শনিবার, ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কোম্পানি পরিচালনা চ্যারিটি নয়; পারিশ্রমিক বিষয়ক নীতিমালা সময়ের দাবি

কোম্পানি পরিচালনা চ্যারিটি নয়; পারিশ্রমিক বিষয়ক নীতিমালা সময়ের দাবি

কোম্পানির ব্যবস্থাপনা——–

সময়ের প্রবাহে ধাপে ধাপে ব্যবসায় সংগঠনের বিবর্তন ঘটেছে। বাজার ব্যবস্থার বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অধিক মূলধনের প্রয়োজনে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের পরিচালন পদ্ধতিরও বিবর্তন ঘটেছে। এ বিবর্তের শুরুতে এসেছে এক মালিকানা ব্যবসায় এবং অতঃপর অংশীদারী। যৌথমূলধনী কোম্পানি ব্যবসায় প্রচলন হলো বিবর্তনের তৃতীয় ধাপ। কোম্পানি ব্যবসায়ের প্রকৃতি প্রথম দু’টি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। কারণ, এর রয়েছে আলাদা আইনগত ভিত্তি। ইউরোপে শিল্পবিপ্লবের পর নানাবিদ কারণে যৌথমূলধনী কোম্পানি ব্যবসায় সংগঠনের এই বিবর্তনের সর্বশেষ এবং জনপ্রিয়তম সংযোজন হয়।

যৌথমূলধনী কোম্পানির একটি বিশেষ ধরন হলো সাধারণ সীমিত দায় কোম্পানি (পিএলসি)। এ ধরনের কোম্পানি আরো অধিকতর মূলধন সংগ্রহের জন্য পুঁজিবাজারে তালিকাভূক্ত হয়ে জনগণের সামনে তাদের সঞ্চিত অর্থ বিনিয়োগের নতুন বিকল্প তৈরি করে একটি দেশে অর্থনীতিকে অধিকতর গতিশীল রাখতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে।

একটি সাধারণ সীমিত দায় কোম্পানি বা পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিসহ (পিএলসি) সব ধরনের যৌথমূলধনী কোম্পানিতে সব শেয়ারহোল্ডারের মালিকানা থাকলেও সবাই কোম্পানি পরিচালনার সুযোগ পান না। প্রতিবছর অনুষ্ঠিত ‘বার্ষিক সাধারণ সভা’ বা এজিএমে সব শেয়ার মালিকের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত সব প্রতিনিধি তথা ‘বোর্ড অব ডিরেক্টর্স’ বা পরিচালকমণ্ডলি তাদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত পর্ষদসভায় গৃহীত যৌথ সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে সবাই যৌথভাবে কোম্পানির সব কার্যক্রম পরিচালনা করেন। পাশাপাশি তারা পরিচালনা ‘পর্ষদ সভা’ পরিচালনার জন্য তাদের মধ্য থেকে একজনকে ‘চেয়ারম্যান’ নির্বাচিত করেন। কোম্পানির দৈনন্দিন কাজ পরিচালনার জন্য নিজেদের কাজের সুবিধার্থে পরিচালকবৃন্দ তাদের মধ্য থেকে এক জনকে ‘ম্যানেজিং ডিরেক্টর’ বা ‘এমডি’ নির্বাচিত করে থাকেন। ‘ম্যানেজিং ডিরেক্টর’ নিয়মিত অফিস করেন, বেতন পান এবং তার কাজের জন্য তাকে পরিচালনা পর্ষদের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। পরিচালকবৃন্দর মধ্য থেকে ‘ম্যানেজিং ডিরেক্টর’ পাওয়া না গেলে বাইরে থেকে যোগ্য কাউকে ‘সিইও’ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।

আরও পড়ুনঃ  সূচক পতনে লেনদেন শুরু

একটি সাধারণ সীমিত দায় কোম্পানির (পিএলসি) নাম নির্ধারণ থেকে শুরু করে কার্যারম্ভ কিংবা পরবর্তীতে কোম্পানি পরিচালনার জন্য পরিচালকগণ কোন পারিশ্রমিক পান না। পরিচালকগণ পর্ষদ সভায় উপস্থিত থাকার জন্য শুধুমাত্র ‘বোর্ড ফি’ প্রাপ্য হন। সাধারণভাবে, এছাড়া পরিচালকবৃন্দ অন্যকোনো প্রকাশ্য অথবা গোপন অর্থিক সুবিধা বা ‘অফিস অব প্রফিট’ গ্রহণ করতে পারেন না। এটি হলো সাধারণ সীমিত দায় কোম্পানি (পিএলসি) পরিচালনায় পারিতোষিক বিষয়ক প্রচলিত নিয়ম। কোম্পানি পরিচালনা তাদের ওপর বিশ্বাসপূর্বক ন্যস্ত দায়িত্ব; যা তাদের সততা এবং বিশ্বস্ততার সঙ্গে পালন করতে হয়।

পরিচালকদের দায়-দায়িত্ব এবং ক্ষমতা বিষয়ে বহুবিদ মামলার ফল স্বরূপ অনেকগুলো ডকট্রিন বা মতবাদের সূচনা হয়েছে। ফলশ্রুতিতে, কোম্পানি পরিচালকদের দায়-দায়িত্ব এবং ক্ষমতার ক্ষেত্র পরিষ্কারভাবে নির্ধারিত হয়েছে। এছাড়া, কোম্পানি পরিচালনায় যে কোনো ব্যর্থতায় পরিচালকদের একক এবং যৌথ দায় রয়েছে; আছে সিভিল বা দেওয়ানি দায়, হতে হয় দেওয়ানি মামলার শিকার। একটি সাধারণ সীমিত দায় কোম্পানি (পিএলসি) কিংবা একটি ঘরোয়া সীমিত দায় কোম্পানিতে (প্রাইভেট কোং) পরিচালকবৃন্দ তথা নন-এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টরা শুধুমাত্র পর্ষদ সভায় উপস্থিত থাকার জন্য ‘ফি’ প্রাপ্য হন। যা কোম্পানি ‘সংঘ বিধি’ বা ‘পরিমেল নিয়মাবলি’ বা ‘আর্টিকেলস অব এসোসিয়েশন’ দ্বারা নির্ধারিত।

পুঁজিবাজারে তালিকাভূক্ত কোম্পানি পরিচালনা আরো বেশি চ্যালেঞ্জিং, শ্রমঘন এবং সময় সাপেক্ষ বিষয়। এক্ষেত্রে কোম্পনিগুলোর ‘পরিচালনা পর্ষদ’ প্রচলিত আইনের পাশাপাশি তাদের স্ব স্ব প্রাথমিক রেগুলেটর এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) বিভিন্ন শর্তাবলী পরিপালন করে কোম্পানি পরিচালনা করতে হয়। কোম্পানি উপস্থাপিত বা প্রদর্শিত পাবলিক ডকুমেন্টের সব ভুলভ্রান্তির দায় বহন করতে হয় পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি পরিচালনা পর্ষদকে যা প্রায়শই আপনারা বিএসইসি, ডিএসসি এবং সিএসি কর্তৃক বিভিন্ন কোম্পানির ‘পরিচালনা পর্ষদকে কারণ দর্শানোর নোটিশ কিংবা জরিমানা করতে দেখে থাকবেন।

আরও পড়ুনঃ  চীনে বৃদ্ধি পেয়েছে শীতের পোশাকের বিক্রি

কোম্পানির পরিচালনায় যে কোনো ব্যর্থতায় পরিচালকদের একক এবং যৌথ দায় রয়েছে ষ প্রসপেক্টাস এবং আর্থিক বিবরণী সংক্রান্ত ভুল-ভ্রান্তির জন্য যৌথভাবে সকল পরিচালকের রয়েছে সিভিল তথা দেওয়ানি দায়। হতে হয় দেওয়ানি মামলার শিকার। অথচ, এ বিষয়ে তাদের জন্য কোনো ধরনের পারিশ্রমিক বিবেচনা করা হয়নি। আবার, স্বতন্ত্র পরিচালকদের জন্যও ‘পর্ষদ ফি’র বাইরে কোনো ধরনের পারিশ্রমিক বিবেচনা করা হয়নি। অথচ, অডিট কমিটির মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে চেয়ারম্যান হিসেবে দেখভাল করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে স্বতন্ত্র পরিচালকে।

‘এনআরসি’ কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব দেয়া হয়েছে স্বতন্ত্র পরিচালকেই। ‘পরিচালনা পর্ষদ’ এ জ্ঞান এবং দক্ষতায় বৈচিত্র আনার পাশাপাশি আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চত করতে এতে স্বতন্ত্র পরিচালকের অন্তর্ভুক্তির একটি বিশাল ভূমিকা রয়েছে যা বিশ্বজুড়ে করপোরেট সুশাসনের অন্যতম মূল স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু, তাদের কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করতে যে সময় এবং শ্রম দিতে হবে তার জন্য কোনো পারিশ্রমিকের কথা বিবেচনায়ই নেয়া হয়নি।

ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) এর মার্চ ২০২০ সালে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের স্বতন্ত্র পরিচালকদের স্বরূপ’ নামক একটি প্রতিবেদনে বাংলাদেশের তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর ‘পরিচালকদের’ আয়ের করুণ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনটি থেকে আরো জানা যায়, এদেশে পরিচালকের গড় পারিশ্রমিক তাদের যোগ্যতা এবং দায়িত্বের সঙ্গে কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কোম্পানি থেকে তাদের বার্ষিক গড় আয় প্রায় মাত্র দেড় লাখ টাকা। মাসে ১২,৫০০ টাকারও কম! অথচ আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে একজন স্বতন্ত্র পরিচালক বছরে গড়ে তার চাইতে সাত গুণ বেশি আয় করেন। এত নিম্ন আয় তাদের পেশাদারী দায়িত্ব, অভিজ্ঞতা এবং অবদানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

আরও পড়ুনঃ  রাঙামাটিতে শতভাগ পাশ করেছে দুই উপজেলার তিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) স্বতন্ত্র পরিচালকদের দায়িত্ব দিয়েছে কিন্তু কোনো দায় দেয়নি। তাই হয়নি তাদের সত্যিকারের ক্ষমতায়নও। অথচ, অডিট কমিটির মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে চেয়ারম্যান হিসেবে দেখভাল করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে স্বতন্ত্র পরিচালকে। অডিট কমিটির প্রধান হিসেবে তার কাজ কোম্পানির সব প্রকার আর্থিক অনিয়ম এবং অসঙ্গতি উদ্ঘাটন করা এবং তদানুযায়ী পর্যদ সভাকে অবহিত করা। পাশাপাশি বার্ষিক সাধারণ সভায় সব শেয়ারহোল্ডারকেও বিষয়টি অবহিত করার বিধান রাখা হয়েছে। তাদের উক্ত কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করতে যে সময় এবং শ্রম দিতে হবে তার জন্য কোনো পারিশ্রমিকের কথা বিবেচনায়ই নেয়া হয়নি।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি পরিচালকের দায়িত্ব পালন যেন চ্যারিটি! এ বিষয়টি দেশের ভালো ভালো কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হবার অনীহার অন্যতম কারণও বটে! লাভজনক কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজারে আকৃষ্ট করতে পরিচালকদের জন্য বিদ্যমান পারিশ্রমিক মোটেও যথেষ্ট নয়। অধিকন্তু, উদ্যোক্তা পরিচালকদের সম্পূর্ণ শেয়ার দীর্ঘদিন ‘লকইন’ রাখার বিনিয়োগবান্ধব বিকল্প খুঁজতে হবে; যাতে করে সব ধরনের শেয়ার মালিক পুঁজিবাজার থেকে লাভবান হতে পারেন। নিজেদের পরিশ্রমের ন্যায্য হিস্যা পাওয়া উদ্যোক্তা পরিচালকদের অধিকার। সংখ্যালঘু শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থরক্ষার নামে সংখ্যাগুরুদের অধিকারের প্রতি উদাসীন থেকে বিনিয়োগবান্ধব ভালো পুঁজিবাজারে রূপান্তর কখনো সম্ভব নয়।

ব্যবসা পরিচালনায় অন্যতম জনপ্রিয়তম নীতি হলো ‘টাইম ইজ মানি’। তাই, নিম্ন পারিশ্রমিক দিয়ে কখনো টেকসই কোম্পানি পরিচালানা আশা করা যায় না। উপযুক্ত পারিশ্রমিকের অনুপস্থিতিতে অদক্ষতা জেকে বসবে। স্বল্প সম্মানির কারণে স্বতন্ত্র পরিচালকসহ অপরাপর সব পরিচালকদের বস্তুনিষ্ঠতা এবং কর্মতৎপরতা হয়ে পড়বে আপোষমূলক এবং নিয়ম রক্ষার আনুষ্ঠানিকতার মতো। কোনো দক্ষ লোকই আপোষমূলক হয়ে নিজের সুনাম এবং সময় নষ্ট করতে চাইবে না।

সংবাদটি শেয়ার করুন