মানুষের ওপর বিনিয়োগ করুন
–ড. আতিউর রহমান
প্রস্তাবিত বাজেট ঘাটতি বাজেট হলেও এত বেশি ঝুঁকি বাড়বে না। এই ঘাটতি পোষাতে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক-এডিবি ও ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক-আইডিবি থেকে দীর্ঘ মেয়াদে স্বল্প সুদে ঋণ নিলে ভালো হয়। কেননা সেখানে ২৫-৩০ বছরের বেশি সময় দেয়া হয়ে থাকে। আরো এক শতাংশ ঘাটতি বাড়িয়ে জনহিতকর কাজে ব্যবহার করা যাবে। সর্বপরি মানুষের ওপর বিনিয়োগ করতে হবে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক সুরক্ষা এসব মানুষের ওপর বিনিয়োগ।
‘কেমন হলো বাজেট ২০২২-২৩” বাজেট প্রতিক্রিয়া শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে উন্নয়ন সমন্বয়ের সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ারের চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান এসব কথা বলেন। গতকাল শনিবার বেলা ১১টায় রাজধানী ঢাকার বাংলামোটরে নিজস্ব কার্যালয়ের খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ হল রুমে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে নতুন ৭টি প্রস্তাবসহ মূল বক্তব্য তুলে ধরেন।
বাজেট শুধু টাকার অঙ্ক নয় বরং মনস্তাত্ত্বিক উন্নয়নের পরিবর্তনও বটে বলে মন্তব্য করেন তিনি। তাছাড়া প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রয়েছে-
১. সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দ মোট বাজেটের শতাংশ হিসাবে ১৭ শতাংশের কম থেকে বাড়িয়ে ১৯-২০ শতাংশ করার কথা ভাবা যায়। এসব কর্মসূচির উপকারভোগী ও সম্ভাব্য উপকারভোগীদের তথ্য নিয়ে একটি তথ্যভাণ্ডার গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। বয়স্কভাতাসহ অনুরূপ ভাতা খানিকটা বাড়ানো জরুরি হয়ে পড়েছে।
২. স্বাস্থ্যখাতে চলতি বছরের মতোই মোট বাজেটের ৫.৪ শতাংশ রাখা হয়েছে। কেননা দেশের স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৬৮ শতাংশই নাগরিকদের পকেট থেকে আসছে। এটি বিবেচনা করে অনুপাত ৬ থেকে ৭ শতাংশ করার চেষ্টা করতে হবে। মন্ত্রণালয়টির বাস্তবায়ন সক্ষমতা বাড়ানোর সুনির্দিষ্ট উদ্যোগে বরাদ্দ বাড়ানো যেতে পারে।
৩. ইন্টারনেটসেবা ও মোবাইল ফোনসেটের দাম বৃদ্ধির যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে সেটি নিয়ে দ্বিতীয়বার ভাবা দরকার। এ ক্ষেত্রে নতুন করে বাড়তি ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে হবে।
৪. কৃষিতে ভর্তুকি সাধারণত ১০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে থাকে। এবার ১৬ হাজার কোটি টাকার বেশি করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও সার-জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব কৃষিতে পড়বেই। সে জন্য অন্তত আরো পাঁচ হাজার কোটি টাকার বাড়তি বরাদ্দ দিতে হবে।
৫. পদ্মা সেতু চালু হলে দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার সঙ্গে যোগাযোগে নতুন দিগন্ত চালু হবে। এতে দক্ষিণবঙ্গে বিনিয়োগ প্রবাহ বাড়াতে বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশেষ প্রণোদনার কথা ভাবতে হবে। যেমন-বিভিন্ন স্টার্টআপ তহবিলের একটি অংশ দক্ষিণবঙ্গের উদ্যোক্তাদের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বরাদ্দ দেওয়া যেতে পারে।
৬. করোনা সংকটের মধ্যেও এনবিআর রাজস্ব আদায়ে দক্ষতা দেখিয়েছে। এই দক্ষতা আরো বাড়াতে তাদের ডিজিটাইজেশন প্রক্রিয়া বেগবান করতে হবে। একই সঙ্গে মানবশক্তির দক্ষতা ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের দিকে নীতি-মনোযোগ দিতে হবে।
৭. সর্বজনীন পেনশন স্কিমটি দ্রুতই বাস্তবায়নের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিতে পারলে সমাজে খানিকটা হলেও স্বস্তির হাওয়া বইবে।
বিশ্ব প্রেক্ষাপটে মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জি সরকার কীভাবে সামাল দিবে এই প্রশ্নের উত্তরে ড. আতিউর রহমান বলেন, সার, কীটনাশক ও অন্যান্য পণ্যের দাম বাড়লে কৃষকের ঘাড়ে গিয়ে পড়ে। বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতির কারণে জ্বালানিতে সমন্বয় করা কঠিন। ভর্তুকি বেশি দিলে অন্যান্য কাজ করা সমস্যায় পড়বে। আমাদের উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসতে হবে। সামাজিক সুরক্ষার অধীনে মালিকরা শ্রমিকদের বিনামূল্যে বা কম মূল্যে চাল-ডাল বা অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য দিতে পারেন না? তাতে মূল্যস্ফীতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতি বেসামাল তাই ধীর পদক্ষেপে আগাতে হবে। কেননা বর্তমানে বিশ্ব রুবল ও ডলারে ভাগ হয়ে যাচ্ছে।
মূল্যস্ফীতি যুক্তরাষ্ট্রে সাড়ে ৮ শতাংশ। এই মুহূর্তে এটি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। ইউনাইটেড ব্যাংক টাকা তুলে নিচ্ছে। বিশ্ব অর্থনীতি অনিশ্চিত পথে যাচ্ছে।
তিনি জ্বালানিতে ভর্তুকি বিষয়ে বলেন, বিদ্যুৎ ও অন্যান্যখাতে উৎপাদন ও বিতরণের বিষয়টি ভাবা দরকার। টেকসই উন্নয়নের দিকে যেতে হবে। সময় বেশি লাগলেও ডিজেল না করে সোলার বিদ্যুৎ করা যেতে পারে। দেশে ১৫ হাজারের পরিবর্তে ১৫ লাখ সোলার বিদ্যুৎ হলে আমরা বিপ্লব করতে পারতাম।
রাজস্ব বাড়ানোর বিষয়ে ড. আতিউর রহমান বলেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআরের কাজ জেলা পর্যায়ে নেয়া যায়নি। এটিতে উন্নয়ন করা যায়।
তিনি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অযথা গাড়ি দেয়ার ব্যাপারে বলেন, প্রত্যেককে গাড়ি দেয়া ও বড় বড় কনফারেন্স করার প্রবণতা কমাতে হবে। এতে জ্বালানিও বাঁচবে অর্থও সাশ্রয় হবে।
উন্নয়ন সমন্বয়ের সভাপতি বলেন, অর্থনীতি শক্ত অবস্থানে আছে। কেননা কৃষি, প্রবাসী আয় ও রপ্তানি ভালো করছে। আগামীতে প্রবাসী ও রপ্তানি আয় বাড়বে। ৩-৬ মাস পর্যন্ত আমদানি কোটাটি ১০-১৫ শতাংশ রাখেন। এসব টাকা দেশে ফিরিয়ে আনেন। প্রিমিয়াম বন্ড কেনার যে বাধা আছে তা বন্ধ করতে হবে। শুধু টাকা নয় মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে সেবাকে সহজ করতে হবে। ব্যাংকিংখাতে ঋণের বিষয়ে ভয় পাওয়ার কারণ নেই।
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, পাচার করা টাকা নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিয়ে আবার দেশে ফেরত আনার প্রস্তাবটি নিয়ে আরো ব্যাখ্যা প্রয়োজন। দেশে ডলারের প্রবাহ বাড়াতে বাজেটপ্রণেতারা প্রস্তাবনাটি যুক্ত করেছেন। কিন্তু অসাধু পাচারকারীরা পাচার করা টাকা দেশে আনতে সুযোগটি কতটা ব্যবহার করবে তার অনিশ্চয়তা থেকেই যাচ্ছে। এ প্রস্তাবটি জনগণের কাছে নৈতিকতার নিরিখে একটি ভুল বার্তাই পৌঁছাবে।
ড. আতিউর রহমান বলেন, ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট এবং খুচরা বাজারে মোবাইল ফোনের ওপর ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের প্রস্তাবটি শিক্ষা বিস্তারে বাধার সৃষ্টি করবে। কেননা করোনায় দেখা গেছে, বিদ্যমান ‘ডিজিটাল ডিভাইড’ শিক্ষার্থীদের অনলাইন পড়ালেখা চ্যালেঞ্জিং করে তুলেছিল। আমদানি করা ল্যপটপে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ ব্লেন্ডেড অ্যাপ্রোচে প্রতিবন্ধকতা বাড়াবে।
এখন ইন্টারনেটসেবা ও ডিজিটাল ডিভাইস সব আয়শ্রেণির পরিবারগুলোর কাছে সহজে পৌঁছানোর উপযোগী আর্থিক নীতিই কাম্য হলেও প্রস্তাব সে কথা বলে না। আর দেশে উৎপাদিত ল্যাপটপ চাহিদা পূরণে মোটেও কার্যকর নয়।
ঝুঁকিপূর্ণ ক্রিপ্টো-কারেন্সির পরিবর্তে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এরই মধ্যে তাদের নিজস্ব মুদ্রার ডিজিটাল সংস্করণ চালু করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও আসন্ন অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিজিটাল মুদ্রা (সিবিডিসি) চালু করার সম্ভাব্যতা যাচাই করবে উদ্যোগকে স্বাগত জানাই।
ড. জামাল উদ্দীন আহমেদ বলেন, সংসদ সদস্যদের ৯০ শতাংশ মনোযোগ বাজেটে দিতে হবে। একই সঙ্গে তাদের গাড়িসহ বিভিন্ন বিলাসবহুল শুল্কবিহীন আমদানি বন্ধ করতে হবে। টিন নাম্বার আছে ৪০ লাখ। সেখানে ট্যাক্স দিচ্ছে কত? সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী আছে ১২ লাখের বেশি মানুষ। উপজেলাতে ট্যাক্স বাড়াতে হবে। ৯টি মন্ত্রণালয় উপজেলায় কাজ করলেও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অফিস নেই।
তিনি বলেন, বিদেশি কর্মচারী আমদানিতে ৫০ হাজার কোটি টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে। এ জন্য দেশিয় প্রজেক্টে বিদেশে কাজ করা বাংলাদেশিদের সুযোগ দিয়ে ৩০ কোটি টাকা বাঁচানো যায়। কালো টাকার একটি অংশও এটি।
সভ প্রধানের বক্তব্যে উন্নয়ন সমন্বয়ের সম্মাননীয় ফেলো সমাজতাত্ত্বিক খন্দকার সাখায়াত বলেন, বিশেষ পরিস্থিতি সামাল দেয়ায় ছিল অর্থমন্ত্রীর কৌশল। তিনটি জায়গায় জোর দেয়া হয়েছে। তার মধ্যে ১. কর কাঠামো সময়পোযোগী হয়েছে। ২. কৃষিতে ফোকাস দেয়া হয়েছে, চালে উৎপাদনে সমস্যা সমাধান করতে হবে আমদানি নয়। ৩. সামাজিক নিরাপত্তা বৃদ্ধি, মুদ্রা, বাজার নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
আনন্দবাজার/শহক