ঢাকা | শনিবার
২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ঘন ঘন ভূমিকম্প কি বড় আঘাতের আভাস

ঘন ঘন ভূমিকম্প কি বড় আঘাতের আভাস

দেশে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ১০টি হালকা ও মাঝারি ধরনের ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। সর্বশেষ সোমবার (০৩ অক্টোবর) রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ৫ দশমিক ২ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হেনেছিলো। যার উৎপত্তিস্থল ছিল ভারতের আসাম থেকে ২৪ কিলোমিটার দূরে গোয়ালপাড়ায়।

দেশে যেসকল ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে তার মধ্যে দুটির মাত্রা ছিল পাঁচের ওপরে। এ ধরনের ভূমিকম্প সাধারণত ১০ বছরে তিনবার হয়ে থাকে। ফলে বড় ধরনের ভূমিকম্পের আভাস দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ছাড়া ৫ মাত্রার ওপরের ভূমিকম্প দেশের জন্য আশঙ্কার বলেও জানিয়েছেন তাঁরা।

গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে এক গবেষণায় দেখা গেছে, টাঙ্গাইলের মধুপুর ফল্টে (টেকটনিক ফল্ট) দিনের বেলা ৬ দশমিক ৯ মাত্রার একটি ভূমিকম্প সংঘটিত হলে রাজধানীতে কমপক্ষে ৮ লাখ ৬৪ হাজার ৬১৯ ভবন ধসে পড়তে পারে। প্রাণ হারাতে পারে ২ লাখ মানুষ। অন্যদিকে সিলেটের ফল্ট লাইনে দিনের বেলা ৭ দশমিক ১ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হলে কমপক্ষে ৪০ হাজার ৯৩৫ ভবন ধসে পড়তে পারে। ১৬ হাজার মানুষের মৃত্যু হতে পারে।

ভূমিকম্প নিয়ে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, এমন ছোট ছোট ভূমিকম্প মূলত বড় শক্তি নিয়ে ভূমিকম্প হওয়ার প্রাথমিক ধাপ। এই অঞ্চলে বড় ভূমিকম্পের শক্তি সঞ্চিত হয়ে আছে। আর বড় কোনো কিছু হলে আগে ছোট কিছু বিষয় ধরা পড়ে। বাংলাদেশ তিনটি (টেকটনিক) প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত। এসব অংশে শক্তি জমা আছে, সেটা যদি একসঙ্গে বের হয়, তাহলে ৮ দশমিক ২ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প আঘাত হানে ১৮৯৭ সালে। ৮ দশমিক ৩ মাত্রার ওই ভূমিকম্পে ঢাকা, সিলেট, ময়মনসিংহ ও রংপুর শহরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়েক নামে পরিচিত এ ভূমিকম্পে মারা যান প্রায় দেড় হাজার মানুষ। চলতি বছর দুইবার পাঁচ মাত্রার বেশি শক্তিশালী ভূমিকম্প হয়েছে। যা সাধারণত ১০ বছরে তিনবার হয়ে থাকে। এই দুই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল সিলেটের ডাউকি ফল্ট। এই ফল্টে সবচেয়ে বড় মাত্রার ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয় ২০০৩ সালের ২৬ জুলাই। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৬।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে প্রায় ২০টি ছোট ও মাঝারি মানের ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। চলতি বছরের প্রথম আট মাসে আঘাত হানা ৭টি ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল বাংলাদেশ। এর মধ্যে আগস্টের ৯ দিনেই আঘাত হানে তিনটি। এগুলোর উৎপত্তিস্থল ছিল নারায়ণগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও ঢাকা। আর এর বাইরের বেশির ভাগের উৎপত্তিস্থল ছিল সিলেট সীমান্ত কেন্দ্রিক। এ নিয়ে বুয়েট সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ১০ বছরের মধ্যে গত এক বছরেই দেশের ভেতরে ২৫টি আর দেশের আশেপাশে অঞ্চলে প্রায় ৫০টি ভূমিকম্প হয়েছে। ভূমিকম্পের কম্পন বা ভয়াবহতার মাত্রা নির্ভর করে গভীরতার ওপরে। সিলেটে উৎপত্তিস্থল ছিল যে ভূমিকম্পের সেটির গভীরতা ছিল ১৬ কিলোমিটার আর টাঙ্গাইলেরটির ছিল ১০ কিলোমিটার। তিনি বলেন, ‘১৮৭০ থেকে শুরু করে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত দেশে ৭ দশমিক ৫ ও ৮ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। ভূমিকম্পের রিটার্ন পিরিয়ড ধরা হয় ১৫০–২৫০ বছর। ফলে দেশে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা আছে। তবে এই ভূমিকম্প ঠিক কোন সময়ে হবে, তা নিশ্চিত নয়। সাধারণত প্রতি ১০০ থেকে ১৫০ বছর পর এমন ভূমিকম্প হয়।

পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ভেতরে ও সীমান্তের কাছাকাছি ৫টি ফল্ট জোন (ভূ–চ্যুতি অঞ্চল) সক্রিয় আছে। এগুলো হলো— বগুড়া ফল্ট জোন, ত্রিপুরা ফল্ট জোন, ডাউকি ফল্ট জোন, আসাম ফল্ট জোন এবং শিলং মালভূমি ফল্ট জোন। এর মধ্যে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক হতে পারে ডাউকি ফল্ট জোন। ভূতত্ত্ববিদেরা বলছেন, ঢাকায় গত কয়েক বছরের মধ্যে যেসব ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে, সেগুলোর অধিকাংশের উৎপত্তিস্থলই ছিল বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে সিলেট বা চট্টগ্রাম অঞ্চলে। অনেকগুলো ভূমিকম্পের কেন্দ্র ছিল ভারতের মিজোরাম বা ত্রিপুরা রাজ্য।

ঢাকায় মোট ভবন নিয়ে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) ২০২২ সাল পর্যন্ত সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় ২১ লাখ ৪৭ হাজার ২১৯টি। এর মধ্যে পাকা ভবন ৫ লাখ ১৩ হাজার ৬০৭টি। আর নির্মাণাধীন ২০ হাজার ৩২টি।

নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন ভূমকম্প হবে ধরে নিয়ে আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। প্রথম ধাপ হচ্ছে, ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড ও কাঠামোগত যেসব দিক নির্দেশনা আছে—তা মেনে ভবন নির্মাণ করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজের অধ্যাপক ড. খোন্দকার মোকাদ্দেম হোসেন বলেন, দেশে মাত্র ৩ শতাংশ ভবন ভূমিকম্প সহ্য করতে পারবে। নজরদারির অভাব ও বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের সমন্বয়হীনতা ঢাকায় দিন দিন ভয়াবহ ঝুঁকি তৈরি করছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ডা. মো এনামুর রহমান জানান সম্প্রতি তুরস্ক, সিরিয়া, আফগানিস্থানের ভূমিকম্পের মাত্রা ও প্রাণহানি দেশের মানুষের মধ্যে এক ভীতি তৈরি করেছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশে ভূমিকম্প মোকাবিলায় সরকার এখন জনসচেতনতার চেয়ে অবকাঠামোগত বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দিওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, তিনটি বিষয় মাথায় রেখে আগানো হচ্ছে। এক, পুরোনো ভবন ভেঙে ফেলা হবে। মালিকদের সহজ শর্তে বা বিনা সুদে ঋণ দিয়ে নতুন ভবন নির্মাণ করা হবে। দুই, যেগুলো ভবন আছে তা পরীক্ষা করে রেট্রোফিটিং করা হবে। তিন, নতুন ভবন বিধিমালা মেনে করতে হবে। মন্ত্রণালয় এখন জাপানের মতো ভূমিকম্প সহনশীল দেশ বানাতে জাইকার সঙ্গে কাজ করছে।

সংবাদটি শেয়ার করুন