শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৫ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

উত্তাল একাত্তরের অশান্ত প্রহরগুলি

১৯৭১ সালের পহেলা মার্চ সেদিন সন্ধার খবর ছিল গরম গরম। দেশের পরিস্থিতি ছিল উত্তপ্ত রেডিওতে জাতীয় অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার খবর হলো। অজান্তেই সবাই জয় বাংলা বলে গর্জে উঠলো। সেকি উত্তেজনা সবার। আজ হোটেল পূর্বানীতে শেখ মুজিব প্রেস কনফারেন্স ডেকেছেন।

৩ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসীন হল থেকে রঞ্জুদা (আমার সেজো ভাই) বাড়ি চলে এলো। মহসিন হলের ছেলেরাও উত্তেজিত। জাতীয় অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার পর ঢাকায় ভীষণ গোলমাল শোনা গেল। ডাকসুর নেতারা পল্টনে সভা করলো। পাকিস্তানি ফ্লাগ ও জিন্নাহর ছবি পুড়িয়ে দিল। শেখ মুজিব ৩ মার্চ ঢাকা শহরে এবং পরদিন সারাদেশে হরতাল ডেকেছেন।

৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে গণজমায়েতের ঘোষণা দিয়েছেন। সন্ধ্যায় রেডিওতে কারফিউ ঘোষণা হলো। আব্বা রঞ্জুদাকে বললেন প্রতিদিনের দৈনিক পত্রিকা জোগাড় করে রাখিস। রঞ্জুদা কাকডাকা ভোরে উঠে বন্ধুদের সঙ্গে চলে গেল। ছোট একটা ছেলে এসে জানিয়ে গেল আজ খবরের কাগজ আসে নাই। আব্বার মুখটায় চিন্তার ছাপ ভেসে উঠল। মা পাশে এসে বসলেন। বাইরে জয় বাংলা স্লোগানের গগনবিদারী চিৎকার। রাস্তায় বিশাল জনতার মিছিল প্রকম্পিত জনপদ।

সারাদিন দুশ্চিন্তায় কেটে গেল প্রহরগুলো। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। রুটিন, খাওয়া-নাওয়ার খবর নাই কারও। আমরা দু-বোন চুপটি মেরে কান খাড়া করে অনিশ্চিত ভয়ে বসে আছি ঘরের কোনায়। তুতুল,নিনা, পুতুল(ছোট ভাইবোন) ছুটেছে মিছিলে। ফোনটা বেজে উঠলো, ফোনটা বেজে উঠলো, বাবা ফোন ধরলেন। ওপারের কণ্ঠে ভয় ভীতি জড়ানো মনে হলো। বাবার পিছু পিছু মা-ও এসে দাঁড়িয়েছেন পাশে। আব্বা ফোনটা রেখে বললেন, ঢাকার অবস্থা ভালো নয়। কেউ কারফিউ মানছে না। দলে দলে লোকজন রাস্তায় ব্যারিকেট দিচ্ছে।

আরও পড়ুনঃ  দর্শক বেশি ক্রেতা কম

পুলিশ গুলি চালাচ্ছে। গুলি খেয়ে লোকজন আরও খেঁপে উঠছে। কী হবে এখন! মা প্রায় কেঁদে ফেললেন। সন্ধ্যায় তুতুল ও পুতুল বাসায় ফিরে জানালো, মিছিলের পর ওরা সবাই একসঙ্গে পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়েছে। রঞ্জুদা প্রথমে আগুন দিয়ে ফ্লাগ জ্বালিয়েছে। পাড়ার বিহারী হক সাহেব কেমন কটাক্ষ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন। ভাষাহীন কটাক্ষ দৃষ্টি ছোটরাও বোঝে। অনেক রাতে রঞ্জুদা বাসায় ফিরে জানাল, আজ রাতে ঢাকায় কারফিউ এর জন্য ব্লাক আউট করেছে। মেজভাই রৌফদা ডেমরা ট্রেকট্রাইল থেকে রাতের ট্রেনে বাসায় ফিরেছে, হাতে খবরের কাগজ।

ঐদিন খবরের কাগজে ১১০ নম্বর সামরিক আদেশ জারি হয়েছে। পাকিস্তানের সংহতি বা সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী খবর বা চিত্র প্রকাশ নিষিদ্ধ। আদেশ লঙ্ঘনে দশ বছর কারাদণ্ড। কাগজে বিক্ষোভ মিছিলের খবর পড়লাম সবাই। আব্বা হতভম্বের মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বড় ভাইয়ের বাসা ঢাকায় খবর নিতে টেলিফোনের পাশে দাঁড়াতেই টেলিফোন বেজে উঠল। আব্বা আমি রিজু (আমার চতুর্থ ভাই, সে সময় করাচী ডাও মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছিল)। গত রাতের ফ্লাইটে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এসেছি ঢাকায়। সেখানে বাঙালিদের অবস্থা খুব ভালো নয়। আমি ফুফুমার ঢাকার বাসায় আছি এখন। দু’একদিনের মধ্যে বড় ভাইয়ের খবর নিয়ে বাড়ি আসব।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন