শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৫ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

প্রেমের কারণে বেশি আত্মহত্যা

প্রেমের কারণে বেশি আত্মহত্যা
  • ৮ মাসে আত্মহত্যা ৩৬৪ শিক্ষার্থীর
  • এগিয়ে কিশোরীরা

দেশে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বাড়ছে। সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার কারণ প্রেম। তা ছাড়া অভিমান, সেশনজট, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া, পড়াশোনার চাপ, পরিবার থেকে কিছু চেয়ে না পাওয়া, কলহ, ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি, চুরি বা মিথ্যা অপবাদ, মানসিক সমস্যা ইত্যাদি। আরো রয়েছে মানসিক ভারসাম্যহীনতা, বিষণ্নতা, বন্ধুর মৃত্যু, আর্থিক সমস্যার মত বিষয়াবলীও।

আঁচল ফাউন্ডেশন নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাসের একটি জরিপে এ তথ্য জানা যায়। গতকাল শুক্রবার অনলাইনে আঁচল ফাউন্ডেশনের সংবাদ সম্মেলনে এ প্রতিবেদনটি তুলে ধরা হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, নারায়ণগঞ্জ জেলার এডিসি (শিক্ষা ও আইসিটি ডিভিশন) আজিজুল হক মামুন এবং আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ।

জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাসের মধ্যে ৩৬৪ জন আত্মহননের পথ বেছে নেয় যারা তাদের জীবদ্দশায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত ছিলেন। এদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুল, মাদ্রাসা, নার্সিং প্রভৃতি বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার্থী রয়েছেন। ৩৬৪ জন আত্মহত্যাকারীর মধ্যে ১৯৪ জনই ছিলেন স্কুলগামী শিক্ষার্থী। দ্বিতীয় অবস্থানে ছিলেন কলেজ শিক্ষার্থীরা যার সংখ্যা ৭৬ জন। অপরদিকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহননকারীর সংখ্যা ৫০ জন। তবে মোট আত্মহননকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাদ্রাসায় অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীও ছিলেন ৪৪ জন।

প্রাপ্ত উপাত্ত অনুসারে, সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ২৫.২৭ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রেমঘটিত কারণে নিজের জীবন বিকিয়ে দেন।  অভিমান করে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন ২৪.৭৩ শতাংশ। পরিবারের সাথে চাওয়া পাওয়ার অমিল হওয়ায় ৭.৪২ শতাংশ এবং পারিবারিক কলহের কারণে ৬.৫৯ শতাংশ আত্মহত্যা করেছেন। অন্যদিকে ধর্ষণ কিংবা যৌন হয়রানির কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় ৪.৬৭ শতাংশ।

আরও পড়ুনঃ  ক্ষুধায় কাতরাতে কাতরাতে বৃদ্ধের মৃত্যু, এগিয়ে আসেনি কেউ

মানসিক সমস্যার কারণে ৬.৫৯ শতাংশ। তা ছাড়া পড়াশোনার চাপে ০.৮২ শতাংশ, সেশনজটের কারণে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে ০.৮২ শতাংশ এবং পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ায় ১.৯২ শতাংশ আত্মহননের দিকে এগিয়ে যান। ১.৬৫ শতাংশ চুরির মিথ্যা অপবাদে, ১.৯২ শতাংশ আর্থিক সমস্যায়, ০.৫৫ শতাংশ বন্ধুর মৃত্যুতে বিষাদগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করেছেন। এছাড়াও বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় এবং স্বামী পছন্দ না হওয়ায় ১.১০ শতাংশ। তবে ১৫.৯৩ শতাংশের আত্মহননের কারণ জানা যায়নি।

সমীক্ষায় উঠে আসে আট মাসে মোট আত্মহননকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫০ জন ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী, যাদের মধ্যে পুরুষ শিক্ষার্থী ৬০ শতাংশ এবং নারী শিক্ষার্থী ৪০শতাংশ। কলেজপড়ুয়াদের মধ্যে ৭৬ জন এই পথ বেছে নেয় যাদের মাঝে ৪৬.০৫ শতাংশ পুরুষ এবং ৫৩.৯৫ শতাংশ নারী। সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ১৯৪ জন স্কুলগামী শিক্ষার্থী বিগত আট মাসে আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হয়েছে। তাদের মধ্যে ৩২.৯৯ শতাংশ পুরুষ এবং ৬৭.০১ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী। এমনকি মাদ্রাসায় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও আত্মহত্যার মাধ্যমে জীবনাবসানের পথ বেছে নিয়েছে যা সংখ্যায় ৪৪ জন।

তাদের মধ্যে ৩৯.২৯ শতাংশ পুরুষ এবং ৬০.৭১ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী।

বিভাগ অনুযায়ী আত্মহত্যা: আত্মহত্যাকারীদের অবস্থান বিবেচনায় সবার শীর্ষে রয়েছে রাজধানী ঢাকা। আত্মহননকারীদের মধ্যে ঢাকায় গত ৮ মাসে শতকরা ২৫.২৭ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন। চট্টগ্রামে ১৬.৪৮ শতাংশ, খুলনায় ১৪.০১ শতাংশ রংপুরে ৮.৭৮ শতাংশ, বরিশালে ৯.৬২ শতাংশ, ময়মনসিংহে ৭.৪২ শতাংশ, রাজশাহীতেগ ১৪.০১ এবং সিলেট বিভাগে ৪ শতাংশ।

স্কুলগামীরা এগিয়ে

আরও পড়ুনঃ  করোনায় প্রকাশনা শিল্পে ক্ষতি ৫০০ কোটি

শিক্ষাস্তর বিবেচনায়, বিদ্যালয়গামী অর্থাৎ প্রাইমারি থেকে মাধ্যমিক পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রী আত্মহত্যা করেন ৫৩.৩০ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে কলেজশিক্ষার্থীরা ২০.৮৮ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ১৩.৭৪ শতাংশ, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের ১২.০৯ শতাংশ।

এগিয়ে নারীরা

আত্মহত্যায় এগিয়ে আছে নারী শিক্ষার্থীরা। এই হার ৬০.৭১ শতাংশ বা ২২১ জন। পুরুষ শিক্ষার্থীদের ৩৯.২৯ শতাংশ বা ১৪৩ জন।

বয়সভিত্তিক আত্মহত্যার হার

১৩ থেকে ২০ বছর বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা সর্বাধিক লক্ষণীয় যা ৭৮.৬ শতাংশ। বয়সের সীমারেখায় যারা ২১ থেকে ২৬ বছর বয়সী, তাদের মধ্যে ১৩.৪৬ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহননের পথ বেছে নেন। জরিপ থেকে আরও জানা যায়, ১৩ বছরের নিচে যাদের বয়স, তারাও এই পথ থেকে পিছপা হয়নি। ৬ থেকে ১২ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৭.৯৭ শতাংশ অর্থাৎ ২৯ জন আত্মহত্যা করেন। তবে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেন ১৪ – ১৬ বছর বয়সীরা, যার সংখ্যা ১৬০ জন। এছাড়াও সর্বনিম্ন সাত বছরের একটি শিশুও আত্মহত্যা করেন বলে আমাদের তথ্যে উঠে এসেছে।

শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা প্রতিরোধ ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আঁচল ফাউন্ডেশনের ১০ দফা প্রস্তাবনা দিয়েছে।

১. আত্মহত্যা মোকাবেলায় বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন।

২. পাঠ্যপুস্তকে মানসিক শিক্ষাকে এবং মনের যত্নের কৌশলগুলোকে শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা।

৩. স্কুল-কলেজের অভিভাবক সমাবেশের আলোচিত সূচিতে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য ও আত্মহত্যা সম্পর্কিত এজেন্ডা রাখতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা প্রদান।

৪. মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও আত্মহত্যা প্রতিরোধে সব ধরণের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করা।

আরও পড়ুনঃ  পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বাসিন্দাদের উচ্ছেদ শুরু

৫. প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদেরকে প্রাথমিক মানসিক স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রদান।

৬. সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ বৃদ্ধি ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা

৭. মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলো দ্বারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভ্রাম্যমাণ ক্যাম্পেইন পরিচালনা করা।

৮. হতাশা, আপত্তিকর ছবি, আত্মহত্যার লাইভ স্ট্রিমিং, জীবননাশের পোস্ট ইত্যাদি চিহ্নিত করতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিশেষ টুলস ব্যবহার করা।

৯. আত্মহত্যার ঘটনায় পরিবার ও পরিচিতজনদের দায় অনুসন্ধানে আইনি বাধ্যবাধকতা থাকা।

১০. মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দ্রুত ও সহজলভ্য করতে একটি টোল ফ্রি জাতীয় হট লাইন নম্বর চালু করা।

সংবাদটি শেয়ার করুন