রবিবার, ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৭ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আজ সেই ভয়াল, বিভৎস ও মর্মাহতের দিন

আজ সেই ভয়াল, বিভৎস ও মর্মাহতের দিন

রানা ট্রাজেডির ৯ বছর

দেখতে দেখতে পার হয়ে গেছে নয় বছর। ২০১৩ সালের এই দিনে সাভারে ঘটে গিয়েছে সারা বিশ্বের আলোরন সৃষ্টিকারী ভয়াভহ, বিভৎস ও মর্মাহর্তের ঘটনা। সেদিনের সেই ঘটনায় কেউ হারিয়েছে তার মাকে, কেউ তার বাব, কেউ তার ভাই, কেউ বোন, কেউ তার স্ত্রী, কেউ স্বামী, আবার কেউ হরিয়েছে তার প্রানের মানুষটিকে। দেশের ইতিহাসে এটাই মানবসৃষ্ট সবচেয়ে বড় বিপর্যয়। ধসে পড়ে সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডের রানা প্লাজার নয় তলা ভবন।

ওই ভবনের ৩য় তলা থেকে নবম তলা পর্যন্ত ছিল পাচটি পোশাক কারখানা। এতে প্রায় ৪ হাজার পোশাক শ্রমিক কাজ করতো। ভবন ধসের সাথে সাথে ধ্বংসস্তুপের ভেতরে চাপা পড়ে চার হাজার পোশাক শ্রমিক। আমাকে বাচাও, পানি দাও, আমার হাতটি কেটে আমাকে বের করো সহ স্বজনদের কান্না আর আহাজাড়ীতে শোকের মাতম নেমে আসে পুরো সাভারে। গোটা আকাশ ভারী হয়ে উঠে। মুহুর্তের মধ্যেই ছুটে আসে সাধারন উদ্ধার কর্মী, দমকল বাহিনী, সেনাবাহিনী, পুলিশ, আনসার, র‌্যাব সহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন সদস্য। তাদের সকলের প্রচেষ্টার ধ্বংসস্তুপের ভেতর থেকে বের হতে থাকে জীবন্ত ও মৃত মানুষ। উদ্ধার হওয়া আহতদেরকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার জন্য সাভারের ঢাকা আরিচা মহাসড়ক বন্ধ করে দিয়ে মহাসড়কের দুপাশে সারিবদ্ধভাবে দাড় করিয়ে রাখা হয় এ্যাম্বুলেন্স। তাদেরকে হাসাপাতালে পাঠানো, প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদানসহ সব ধরনের সহযোগীতার জন্য বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে ছুটে আসে হাজারো স্বেচ্ছাসেবীরা। একে একে বের করা হয় জীবন্ত, মৃত ও অর্ধমৃত মানুষ। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই মৃত মানুষের সংখ্যা বেড়ে যায়। হাসপাতালের মর্গ কানায় কানায় ভড়ে উঠে। পরে লাশ গুলোকে নিয়ে যাওয়া সাভারের অধরচন্দ্র স্কুলের মাঠে। স্কুল বারন্ধায় সারিবদ্ধভাবে লাশ রেখে দেওয়া হয়। এই প্রথম এতো লাশের সংখ্যা গুনতে স্কুল মাঠে ঝুলানো হয় লাশের স্কোর বোর্ড। স্বারিবদ্ধভাবে সাজিয়ে রাখা হয় কফিনের বাক্স। ততক্ষনে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ধ্বংসস্তুপের ভেতরে চাপা পড়া লোকদের স্বজনেরা ছুটে আসা রানা প্লাজার সামনে। তাদের কান্না আর আহাজাড়ীতে গোটা আকাশটা ভাড়ি হয়ে উঠে।

আরও পড়ুনঃ  পাঠানো হয়েছে ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের নগদ লভ্যাংশ

প্রিয় মানুষটিকে জিবীত না পেলেও তার মৃত দেহটি নেওয়ার জন্য স্বজনেরা ভির জমায় অধরচন্দ্র স্কুলের মাঠে। একটু পরপরই এক একটি লাশের গাড়ি আসলেই তার দৌরিয়ে ছুটে যায় ওই গাড়ীর কাছে। এই বুঝি এলো তার প্রিয় মানুষটির মৃতদেহ। এভাবেই কেটে গেল ৫/৬দিন। দিন যতই অতিক্রম হচ্ছে জীবিত মানুষের সংখ্যা ততই কমে আসছে। স্বজনরা তার প্রিয় মানুষকে জীবিত পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়ে তার লাশটি নিয়ে যাওয়ার আশায় ওই ভবনের সামনে, স্কুল মাঠে অপেক্ষা করতে থাকে।

এদিকে ধ্বসের পর দক্ষ জনবল ও প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাবে উদ্ধার কাজ ব্যহত হতে থাকে। উদ্ধার তৎপড়তায় ধীরগতি দেখে, কোন কিছু না ভেবেই উদ্ধার কাজে ঝাপিয়ে পড়ে সাধারণ মানুষ। উদ্ধারকাজের নন্যুতম অভিজ্ঞতা ছিল না কারও। তবুও ভবনের নিচে আটকে পড়া মানুষের জীবন বাঁচানোর তাগিদেই নিজের জীবনের ঝুকি নিয়ে তারা ঢুকে পড়েছেন ধ্বসস্তুপের ভিতরে। হাত-পা কেটে হলেও বেড় করে এনেছেন একেকটি জীবন্ত প্রাণ। বিকৃত হয়ে যাওয়া পঁচা লাসের গন্ধ উপেক্ষা করে, তারা সন্ধান করেছেন জীবিত কোন প্রানের স্পন্দন।

অসামান্য ওই মানুষগুলোর কারনেই ধ্বংসস্তুপের ভেতরে থেকে ২৪৩৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। এছাড়াও মৃতদেহ উদ্ধার করা হয় ১১৩৮ জনের।

এদিকে ভবন ধসের ৫ম দিনে (২৮ এপ্রিল) ভবনের ভেতরে এক প্রানের স্পন্দন পাওয়া যায়। কাছে গিয়ে উদ্ধার কর্মীরা জানতে পারে তার নাম শাহীনা। তাকে বাচাতে গিয়ে অগ্নিদগ্ধ হয়ে কায়কোবাদ নামের এক উদ্ধার কর্মী গুরুত্বর আহত হন। টানা সাতদিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে ৫মে শনিবার রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সে না ফেরার দেশে চলে যান।

আরও পড়ুনঃ  ডিএসইতে সূচক বাড়লেও কমেছে লেনদেন

ভবন ধসের ১৭তম দিনে সেনাবাহীনির পক্ষ থেকে উদ্ধার কাজের সমপ্ত ঘোষনা করার আগ মুহুর্তে ঘটে এক অলৌকিক ঘটনা। ধ্বংসস্তুপের ভেতরে পাওয়া যায় আরেকটি প্রানের স্পন্দন। অলৌকিকভাবে চারটি বিস্কুট ও  এক বোতল পানি খেয়ে বেচে ছিল রেশমা। ১৭তম দিনে বিকেল তিনটার দিকে ভেতরে থেকে একটি কাঠি নাড়া চড়া করতে দেখে উদ্ধার কর্মীরা। পরে তারা রেশমাকে জীবিত দেখতে পেয়ে তাকে উদ্ধার করে সাভারের সিএমএইচ হাসপাতালে নিয়ে যায়। অলৌকিকভাবে বেচে যাওয়া রেশমাকে দেখতে হাসপাতালে তাতক্ষনিকভাবে হেলিক্পটার যোগে ছুটে দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের ম›ন্ত্রী পরিষদের বিভিন্ন ব্যাক্তিবর্গ।

এর পর ২০তম দিনে আনুষ্ঠানিকভাবে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে রানা প্লাজার উদ্ধার কাজ সমাপ্ত ঘোষনা করেন উদ্ধারকাজে গঠিত মন্বয় কমিটির প্রধান নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল চৌধুরী হাসান সোহরাওয়ার্দী। তিনি উদ্ধার কাজ শেষে প্রেস ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে ১হাজার ১২৭ জনকে মৃত ও দুই হাজার ৪৩৮ জনকে জীবিত উদ্ধারের কথা জানান। এর পরের দিন উদ্ধার কাজ শেষে ওই জায়গাটি ঢাকা জেলা প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন