দেখা যেতো না। এখন তিনিও তার বাপ-দাদার পেশাই আকড়ে ধরে আছেন। যদিও এক সময় মেঘনা নদীতে মাছ ধরতেন এখন বয়সের কারণে জাল টানার শক্তি নেই দেহে সে জন্য বৈদ্যেরবাজার মাছ ঘাটে মাছ বিক্রি করেন। তিনি জানান, কয়েক বছর আগেও জেলেরা রাতে নৌকা নিয়ে বেরুতো ভোরে তারা নৌকা বোঝাই করে মাছ নিয়ে ফিরতো। সেই মাছ পাইকারদের মাধ্যমে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় যেতো। এখন আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। সে জন্য জেলেরা হতাশ। তারও আগের মতো ইনকাম নেই কোনো মতে বউ পোলাপান নিয়ে বেঁচে আছেন।

বৈদ্যেরবাজার ঘাটের মাছের আড়ৎদার গাজী জানান, তিনি দীর্ঘদিন যাবত এখানে ব্যবসা করেন। জেলেদের টাকা দিয়ে নৌকা ও জাল কেনার জন্য দাদন দিয়েছেন। জেলেরা মাছ ধরে তার আড়ৎতে নিয়ে আসেন। তখন যা মাছ পান সেগুলোকে ডাকে উঠিয়ে বিক্রি করে তিনি কিছু মাছ রেখে বাকিগুলোর টাকা জেলেদের দিয়ে দেন। তিনি জানান, গত ৮ থেকে ১০ বছর আগেও মেঘনা নদীতে ভরপুর মাছ পাওয়া যেতো। জেলেরা সারারাত মাছ ধরে সকাল বেলা ঘাটে আসতো বড় বড় মাছ নিয়ে। সেই মাছ দেশের বিভিন্ন এলাকার পাইকাররা কিনে নিয়ে যেতো। মেঘনা নদীর মাছ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় সুস্বাধু বিধায় জেলেরা মাছ বিক্রি করে ভালো রোজগার করতো। তখন বৈদ্যেরবাজার ঘাটে প্রতিদিন গড়ে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকার মাছ বেচাকেনা হতো। যা বর্তমানে পুকুরের মাছ মিলিয়েও লাখ ৫ টাকা বিক্রি হয় না। বর্তমানে মেঘনা নদীতে মাছ আগের মতো মাছ নেই।

আরও পড়ুনঃ  ছুটি শেষে জীবিকার নগরে ফিরছে মানুষ

তিনি জানান, মেঘনা নদী ঘেঁষে শিল্প-কারখানা স্থাপন শুরু হওয়ার পর থেকে মাছ প্রজনন কমে গেছে। কোম্পানীর বিষাক্ত বর্জ্য নদীতে ফেলার কারনে মাছ মরে যাচ্ছে। ডিম ছাড়া বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যদিও কোনো মাছ বিষাক্ত এলাকা ছেড়ে অন্য কোথাও ডিম ছেড়ে বাচ্চা উৎপাদন করে সে বাচ্চা মাছগুলো বিষাক্ত পানিতে আসা মাত্র মরে যাচ্ছে। এছাড়া এক ধরনের অসাধু লোভি জেলেরা বেশি মাছ শিকারের কারণে চায়না থেকে আনা এক ধরনের জাল ব্যবহার করে যে জালে একটা একইঞ্চি পরিমান মাছও আটকে যায়। এ জালের কারণে গত কয়েক বছর ধরে ছোট মাছগুলো ধরে বিক্রি করার কারণে নদী মাছ শুন্য হয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে, সরকারি দলের বালু সন্ত্রাসীরা যত্রতত্র ভাবে মেঘনা নদী থেকে বালু উত্তোলনের কারনে ও সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ সময়ে কিছু অসাধু জেলে মাছ ধরার কারনে ইলিশ মাছের প্রজনন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। প্রশাসন থেকে নজরদারি করা হলেও তারা গোপনে জাল ফেলে ছোট ছোট ঝাটকা ইলিশ মাছ ধরে ফেলার কারণেও মেঘনা নদীর টাটকা ইলিশ খ্যাত সুনামটিও এখন আর নেই।

এ ব্যাপারে সোনারগাঁ উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা জেসমিন আক্তার জানান, মাছ প্রজননের জন্য ওয়াটার কোয়ালিটির বিকল্প নেই। একটা মাছ তখনই পরিপূর্ণ মাছ হয়ে বড় হয় যখন সে তার বসযোগ্য পানি পায়। তবে বর্তমানে উপজেলার পাশ ঘেঁষে যে মেঘনা নদীটি বয়ে গেছে সে নদীর অনেক অংশ কোম্পানি দখল করে শিল্প-কারখানা গড়ে তুলেছে। আর সেই শিল্প কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য হরহামেশাই মেঘনা নদীতে ফেলছে।

আরও পড়ুনঃ  সরকারি গাড়ি বলে কথা!

শিল্প কারখানার ফেলা বিষাক্ত বর্জ্য মাছ ধ্বংস করার সবচেয়ে বড় কারণ। আবার এক শ্রেণির বালু উত্তোলনকারীরা যত্রতত্র মেঘনা নদীর যে কোনো অংশে মেশিন ফেলে বালু উত্তোলন করছে। যা মাছের প্রজনন ও বেড়ে উঠার জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ। অপরদিকে, কিছু অসাধু জেলে অতিরিক্ত মাছের আশায় চায়না থেকে আমদানি করা চায়না জাল (যা চায়না চাই জাল বলে চিহিৃত) ও টোনা জাল ফেলে মাছের বাচ্ছাসহ ধরে নিয়ে আসছেন। এতে মাছের প্রজনন ও উৎপাদন দ্রুত কমে যাচ্ছে। এছাড়া ইলিশ মাছ প্রজনন সময়ে সরকার মাছ ধরা নিষিদ্ধ করেন। সে সময়ে জেলেদের জন্য কিছু প্রণোদনার ব্যবস্থা করেন। যা আমার উপজেলায় অত্যন্ত সীমিত। আমার এলাকায় ১ হাজার ৩৬১ জন জেলের বিপরীতে তারা ৫০০ জন জেলে সেই প্রনোদনা পেয়ে থাকেন। এতে বাকি জেলেরা রাতের আঁধারে জাল ফেলে মাছ ধরে হাট-বাজার বাদ দিয়ে বিভিন্ন গ্রাম গঞ্জে চুরি করে বিক্রি করে দেন। নিষিদ্ধ সময়ে আমরা ও নৌ-পুলিশ ও কোষ্টগার্ড মেঘনা নদীতে টহল জোরদার করে আদেশ অমান্যকারি জেলেদের ধরে জেল জরিমানা ও জাল পুড়িয়ে দিচ্ছে।

শুধু নদীতেই নয় আমরা বিভিন্ন হাটে বাজারে ও জালের গোডাউনেও অভিযান চালিয়ে অবৈধ জাল জব্দ করে পুড়িয়ে দেই। তারপর অবৈধ জেলেদের আটকানো মুশকিল হয়ে পড়ে। সে জন্য ধীরে ধীরে মেঘনা নদীতে মাছের প্রজনন ও উৎপাদন দ্রুত কমে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে কিছুদিন পর নদীতে পানি থাকবে মাছ থাকবে না।

সংবাদটি শেয়ার করুন