ঢাকা | শনিবার
২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

তাইওয়ান ইস্যু: চীন-মার্কিন দ্বন্দ্ব

তাইওয়ান ইস্যু চীন-মার্কিন দ্বন্দ্ব

রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে যেখানে বিশ্ববাসী বিপর্যস্ত ও চিন্তিত, সেখানে তাইওয়ান ইস্যু নিয়ে চীন মার্কিন উত্তেজনা আরো বড় ভাবনায় ফেলে দিয়েছে। মার্কিন সংসদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির সম্ভাব্য তাইওয়ান সফরকে ঘিরে উত্তেজনা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। চীনের হুমকি ও সামরিক মহড়ার ফলে সংঘাতের আশঙ্কা বাড়ছে। ইউক্রেন সংকট সমাধানে ইউরোপ, আমেরিকাসহ সারাবিশ্ব যখন হিমশিম খাচ্ছে, ঠিক সেই সময়ে তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে নতুন সংঘাত চিন্তার বলিরেখা বিশ্বনেতাদের কপালে।

আনুষ্ঠানিকভাবে ‘এক চীন নীতি’ মেনে ওয়াশিংটন এতকাল তাইওয়ানের সঙ্গে কূটনৈতিক দূরত্ব বজায় রেখে এসেছে। ইদানিং চীনের আগ্রাসী নীতির কারণে বাইডেন প্রশাসন প্রকাশ্যে তাইওয়ানের পাশে দাঁড়াতে পারে বলে জল্পনাকল্পনা চলছে। মার্কিন সংসদ সদস্যদের এক প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন পেলোসি। পেলোসির সফর তালিকায় শুধু সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের নাম রয়েছে। তার সম্ভাব্য তাইওয়ান সফর সম্পর্কে চরম হুমকি দিয়েছে বেইজিং। চীন তাইওয়ানের কাছে বিশাল সামরিক মহড়া শুরু করেছে।

চীনের মূল ভূখণ্ড ও তাইওয়ানের মাঝে শক্তি প্রদর্শন করেছে চীনা নৌ-বাহিনী। বিমানবাহিনীও গত ৭ আগস্ট তাইওয়ানের কাছে নজরদারি চালিয়েছে। আমেরিকাও গত সপ্তাহে দক্ষিণ চীন সাগরে ‘ইউএসএস রনান্ড রেগান’ নামের রণতরি পাঠিয়েছে। তবে ওয়াশিংটন এই পদক্ষেপকে পূর্ব-পরিকল্পিত হিসেবে বর্ণনা করছে। এ অবস্থায় তাইওয়ানের ওপর চীনের সামরিক হামলার আশঙ্কা বাড়ছে। বিশেষ করে ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার হামলার পর চীন এমন চরম পদক্ষেপ নিতে আরও ‘সাহস’ পেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং পেলোসির সম্ভাব্য তাইওয়ান সফর সম্পর্কে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে সতর্ক করে দেওয়ার পর উত্তেজনা আরও বাড়ছে। টেলিফোনে শি বাইডেনকে ‘আগুন নিয়ে খেলা’ না করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। মার্কিন প্রশাসন এই মুহূর্তে নতুন যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে কতটা প্রস্তুত, সে বিষয়ে সংশয় দেখা যাচ্ছে। চীন তাইওয়ানের ওপর সরাসরি হামলা চালালে ওয়াশিংটন সামরিক হস্তক্ষেপ করবে কিনা, সে বিষয়ে বাইডেন প্রশাসনেরও কোনো স্পষ্ট অবস্থান এখনো পাওয়া যায়নি।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন পরিস্থিতি শান্ত করতে গত ৫ আগস্ট বলেছিলেন, যে তাইওয়ানের প্রশ্নে চীনের সঙ্গে মতপার্থক্য সত্ত্বেও গত প্রায় চার দশক ধরে আমেরিকা নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার চেষ্টা চালিয়ে এসেছে। তাইওয়ান নিয়ে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মুখোমুখি অবস্থান দীর্ঘদিনের। চীন দাবি করে, ২ কোটি ৩০ লাখ জনসংখ্যার এই দেশটি তাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ। অন্যদিকে ওয়াশিংটন মনে করে, চীন আর তাইওয়ানের যে দীর্ঘ বিচ্ছেদ, সেটির মীমাংসা হতে হবে শান্তিপূর্ণ পথে।

তাইওয়ান নিয়ে চীন আর যুক্তরাষ্ট্রের মনস্তাত্ত্বিক সংঘাত চলছে দশকের পর দশক ধরে। কিন্তু বর্তমানে এই সহাবস্থান ভাঙার পথে। এর কারণও রয়েছে। ‘শি জিনপিং তাইওয়ানকে ফেরত চান’ বলছেন লন্ডনের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজের চায়না ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক স্টিভ সাং। ‘আর শি জিনপিং তাইওয়ানকে ফিরে পাওয়ার এই কাজটা শেষ করতে চান, চীনের পরবর্তী নেতা যিনিই হবেন, তার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে’।

যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের চীন বিষয়ক এক সামরিক বিশ্লেষক ওরিয়ানা স্কাইলার মাস্ট্রো বলছেন, শি জিনপিং যখন ২০১৮ সালে প্রেসিডেন্টের মেয়াদকালের সময়সীমা তুলে দিয়ে কার্যত নিজেকে আজীবনের জন্য প্রেসিডেন্ট বানালেন, তখনই তার মনে এরকম একটা আশংকা তৈরি হয়।
অধ্যাপক সাং এর মতে, শি জিনপিং নিজেকে এক বিরাট ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব বলে মনে করেন। তিনি মনে করেন, মাও জেদং থেকে শুরু করে চীনের আগের অনেক বড় বড় নেতা যে কাজ শেষ করতে পারেননি, সেটি শেষ করার দায়িত্ব তার কাঁধে বর্তেছে। তাকেই এটা করতে হবে। তাইওয়ানের অনেক মানুষ চান পূর্ণ স্বাধীনতা, কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ মধ্যপন্থা অবলম্বনের পক্ষে।

অধ্যাপক সাং বলেন, দেং শিয়াওপিং তাইওয়ানকে ফিরিয়ে আনতে পারেননি। এমনকি চেয়ারম্যান মাও পর্যন্ত পারেননি। এখন যদি শি জিনপিং তাইওয়ানকে চীনের কাছে নিয়ে আসতে পারেন, তিনি কেবল দেং শিয়াওপিং এর চাইতে বড় নেতা হবেন না, তিনি চেয়ারম্যান মাও এর চেয়েও বড় নেতায় পরিণত হবেন। শি জিনপিং এর আগে প্রকাশ্যে বলেছেন, ‘তাইওয়ানকে চীনের সঙ্গে এক করার বিষয়টি চীনের মানুষকে দারুণভাবে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য এক অবশ্যম্ভাবী প্রয়োজনীয় কাজ।’ এই সংঘাতের আরেকটি কারণ চীনের ক্রমবর্ধমান সামরিক শক্তি। যদি তাইওয়ান প্রশ্নে কোন যুদ্ধ হয়, এখন সেই যুদ্ধে জেতার ক্ষমতা চীনের আছে।

ওরিয়ানা স্কাইলার মাস্ট্রো বলেন, ‘গত বিশবছর ধরে যে প্রশ্নটা বেশিরভাগ মানুষ করেছেন, সেটা হলো, যুক্তরাষ্ট্র কি তার মিত্র এবং সহযোগীদের রক্ষায় এগিয়ে আসবে? যুক্তরাষ্ট্রের এরকম সংকল্প কতটা আছে? যুক্তরাষ্ট্র কি তাইওয়ানকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে? এখন কিন্তু এই প্রশ্ন ঘুরে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানের সাহায্যে এগিয়ে আসবে কিনা তার জায়গায় এখন বরং প্রশ্ন উঠছে, যুক্তরাষ্ট্র কি তাইওয়ানকে রক্ষায় এগিয়ে আসতে পারবে?’

গত বছরের পহেলা অক্টোবর বেইজিং এ চীনা বিপ্লবের ৭০তম বার্ষিকীতে যে বিশাল সামরিক কুচকাওয়াজ হয়েছিল, তখন এটি সবার চোখে পড়ে। এই কুচকাওয়াজে ট্যাংক, আর্টিলারি এবং রকেট লঞ্চারের মতো সনাতন সামরিক সরঞ্জাম তো ছিলই। কিন্তু সবচেয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল তাদের অত্যাধুনিক কিছু সমরাস্ত্র। এর মধ্যে ছিল শত্রুপক্ষের চোখ ফাঁকি দিতে পারে এমন যুদ্ধবিমান (স্টেলথ জেট) এবং ড্রোন। সেখানে আরও ছিল চীনের তৈরি ‘হাইপারসোনিক গ্লাইড ভেহিকেলস।’

চীন এসব অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র তৈরি করেছে যুক্তরাষ্ট্রকে মোকাবেলার কথা ভেবেই। অস্থিরতার আরও একটি কারণ আছে। দক্ষিণ চীন সাগরে অনেক কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করেছে চীন। ক্যাপ্টেন জেমস ই ফ্যানেল যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহরের সাবেক পরিচালক। বর্তমানে অবসরে। তিনি জেনেভায় সেন্টার ফর সিকিউরিটি পলিসিতে কাজ করছেন।
তার মতে, ‘এখন যে দশকটি চলছে, ২০২০ থেকে ২০৩০, এটি হচ্ছে সবচেয়ে বিপদজনক দশক।

সাবেক প্রেসিডেন্ট হু জিনতাও এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং- এরা দুজনেই চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মিকে নির্দেশ দিয়েছেন যেন তারা ২০২০ সালের মধ্যেই তাইওয়ানের সামরিক বাহিনীকে পরাস্ত করার সক্ষমতা অর্জন করে। কাজেই গত বিশবছর ধরে কিন্তু তারা এই নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করে চলেছে তাদের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য, যাতে তারা তাইওয়ানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালাতে পারে।’

সাম্প্রতিক সময়ে চীনা প্রেসিডেন্ট ও মার্কিন প্রেসিডেন্টের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হচ্ছে। তাইওয়ান প্রসঙ্গে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে বলেছেন যে দ্বীপটির মর্যাদা পরিবর্তনে যেকোন একতরফা পদক্ষেপের বিরোধিতা করবে যুক্তরাষ্ট্র। তবে তিনি এও যোগ করেছেন যে তাইওয়ানের বিষয়ে মার্কিননীতি পরিবর্তন হয়নি। অন্যদিকে বেইজিং জানিয়েছে, মি. শি মি. বাইডেনকে এক-চীন নীতি মেনে চলতে বলেছেন এবং তাকে সতর্ক করা হয় যে ‘আগুন নিয়ে যে খেলবে, তাকে পুড়তে হবে’।

মার্কিন পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ বা প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরের গুজবকে ঘিরেই মূলত উত্তেজনা বেড়েছে। দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তর বলেছে যে মিজ. পেলোসি কোনো সফরের ঘোষণা দেননি, তবে চীন সতর্ক করেছে যে মিজ. পেলোসি যদি এমন কোনো সফরে যান তাহলে এর পরিণতি গুরুতর হবে।

গত সপ্তাহে, মি. বাইডেন সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘সেনাবাহিনী মনে করছে এটি কোনো ভালো আইডিয়া নয়, তবে কোনো সফরের বিরুদ্ধে চীনের এমন বক্তব্যকে ‘সম্পূর্ণ অকেজো এবং অপ্রয়োজনীয়’ বলে অভিহিত করেছে হোয়াইট হাউস। মিজ. পেলোসি, যিনি ভাইস- প্রেসিডেন্টের পরে প্রেসিডেন্ট হওয়ার তালিকায় রয়েছেন, তিনি ১৯৯৭ সালের পর তাইওয়ানে ভ্রমণকারী সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর প্রথম কোনো মার্কিন রাজনীতিবিদ হবেন।

গত ২ আগস্ট মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরের পর ওই অঞ্চলে এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় সামরিক মহড়া শুরু করেছে চীন। বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, মহড়ায় তাইওয়ানের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় উপকূলে দুটি চীনা ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়েছে। তাইওয়ানকে ঘিরে সমুদ্রে এই মহড়া শুরু হয় স্থানীয় সময় দুপুর ১২টায়। এই মহড়ায় ‘লাইভ অ্যামিউনিশন’ বা তাজা গোলাবারুদ ব্যবহার করা হয়েছে। দ্বীপটির আশপাশে মোট ছয়টি এলাকায় এই মহড়া চলছে, যার তিনটি পড়েছে তাইওয়ানের ২০ কিলোমিটারের মধ্যে।

চীনা হুমকির মুখেই তাইওয়ানে নামলেন মার্কিন স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি। চীনের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড বলছে, তারা ইতিমধ্যেই তাইওয়ান প্রণালীতে দূরপাল্লার তাজা গোলাবর্ষণ করেছে। চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে তাইওয়ানকে বিচ্ছিন্ন করেছে এই প্রণালী। তাইওয়ান বলছে, যেভাবে তার জলসীমায় এবং আকাশপথে বিমান ও জাহাজ চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে তাতে পুরো বিষয়টিকে এক ধরনের অবরোধ বলে মনে হচ্ছে যা তার স্বাধীনতার বিপক্ষে যায়।

চীনের মুল ভূখণ্ড থেকে ১০০ মাইল দুরে অবস্থিত স্ব-শাসিত তাইওয়ানকে চীন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একটি প্রদেশ হিসেবে দেখে এবং তারা চায় দ্বীপটি আবার বেইজিং-এর নিয়ন্ত্রণে আসবে। গত ২৫ বছরের মধ্যে এই প্রথম শীর্ষস্থানীয় কোনো মার্কিন রাজনৈতিক নেতা দ্বীপটিতে গেলেন। তার সফরকে চীন ‘চরম বিপজ্জনক’ বলে আখ্যা দেয়। চীনা হুমকির মুখেই বিতর্কিত এই সফর শুরু করেন মার্কিন হাউস স্পিকার।

এই সফরের প্রতিবাদ জানাতে বেইজিংয়ে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ন্যান্সি পেলোসি তার সফর শেষ করার কিছু পরই তাইওয়ানের স্ব-ঘোষিত আকাশ প্রতিরক্ষা সীমার ভেতরে ঢুকে পড়ে ২৭টি চীনা যুদ্ধবিমান। এমনিতেই সারাবিশ্বে করোনা ও রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে অস্থিরতা ও বৈশ্বিক মন্দা বিরাজ করছে। অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়েছে অনেক দেশ। তাইওয়ান নিয়ে চীন মার্কিন উত্তেজনা বিশ্ববাসীকে নতুন সংকটের দিকে নিয়ে যাবে কী না তা এখন বিশ্ব নেতাদের ভাবনা।

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন