রবিবার, ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৭ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

গয়ানাথের বালিশ মিষ্টি

গয়ানাথের বালিশ মিষ্টি

স্বাদে অতুলনীয়

বালিশ’ নামটা সকলের কাছেই পরিচিত। মানুষ দিনের ক্লান্তি শেষে বালিশ মাথায় দিয়ে আরামে বিছানায় ঘুমায়। নেত্রকোণা তথা ভাটি বাংলার মানুষ বালিশ মাথায় দিয়ে ঘুমায় বটে। তবে আরেক লোভনীয় সুস্বাদু বালিশ খায়ও আপনিও খাবেন। শুনে অনেকে অবাক হতে পারেন। কিন্তু আসলে তাই। একজন তো প্রশ্নই করে ফেললেন, বালিশ খায় মানে, কী করে, তুলা দিয়ে তৈরি কাপড়ে মোড়ানো তুলতুলে বালিশ খাওয়ার কথা শুনলে যেকোনো মানুষেরই অবাক হওয়ার তো কথাই। তবে সত্যিই বালিশ খাওয়া যায়, আর যদি সেটা হয় নেত্রকোনার ঐতিহ্যবাহী গয়ানাথের দেশবিখ্যাত সুস্বাদু ‘বালিশ’ মিষ্টি তাহলে তো কথায় নেই। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই বহুমাত্রিক সংস্কৃতি ধারণ করে আসছে জেলাটি। আর বর্তমানে জেলার অন্যতম পরিচিতি মিষ্টির কারণে।

শহরের বারহাট্টা রোডে গয়ানাথ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে এটি প্রস্তুত করেন গয়ানাথ নামের এক কারিগর প্রায় শত বছর আগে বালিশ মিষ্টি তৈরি করে বিখ্যাত হয়েছিলেন। এ জন্য একে গয়ানাথের বালিশ মিষ্টি বা গয়ানাথের চমচমও বলে থাকেন। সে সময়ে শুধু তার দোকানেই এই মিষ্টি বিক্রি হতো। জেলার চরপাড়ার শতবর্ষী মো. খাজুর আলী বালিশ নিয়ে শোনালেন একটি লোকজ ছড়া-

জাম, রসগোল্লা পেয়ে শ্বশুর, করলো চটে নালিশ, কথা ছিল আনবে জামাই, কালীগঞ্জের (নেত্রকোণা) গয়ানাথের ‘বালিশ’।

এ অঞ্চলে বালিশ মিষ্টির ঐতিহ্য নিয়ে প্রচলিত এমন বহু ছড়া যুগ যুগ ধরে চলছে আমজনতার মুখে। এ নাম শুনলে পরিচিতজনদের জিভে পানি এসে যায়। স্বাদ নিতে ইচ্ছা করে। অন্য মিষ্টির চেয়ে আকারে বড় এবং দেখতে অনেকটা বালিশের মতো হওয়ায় ক্রেতাদের পরামর্শে গয়ানাথ মিষ্টির নাম রাখেন ‘বালিশ’। অল্পদিনেই অতুলনীয় স্বাদের এ মিষ্টির খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

আরও পড়ুনঃ  কমছে পোশাক রফতানি

বালিশ মিষ্টির প্রথম রূপকারদ হিসেবে দেশজুড়ে পরিচিতি পান গয়ানাথ ঘোষ। ধীরে ধীরে তার নামটিও জড়িয়ে পড়ে মিষ্টির সঙ্গে, হয়ে উঠে গয়ানাথের বালিশ।

কেন এ মিষ্টি এত বিখ্যাত, তা অনেকের মনেই হয়তো প্রশ্ন জাগে। এ মিষ্টি অন্যান্য সাধারণ মিষ্টির মতো নয়। এ মিষ্টি আকার-আকৃতিতে অনেকটা বড়ই হয়ে থাকে। বালিশের মতো দেখতে বিধায় একে বালিশ মিষ্টি বলা হয়। একেকটি মিষ্টির ওজন প্রায় দুই কেজি পর্যন্ত হতে পারে। এটি স্বাদ, রং ও গন্ধে অনন্য। খুব বেশি খাদক না হলে এ মিষ্টি শেষ করা মোটেই সম্ভব নয়। তবে বর্তমানে ক্রেতাদের চাহিদার ওপর বিবেচনা করে ছোট-বড় আকারে তৈরি করা হচ্ছে। এ মিষ্টি এখন নেত্রকোণায় নির্দিষ্ট গয়ানাথের দোকান ছাড়াও অনেক দোকানেই পাওয়া যায়।

বালিশ তৈরি হয় কিভাবে, বালিশ মিষ্টি তৈরি হয় দুধ, ছানা, চিনি ও ময়দা দিয়ে। প্রথমে ছানার সঙ্গে সামান্য ময়দা মিশিয়ে মণ্ডা তৈরি করা হয়। মণ্ডা দিয়ে বানানো হয় বিভিন্ন সাইজের বালিশ। পরে তা ভাজা হয় চিনির গরম রসে। এরপর ঠান্ডা করেও চিনির রসে ডুবিয়ে রাখা হয়। এক সময় তা রসে টইটম্বুর হয়ে যায়। বিক্রির সময় বালিশের ওপর দেওয়া হয় ক্ষীরের প্রলেপ বা দুধের মালাই।

তবে মিষ্টি মুখরোচক করতে তা তৈরির সময় আরো কিছু কলা-কৌশলও প্রয়োগ করেন কারিগররা। তবে ব্যবসার স্বার্থে প্রকাশ করতে চান না কেউ। এমনটাই জানালেন কারিগর খোকন মোদক।

১৯৬৯-এ ভারত চলে যান বালিশের প্রস্তুতকারক ও গয়ানাথ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের স্বত্বাধিকারী গয়ানাথ ঘোষ। তখন তিনি দোকানটি তার কর্মচারী নিখিল মোদকের কাছে বিক্রি করে যান। এরপর নিখিল মোদকের মৃত্যুর পর এটি পরিচালনা করছেন তার তিন ছেলে বাবুল মোদক, দিলীপ মোদক এবং খোকন মোদক।

আরও পড়ুনঃ  বিধিনিষেধেও চলবে বাণিজ্যমেলা

বর্তমানে গয়ানাথ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের স্বত্ত্বাধিকারী বাবুল মোদক এই প্রতিনিধিকে জানালেন, বালিশের সুখ্যাতিতে তারা পরে একই নামে নেত্রকোনায় আরো তিনটি দোকান প্রতিষ্ঠা করেন। আর এখানকার বালিশ এখন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার অভিজাত দোকানগুলোতেও সরবরাহ করা হয়।

নেত্রকোণা সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক রুহিদাস দেবনাথ এই প্রতিনিধিকে বলেন, ঐতিহ্যবাহী বালিশ এখন নেত্রকোনার অনেক দোকানেই পাওয়া যায়। তবে গয়ানাথ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের বালিশের কদরই আলাদা।

তবে এই প্রতিনিধির সঙ্গে আলাপকালে বাবুল মোদক জানান, গাভীর খাঁটি দুধ ছাড়া বালিশ তৈরি হলে এর প্রকৃত স্বাদ পাওয়া যায় না। তাদের ৩টি দোকানে ৫০ জন কর্মচারী রয়েছেন। তার সঙ্গে যোগ দিয়েছেন তার ভাই দিলীপ মোদক।

তিনি বলেন, এসব দোকানে সাধারণত: ১০ থেকে শুরু ২০০ টাকা পর্যন্ত বিভিন্ন সাইজের বালিশ মিষ্টি তৈরি হয়। ২০০ টাকা মূল্যের বালিশ আকারে ১৩ থেকে ১৪ ইঞ্চি হয়। ওই মিষ্টির ওজন ৮০০ থেকে ১০০০ গ্রাম হয়ে থাকে। এর চেয়ে বেশি ওজনের বালিশও বানানো হয়। তবে তা অর্ডার দিলে তৈরি করা হয়।

এ অঞ্চলে বিয়ে-শাদি বা জন্মদিনের মতো অনুষ্ঠানে সাধারণত: বালিশ বাদ পড়ে না। এছাড়াও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে বেড়ানো, সামাজিক কিংবা অফিস-আদালতের অনুষ্ঠানেও খাবার তালিকায় এ মিষ্টিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। আর পাঠক আপনারাও নেত্রকোনায় বেড়াতে গেলে বালিশের রসাস্বাদন করতে ভুলবেন না কিন্তু।

সংবাদটি শেয়ার করুন