মঙ্গলবার, ১৭ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২রা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
ঋতু রানি---

বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ

বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ

ঋতু বৈচিত্র্যের অনন্য লীলাভূমি আমাদের এই সবুজ বাংলা। প্রত্যেক ঋতু তার আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়ে ধরা দেয় প্রকৃতিতে। ষড়ঋতুর দেশ আমাদের এই সোনার বাংলাদেশ। প্রতিটি ঋতু স্বতন্ত্র  বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। শরতের  প্রকৃতি অপরূপ সাজে সজ্জিত হয়। শরতের প্রকৃতির স্নিগ্ধ শান্তরূপ সকলকেই আকৃষ্ট করে। বর্ষা যখন যাই যাই করে তখন বাংলাদেশের প্রকৃতির শরতের আগমনের আয়োজন চলতে থাকে। নিঃশব্দ চরণে সে যে কখন এসে হাজির হয় তা কেউ টেরই পায় না।

ভোরে ঘুম থেকে উঠে যখন দেখতে পাই, শিশিরসিক্ত দূর্বাঘাসের উপর সূর্য কিরণ পড়ে ঝিকিমিকি করে তখন আমাদের আর কোনো সন্দেহ থাকে না যে শরৎ এসেছে। বাংলাদেশে শরৎকাল সামান্য কিছুদিন স্থায়ী হয়। এ অল্প সময়েই প্রকৃতিতে নিয়ে আসে নতুন ছন্দ, নতুন সৌন্দর্য।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শরৎ নিয়ে প্রচুর কবিতা-গান রচনার মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। তিনি তাঁর একটি কবিতায় বলেছেন—

“শরৎ, তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি

ছড়িয়ে গেল ছাড়িয়ে মোহন অঙ্গুলি

শরৎ, তোমার শিশির-ধোয়া কুন্তলে

বনের পথে লুটিয়ে পড়া অঞ্চলে

আজ প্রভাতের হৃদয় ওঠে চঞ্চলি

ভাদ্র-আশ্বিন এ দু’মাস শরৎ ঋতু। শরতের আগমনে বাংলার প্রকৃতি থাকে নির্মল স্নিগ্ধ। শরৎ কালের রাতে জ্যোৎস্নার রূপ বড় অপরূপ। মেঘমুক্ত আকাশে যেন জ্যোৎস্নার ফুল ঝরে। চাঁদের আলোর শুভ্রতায় আকাশ থেকে রুপকথার পরীরা ডানা মেলে নেমে আসে পৃথিবীতে। সোনা ঝরা রোদ,  উত্তরে শিমুলের তুলোর মতো ভেসে চলা সাদা মেঘের ভেলা, নদীর ধারে মৃদু মন্দ বাতাসে দোল খাওয়া সাদা সাদা কাশফুল, ছোট ছোট ঢেউ তুলে নদীতে পাল তুলে চলা নৌকা, আঁধারের বুক চিরে উড়ে বেড়ানো জোনাকীরা,  শিউলী, কামিনী, হাসনাহেনা, দোলনচাঁপা, বেলী, ছাতিম, বরই, শাপলা, জারুল, রঙ্গন, টগর, রাধাচূড়া, মধুমঞ্জুরি, শ্বেতকাঞ্চন, মল্লিকা, মাধবী, কামিনী, নয়নতারা, ধুতরা, কল্কে, স্থলপদ্ম, কচুরী, সন্ধ্যামণি, জিঙে, জয়ন্তীসহ নাম না জানা নানা জাতের ফুলের গন্ধে মৌ মৌ করা বাতাস জানান দেয়  এসে গেছে শরৎ।

আরও পড়ুনঃ  লেনদেনের শীর্ষে বেক্সিমকো ফার্মা

শরতের কাশফুলে মুগ্ধ হয় না, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। শরৎ কালকে বলা হয়ে থাকে ঋতু রাণী। তাইতো প্রকৃতির  রূপের বাহারে কবি সাহিত্যিকের মনোজগত আলোড়িত হয় দারুনভাবে। শরতের সৌন্দর্য নিয়ে রচিত হয়েছে অসংখ্য কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ। চর্যাপদের পদকর্তা থেকে শুরু করে আজকের  কবিদের রচনায়  শরৎকাল তার নান্দনিক রুপে প্রকাশিত হয়েছে। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার অসংখ্য গান ও কবিতায় শরতের প্রকৃতির চিত্র  নিখুঁতভাবে। তাই তো তিনি বলেছেন- শিউলি ফুলের মালা দোলে শারদ রাতের বুকে ঐ’, ‘এসো শারদ প্রাতের পথিক’।

মহাকবি কালিদাস ‘মেঘদূত’ কাব্যের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। মহাকবি কালিদাস শরৎ বন্দনায় বলেন, ‘প্রিয়তম আমার, ঐ চেয়ে দেখ, নববধূর ন্যায় সুসজ্জিত শরৎ কাল সমাগত।’ শরৎ প্রকৃতিতে আসে নানা আনন্দের বারতা নিয়ে। কবি বিনয় মজুমদার শরতের একটি চিত্র এঁকেছেন এভাবে-

“শরতের দ্বিপ্রহরে সুধীর সমীর-পরে জল-ঝরা শাদা শাদা মেঘ উড়ে যায়; ভাবি, একদৃষ্টে চেয়ে, যদি ঊর্ধ্বপথ বেয়ে শুভ্র অনাসক্ত প্রাণ অভ্র ভেদি ধায়।’

শরৎ হচ্ছে আকাশ ও মাটির অপূর্ব সমন্বয়। একদিকে নীলাকাশ, অন্যদিকে কচি  সবুজ ফসলের সমারোহ। আকাশ ও মৃত্তিকার যে হৃদয়াবেগ, তা আমাদের হৃদয়কে নাড়া দিয়ে যায়। ভাদ্রমনকে উদ্বেলিত করে। প্রকৃতির সবুজ ছড়িয়ে পড়ে মাঠে-ঘাটে। প্রকৃতি তার ভালোবাসা দিয়ে আপন করে নিতে চায় সব মনকে। প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ শরতের চরিত্রের সঙ্গে বর্ণনা করেছেন প্রিয়তমাকে। শরতে মাঠে মাঠে নতুন ধানের সমারোহ।

আরও পড়ুনঃ  পুঁজিবাজারে ৩২ কোম্পানির লেনদেন চালু রবিবার

কৃষকের মনে জাগে নতুন আশা, নতুন সম্ভাবনা। পাখি পাখালির কূজনে মুখরিত মাঠ-ঘাট-জনপদ। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ঘরে ঘরে শুরু হয়ে যায় শারদীয় দুর্গোৎসবের দিনগুনা। কৈলাস ছেড়ে মা আসবেন মর্ত্যলোকে মঙ্গলবারতা নিয়ে অসুর বিনাশের তরে।

শরৎকে কবিগুরু বরাবরই দেখেছেন শান্তি ও সমৃদ্ধির ঋতু হিসেবে। তাইতো তিনি বলেছেন—

‘আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ শেফালী ফুলের মালা

নবীন ধানের মঞ্জুরি দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা

এসো হে শারদ লক্ষ্মী তোমার শুভ্র মেঘের রথে

এসো চির নির্মল নীল পথে…’ ।

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন