“বারির বিজ্ঞানীরা কৃষিতে আধুনিক-টেকসই প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটাচ্ছেন। চাষিরা আরো বেশি আস্থা-নির্ভরতার সঙ্গে ভাসমান বেড পদ্ধতিতে সবজি উৎপাদন বাড়িয়ে চলেছেন। ফলে প্লাবনভূমিতেও বেশি উৎপাদন হচ্ছে। লাভবান হচ্ছেন চাষিরা”।
‘বারি উদ্ভাবিত উফশী বীজ ও প্রযুক্তি মাঠ পর্যায়ে পৌঁছলে, দেশ কৃষিতে আরও এগিয়ে যাবে। পাশাপাশি রপ্তানি বাজারও সম্প্রসারণের সুযোগ পাবে”।
ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াশ’,‘অশণি’ ও ‘সিত্রাং’ এর মতো একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে লড়াই করে বরিশাল কৃষি অঞ্চলের ১১ জেলার কৃষি যোদ্ধারা এবারো সবজি আবাদ এবং উৎপাদনে বিশেষ অবদান রাখছে। দেশে উৎপাদিত প্রায় ২ কোটি টন শীত ও গ্রীষ্মকালীন সবজির প্রায় ২০ লাখ টনই আসছে দক্ষিণাঞ্চলের ১১ জেলা থেকে। গত মাসের ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং এ ভর করে নজিরবিহীন প্রবল বর্ষণের পরেও এবার দক্ষিণাঞ্চলে প্রায় ৭০ হাজার হেক্টরে ১৫ লাখ টন শীতকালীন সবজি উৎপাদনের লক্ষ্যে মাঠে মাঠে কাজ করছেন দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি যোদ্ধারা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) দায়িত্বশীল মহল লক্ষ্য অর্জনে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। তবে এজন্য প্রয়োজন প্রকৃতির সহায়তা। চলতি মাসে যদি বড় ধরণের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হানা না দেয় তবে সারাদেশের মতো দক্ষিণাঞ্চলেও সবজি উৎপাদন লক্ষ্য অর্জন নিয়ে কোন সংশয় নেই বলে মনে করছেন ডিএই’র দায়িত্বশীল মহল। পর্যায়ক্রমে আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে নিকট অতীতেও দেশের পশ্চিমাঞ্চলের সবজির ওপর নির্ভরতা কাটিয়ে উঠছে দক্ষিণাঞ্চল।
গত দেড় দশকে দক্ষিণাঞ্চলে সবজির আবাদ ও উৎপাদন বেড়েছে তিনগুনেরও বেশি। কৃষিবিদদের মতে, ‘বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল ও উন্নতমানের সবজি বীজসহ আবাদ প্রযুক্তি মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের কাছে পৌঁছলে উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণে সম্ভব হবে। এমনকি খোলা মাঠে ও বাড়ির আঙিনার পাশাপাশি সাম্প্রতিককালে পতিত জমিতেও সবজির আবাদ বাড়ছে। আর দক্ষিণাঞ্চলসহ দেশের অনেক এলাকায় আবাদকৃত সবজির বীজ ও চারার যোগান হচ্ছে বরিশাল ও পিরোজপুরের ‘ভাসমান বেড’ থেকে।
যুগের পর যুগ ধরে বানরীপাড়া,উজিরপুর এবং পিরোজপুরের নাজিরপুর ও সদর উপজেলার কিছু অংশে কচুরীপানার ঢিবি তৈরি করে তার ওপর শীতকালীন সবজি সহ বিভিন্ন ফসলের চারা তৈরি হচ্ছে। এ অঞ্চলের কৃষকদের উদ্ভাবিত সনাতন ও লাগসই প্রযুক্তির সারজন পদ্ধতিতে বিভিন্ন সবজির চারা তৈরি করে জলাবদ্ধ বিশাল এলাকার মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থাসহ কৃষি-অর্থনীতি অনেকটাই সচল রয়েছে।
আর এ অঞ্চলে ভাসমান বেডে উৎপাদিত এসব সবজি চারা শুধু দক্ষিণাঞ্চলই নয় সারাদেশের শীতকালীন ও গ্রীষ্মকালীন সবজি উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে বলে দাবি ডিএই’র দায়িত্বশীল মহলের। চলতি রবি মৌসুমে দক্ষিণাঞ্চলের ১১ জেলায় প্রায় ৭০ হাজার হেক্টরে শীতকালীন সবজির আবাদ হচ্ছে। উৎপাদন লক্ষ্য রয়েছে প্রায় ১৫ লাখ টন।
এবার ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’এ ভর করে কার্তিকের নজিরবিহীন প্রবল বর্ষণে দক্ষিণাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকার আগাম শীতকালীন সবজিসহ অন্যান্য ফসলের ব্যাপক ক্ষতির পরেও কৃষি যোদ্ধারা পুনরায় রবি ফসল আবাদে মাঠে নেমেছেন। এছাড়া বিভিন্ন বাড়িঘরের আঙিনায়ও বিপুল পরিমাণ সবজির আবাদ হচ্ছে। অগ্রহায়ণের অকাল বর্ষণে দক্ষিণাঞ্চলে শতাধিক কোটি টাকার ফসল বিনষ্ট হওয়ায় কৃষকরা মারাত্মক ধাক্কা খেলেও সে ধকল কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। ফলে শীতকালীন সবজির উৎপাদন ১৫ লাখ টন অতিক্রম করতে পারে বলেও আশাবাদী ডিএই।
সূত্রমতে, দেশে রবি ও গ্রীষ্ম মৌসুমে ১০ লাক্ষাধিক হেক্টর জমিতে আবাদের মাধ্যমে ২ কোটি টনেরও বেশি সবজি উৎপাদন হচ্ছে। এরমধ্যে শুধু দক্ষিণাঞ্চলের ১১ জেলাতেই প্রায় ৭০ হাজার হেক্টরে শীতকালীন সবজি আবাদ হচ্ছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের লক্ষ্য অনুযায়ী হেক্টর প্রতি ২০ দশমিক ৬৪ টনের মতো উৎপাদন হলে এবারো প্রায় ১৫ লাখ টন শীতকালীন সবজি উৎপাদন হবার ব্যাপারে আশাবাদী ডিএই’র দায়িত্বশীল মহল।
শীতকালীন সবজি ছাড়াও প্রায় ৩৬ হাজার হেক্টরে গ্রীষ্মকালীন সবজি আবাদের মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলে আরো প্রায় ৫ লাখ টন শাক-সবজি উৎপাদন হয়ে থাকে। ফলে দেশে উৎপাদিত ২ কোটি টন শাক-সবজির প্রায় ২০ লাখ টনের যোগান দিচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের ১১ জেলার কৃষিযোদ্ধারা। ইতোমধ্যে লালশাক, পালংশাক, সিম, ফুলকপি, বাধা কপি, শালগম, গাজর ও মূলাসহ বিভিন্ন ধরণের আগাম শীতকালীন সবজি বাজারে এসেছে।
তবে এর বাইরে সাম্প্রতিক প্রবল বর্ষণের ধকল কাটিয়ে লাউসহ বেশ কিছু বারমাসি সবজিও বাজারে রয়েছে। এবার অগ্রহায়ণের অকাল বর্ষণের রেশ ধরে বাজারে সব ধরনের সবজির দাম গত কয়েক বছরের তুলনায় কিছুটা বেশি। কৃষকরা এবার কিছুটা বেশি দাম পেলেও অগ্রহায়ণের বর্ষণে যে ক্ষতি হয়েছে, তা কাটিয়ে ওঠার বিষয়টি এখনো নিশ্চিত নয়।
ডিএই’র দায়িত্বশীল সূত্রের মতে, দেশে গত বছর প্রায় ১ কোটি ৯৮ লাখ টনের মতো শীতকালীন সবজি উৎপাদন হয়েছে। দেশে উৎপাদিত সবজি ‘অভ্যন্তরীণ পূর্ণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে বলে আশা করছে কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্র। ডিএইর মতে বর্তমানে ‘বিশ্বের প্রায় ১১৪টি দেশে বাংলাদেশের কৃষি পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। এরমধ্যে শীতকালীন সবজিই অন্যতম। এ বাজার আরো সম্প্রসারণে সরকার দেশে সবজি আবাদ বৃদ্ধিতে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে বলেও জানিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
এদিকে বারির মাঠ পর্যায়ে গবেষণা কার্যক্রমের মাধ্যমে অন্যসব ফসলের মতো বিভিন্ন ধরণের শীতকালীন সবজিরও উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে। এমনকি বরিশালের বিভিন্ন এলাকায় যে ভাসমান ঢিবিতে সবজি বীজসহ বিভিন্ন ফসল আবাদ হচ্ছে, বারির বিজ্ঞানীরা সে ক্ষেত্রেও আধুনিক ও টেকসই প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটাচ্ছেন। ফলে কৃষকরা আরো আস্থা এবং নির্ভরতার সঙ্গেই ভাসমান বেড পদ্ধতিতে সবজি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে মনযোগী হচ্ছেন। এর ফলে প্লাবন ভূমিতে অধিক ফসল উৎপাদনও সম্ভব হচ্ছে। এতে করে কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন।
তবে মাঠ পর্যায়ে বারি উদ্ভাবিত উন্নত বীজসহ অনেক প্রযুক্তিরই কাঙ্ক্ষিত সম্প্রসারণ ঘটছে না। অথচ বারি উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল বীজ ও আবাদ প্রযুক্তি মাঠ পর্যায়ে কৃষকের কাছে পৌঁছলে, দেশ কৃষিতে আরো এগিয়ে যাবার পাশাপাশি রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণেরও সুযোগ ঘটবে বলে মনে করছেন কৃষিবিদরা।