কোটি মানুষের আকাঙ্ক্ষা একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ যার হাত ধরে পূর্ণতা পেয়েছিল তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে যিনি পর্দার অন্তরালে থেকে শক্তি, সাহস, অনুপ্রেরণা সর্বোপরি সাহস যুগিয়েছেন এবং স্বাধীনতা অর্জনের পথে উদ্বুদ্ধ করেছেন তিনি হলেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব। বাংলাদেশ অর্জনের সংগ্রামে কেবল বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী হিসেবে নয়, একজন নীরব দক্ষ, সাহসী ও দেশপ্রেমিক সংগঠক হিসেবে বেগম মুজিবের ভূমিকা অপরিসীম।
‘কোনকালে একা হয়নিক জয়ী পুরুষের তরবারি
প্রেরণা দিয়েছে শক্তি দিয়েছে বিজয় লক্ষ্মী নারী’।
(কাজী নজরুল ইসলাম)
যার বলিষ্ঠ ও দেশপ্রেমিক নেতৃত্বে আমরা পেয়েছিলাম একটি স্বাধীন ভূখণ্ড, বাংলাদেশ তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনে বিজয়লক্ষ্মী নারী হিসেবে এসেছিলেন শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব। খোকা থেকে শেখ মুজিব, শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু এবং অবশেষে জাতির পিতা হয়ে উঠার পেছনে বেগম মুজিবের অবদান অনস্বীকার্য।
সারাজীবন ছায়ার মতো শেখ মুজিবের পাশে ছিলেন, পাশে ছিলেন তার পুরো রাজনৈতিক জীবনের বিশ্বস্ত সঙ্গী হিসেবে।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের অন্যতম কারিগর শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের জন্ম ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়। তার বাবার নাম শেখ জহিরুল হক এবং মাতার নাম হোসনে আরা বেগম। এক ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট।
শৈশবে বাবা মাকে হারানো পর মাতৃস্নেহে আগলে রাখেন তার চাচি বঙ্গবন্ধুর মা সায়রা খাতুন। বাবার স্নেহ দেন বঙ্গবন্ধুর বাবা শেখ লুৎফুর রহমান। শেখ ফজিলাতুন্নেসার ডাক নাম ছিল রেণু। রেণুর সঙ্গে বিবাহ সম্পর্কে অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘আমার যখন বিবাহ হয় তখন আমার বয়স বার-তের হবে। রেণুর বাবা মারা যাবার পর ওর দাদা আমার আব্বাকে ডেকে বললেন, তোমার বড় ছেলের সাথে আমার এক নাতনীর বিবাহ দিতে হবে। কারণ আমি সমস্ত সম্পত্তি দুই বোনকে লিখে দিয়ে যাব। রেণুর দাদা আমার আব্বার চাচা।
মুরব্বির হুকুম মানার জন্যই রেণুর সাথে আমার বিয়ে হল। আমি শুনলাম আমার বিয়ে হয়েছে। তখন আমি কিছুই বুঝতাম না। রেণুর বয়স বোধ হয় তখন তিন বছর হবে। বিয়ে হলেও শেখ মুজিবের এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাস করার পর তাদের সংসার জীবন শুরু হয়। প্রাতিষ্ঠানিক তেমন শিক্ষা না থাকলেও বেগম মুজিব ছিলেন প্রখর মেধাসম্পন্ন এবং ধৈর্য্যশীল নারী।
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিপদসংকুল সময়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের পাশে ছিলেন বেগম মুজিব। আন্দোলনের সময় নেতাকর্মীদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে জেলখানায় বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করার সময় পরামর্শ দিতেন আলোচনা করতেন এবং সেখান থেকে ফিরে এসে বঙ্গবন্ধুর মতামত নেতাদের জানাতেন। বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকাকালীন তার ছয় দফা কর্মসূচি সফল করার ক্ষেত্রে বেগম মুজিবের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কলকাতায় থাকাকালীন মুজিবের অর্থের প্রয়োজন হলে পিতৃ সম্পত্তি থেকে অর্জিত অর্থ বিনা দ্বিধায় পাঠিয়ে দিতেন বেগম মুজিব।
মুজিবের ওপর পাকিস্তান সরকারের জেল জুলুমের সময় অর্থের প্রয়োজন হলে বেগম মুজিব ঘরের আসবাবপত্র এবং নিজের অলংকার বিক্রি করে অর্থ তুলে দিতেন দলীয় নেতাকর্মীদের হাতে। একজন প্রেসিডেন্টের স্ত্রী হয়েও তার জীবন যাপন ছিল অতি সাধারণ। ছিল না কোনো অহংকার। ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ যখন অন্যান্যদ সাথে জেলে তখন তিনি তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার সাথে নানাভাবে অর্থ যোগাড় করে মামলা পরিচালনা করেছেন। সে সময় বেগম মুজিবকেও গ্রেপ্তারের হুমকি দেয়া হয়েছিল। তখন শেখ মুজিবুর রহমানের প্যারোলে মুক্তির বিষয়ে বেগম মুজিব আপত্তি জানান। পরে পাকিস্তান সরকার মুজিবকে নিঃশর্ত মুক্তি দেয়।
শেখ ফজিলাতুন্নেসা শেখ মুজিবুর রহমানের প্যারোলে মুক্তি না নেয়ার যে সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অনন্য স্বীকৃতি দিয়েছেন ইতিহাসবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। ১৯৫৪ সালে শেখ মুজিব যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রী হলে বেগম মুজিব পরিবার নিয়ে ঢাকা যান। কিছুদিন পর মন্ত্রী সভা ভেঙে দিলে বাসা ছাড়তে হয়। তখন বাসার জন্য যন্ত্রণা পোহাতে হয়েছিল। এক পর্যায়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে যে বাড়ি করেন তাতে বঙ্গমাতার শ্রম ও ঘাম জড়িয়ে আছে।
৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধু র ভাষনের গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন বেগম মুজিব। বিভিন্নজন বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছিলেন। কিন্তু বেগম মুজিব সেদিন বলেছিলেন, ‘তুমি সারাজীবন আন্দোলন সংগ্রাম করেছ, জেল খেটেছ, তুমি জানো কী বলতে হবে। তোমার মনে যে কথা আসবে তুমি তাই বলবে। শেখ মুজিব শেষ পর্যন্ত বেগম মুজিবের কথা শুনছিলেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাকে বঙ্গমাতার ছিল মনস্তাত্ত্বিক সমর্থন। ২৩ মার্চের পতাকা উত্তোলনের সময় বঙ্গবন্ধুর প্রধান পরামর্শক ছিলেন শেখ ফজিলাতুন্নেসা। মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাস অসীম সাহস ও দৃঢ় মনোবলের সাথে সংসার ও সার্বিক পরিস্থিতি সামলেছেন দক্ষতার সাথে। দেশ স্বাধীনের পরও বঙ্গমাতা দেশগড়ার কাজে বঙ্গবন্ধুর পাশে ছিলেন।
স্বাধীনতার পর বীরাঙ্গনাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি তোমাদের মা। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে অনেক বীরাঙ্গনার বিয়ে দিয়ে সামাজিকভাবে মর্যাদা সম্পন্ন জীবনদান করেন তিনি। নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন এদেশের স্বাধীনতার জন্য, স্বাধীনতার পর দেশ গঠনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গী ছিলেন বেগম মুজিব। আর এভাবেই হয়ে উঠেন তিনি বাঙালির মমতাময়ী মা বঙ্গমাতা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে বেগম মুজিবের অনবদ্য অবদানের কারণেই জনগণ তাকে বঙ্গমাতা উপাধিতে ভূষিত করেন। মহিয়সী নারী বঙ্গমাতার জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ
আনন্দবাজার/শহক