রবিবার, ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৭ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিলুপ্তির পথে ৫০ সংখ্যালঘুভাষা

বিলুপ্তির পথে ৫০ সংখ্যালঘুভাষা

মাতৃভাষা ধরে রাখার জন্য আমরা নিজেরা বাড়িতে সব সময় আচিক ভাষায় কথা বলি। তবুও আমাদের ভাষা রক্ষা করা যাচ্ছে না। বাংলার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। নিজ বাড়ি ছাড়া কোথাও মাতৃভাষা ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছি না

– মার্জিনা চিসিম, সহকারী শিক্ষিকা, ভূটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

আজ ২১ ফেব্রুয়ারি। ১৯৫২ সালের এইদিনে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পেয়েছিল বাঙালি জাতি। রাষ্ট্র ভাষার জন্য যারা জীবন দিয়েছেন তাদের স্মরণে দিনটি শহীদ দিবস হিসেবে পরিচিত। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেও দিনটি পালিত হয়। যথাযোগ্য মর্যাদায় সারাদেশে দিবসটি পালিত হচ্ছে। ধর্ম-বর্ণ সব শ্রেণির মানুষ রাষ্ট্রভাষা বাংলাকে শ্রদ্ধা করে থাকে। বাঙালিরা ভাষা শহীদদের অমর করে রেখেছে। বাংলা ভাষার পাশাপাশি দেশে আরও ৫০টির মতো ভাষা রয়েছে। বাংলা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা থাকলেও তাদের নিজস্ব মাতৃভাষার ব্যবহারের সুযোগ চান সংখ্যলঘুভাষীরা। বিশেষ করে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বা আদিবাসীদের মাতৃভাষার প্রয়োগের সুযোগ না থাকায় তাদের অন্তত ৫০টি ভাষা হারিয়ে যেতে বসেছে।

সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী তথা আদিবাসীরা। টাঙ্গাইলের মধুপুরেও রয়েছে তারা। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মধুপুর অঞ্চল থেকে ক্রমেই ‘আচিক বা মান্দি ও কোচ ভাষা’ হারিয়ে যাচ্ছে। আদিভাষীদের মাতৃভাষা রক্ষার জন্য সরকারি-বেসরকারি কোনো পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় এ অবস্থা হচ্ছে বলে আদিবাসীদের দাবি। এ ভাষা রক্ষার জন্য তাদের শিশুদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। সম্প্রতি মধুপুর গড়ের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, স্কুল পড়ুয়া শিশুরা অধিকাংশই তাদের মাতৃভাষা ভালোভাবে জানে না। কেউ কেউ নিজ বাড়িতে বাবা মায়ের মুখে শুনে এ ভাষা সর্ম্পকে কিছুটা বুঝতে শিখলেও তারা আচিক বা মান্দি ভাষায় উত্তর দিতে পারে না।

আরও পড়ুনঃ  মেহেরপুরের নাইটিঙ্গেল রোজ

অথচ একটা সময় ছিল যখন এ অঞ্চলের আদিবাসীরা আচিক বা মান্দি ভাষা ছাড়া অন্য কোন ভাষা জানতো না। কিন্তু জীবন জীবিকার তাগিদে বনের গারোরা এসেছে তাদের আশেপাশে বাঙালি প্রধান এলাকায়। এভাবে এক সময় নিজ এলাকাতেই আদিবাসী গারোরা পরিণত হয়েছে ‘সংখ্যালঘু উপজাতিতে’। গারো শিক্ষার্থীদের স্কুলে লেখাপড়া ও কর্মজীবনে অফিস আদালতসহ সকল কাজ কর্মেই তাদের বাংলা ব্যবহার করতে হয়। ফলে তাদের মাতৃভাষার চর্চা কমে যাচ্ছে।

এ অঞ্চলের আদিবাসীরা জানান, আচিক বা মান্দি বা কোচ ভাষার লিখিত কোনো বর্ণমালা নেই। কথিত আছে দুর্ভিক্ষ পীড়িত দেশ তিব্বত অঞ্চল ত্যাগ করে গারোরা যখন ভারতীয় উপমাহাদেশে আসছিলেন তখন একজনের কাছে পশু চামড়ায় লিখিত আচিক ভাষার পুঁথি-পুস্তকাদি ছিল। পথে ক্ষুধার জ্বালায় সব পুঁথি পুস্তক সিদ্ধ করে খেয়ে ফেলেন। বিষয়টা তিনি গোপন করেন। পরবর্তীতে এই উপমহাদেশে আগমন ও বসতি স্থাপনের দীর্ঘদিন পরে ঘটনাটি প্রকাশ পায়। কিন্তু ততদিনে গারো বর্ণমালা বিস্মৃতির অতল গর্ভে হারিয়ে যায়। কারণ এই উপমহাদেশে প্রবেশের পর নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা এবং স্থায়ী বাসযোগ্য স্থান নির্বাচনের জন্য দীর্ঘদিন প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ করে অভিজ্ঞ গারোরা প্রাণ হারান। ফলে আচিক ভাষার বর্ণমালা চিরতরে হারিয়ে যায়। তবে বর্ণমালা হারিয়ে গেলেও গারোদের মুখে মুখে আচিক ভাষা প্রচলন ছিল।

উপজেলার ভূটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দেখা যায়, শতকরা তিরিশ শতাংশ শিশুই আদিবাসী। সরকার স্কুলটিতে তিনজন গারো শিক্ষকের কোটাও রেখেছেন। মার্জিনা চিসিমের মতো গারো শিক্ষিকাদের সঙ্গে আদিবাসী শিশুদের অন্যরকম মিতালি। স্কুলে ভর্তি বা শিক্ষক উভয় সুবিধা পাচ্ছে এসব শিশুরা। তবে নেই ওদের মায়ের ভাষায় পাঠ্য। পরিবারের সাথে মনখুলে ওরা কথা বলে অচিক বা মান্দি ভাষায়। কিন্তু স্কুলে এসে পড়তে হয় বাংলা ভাষায়। যদিও শিশুরা সরকারিভাবে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত আচিক ভাষায় পাঠ্য পেয়েছে তবে এতোটুকু যথেষ্ট না। ওদের মাতৃভাষার চর্চার জন্য নুন্যতম পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্য চায় অচিক ভাষায়।

আরও পড়ুনঃ  মাগুরায় মিনিস্টারের নতুন শো-রুম উদ্বোধন

ভূটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা মার্জিনা চিসিম বলেন, মাতৃভাষা ধরে রাখার জন্য আমরা নিজেরা বাড়িতে সব সময় আচিক ভাষায় কথা বলি। কিন্তু তবুও আমাদের ভাষা রক্ষা করা যাচ্ছে না। বাংলার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। নিজ বাড়ি ছাড়া কোথাও আমরা আমাদের মাতৃভাষা ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছি না।

মধুপুরের গারো অন্তর্ভুক্ত বাগাছাস কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি জন যেত্রা জানান, আমরা বাংলা ভাষাকে শ্রদ্ধা করি। বাংলা আমাদের রাষ্ট্রভাষা। আমরা দিবসটিকেও সম্মান জানাই। তবে সংখ্যা লঘু ভাষাগুলোকেও যথাযথ স্বীকৃতি দেওয়া দরকার। আমাদের মান্দি ও আচিক ভাষা ক্রমশ হারানো যাচ্ছে। আমরা রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পেলেও আমাদের মাতৃভাষার স্বীকৃতি পাইনি। বাড়িতে মাতৃভাষার প্রয়োগ অথচ বাড়ির বাইরে মাতৃভাষার প্রয়োগ করতে পারি না। এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ ভাষার ব্যবহার না থাকায় আমাদের পরবর্তী প্রজন্মও এ ভাষা ভুলে যাচ্ছে। এ ভাষাকে টিকিয়ে রাখতে সরকারি স্বীকৃতি চায় আদিবাসীরা।

বাংলাদেশ কোচ আদিবাসী ইউনিয়ন মধুপুর শাখার সাধারণ সম্পাদক নারায়ন চন্দ্র কোচ জানান, আমাদের কোচ ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। বাংলা ভাষার পাশাপাশি আমাদের মাতৃভাষার স্বীকৃতি ও প্রয়োগ ব্যবস্থা করলে এ ভাষাকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব।

জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ইউজিন নকরেক জানান, তাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে ২০০৮ সালে গড় এলাকায় ১২টি স্কুল চালু করা হয়েছিল। যেখানে গারো শিশুদের আচিক ভাষায় শিক্ষা দেওয়া হতো। কিন্তু তিন বছর চলার পর দাতা সংস্থার অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ায় তা বন্ধ হয়ে যায়। ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষা নীতিমালায় শিশুদের তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত মাতৃভাষায় শিক্ষা ব্যবস্থা চালুর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে আগামী প্রজন্ম অচিক ভাষা নিয়ে শঙ্কায়। তিনি আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান।

আরও পড়ুনঃ  দক্ষিণ কোরিয়ার ইস্পাত শিল্পে ধস

এছাড়া আদিবাসী ফোরামের যুব বিষয়ক সম্পাদক রুপচান বর্মন, বানাই কমিউনিটির রিপন চন্দ্র বানাই, সাধারণ সম্পাদক, টি.ডব্লিউ.এ, ফুলপুর উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক প্রশান্ত কুমার সিংহ (হদি) ও হাজং ছাত্র সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আশিষ হাজংও তাদের মাতৃভাষার স্বীকৃতির দাবি জানান।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন