শনিবার, ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শত বছরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-আমাদের প্রত্যাশা

শত বছরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-আমাদের প্রত্যাশা

বাঁশি কই আগের মতো বাজে না

১৯৭৯-এর এক বিকেলে খুলনা থেকে ঢাকায় পাড়ি জমালাম। হোটেল শেরাটনের সামনে বিআরটিসি বাস থেকে নেমেই সোজা ক্যাম্পাসে। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সঙ্গে তেমন কোনো পরিচয় ছিল না। রিকশা থেকে শামসুন্নাহার হলের সামনে নামতেই দেখি আমার বোনটি হলের গেটে আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। তার দুচোখ ভরা স্বপ্ন ভাইটি ভর্তি পরীক্ষায় পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হবে। অনেক বড় হবে।

সেই থেকে শুরু স্বপ্ন দেখা। স্বপ্ন দেখেছিলেন আমার বাবা-মা, যেমনটি দেখেন সকলের বাবা-মা। যাই হোক ঠাঁই হলো নীলক্ষেত আবু সাঈদ হলে। না ঠিক হল নয়, হল সংলগ্ন গ্যারেজে। তাও হতো না, যদি না একজন পরিচিত কেউ থাকতো। গ্যারেজে মানুষ থাকে! প্রথম প্রথম এটি ভাবতে কষ্ট হলেও অবশ্য পরে ভালো লাগতে শুরু করলো। যখন ঐ গ্যারেজে সাথী হিসেবে পেলাম, মেহেরাব ভাই, হামিদুল আর রেজানুর-কে।

ভর্তির সুযোগ হয়েই গেল। এটাচ শহিদুল্লাহ হল, তবে সিট সে তো সোনার হরিণ। তাই যথারীতি গ্যারেজে। নবীন বরণে, ভাইস চ্যান্সলার শ্রদ্ধেয় ফজলুল হালিম চৌধুরী মনটাকে আরো চাঙা করে দিলেন। উনি তাঁর ভাষণের এক পর্যয়ে বললেন ‘যে ছেলেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায়, তাকে একটা গ্রাজুয়েশনের সার্টিফিকেট দেয়া যায়’ এর মর্মার্থ বুঝতে দেরি হয়নি। বুঝলাম দেশের সর্ব্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে সবার পড়ার সুযোগ হয়ে ওঠে না। আমি নিশ্চয়ই সৌভাগ্যবানদের একজন।

রেজানুর আর আমি অনেক রাত এক বেডে কাটিয়েছি। রাত জেগে জেগে স্বপ্ন দেখতাম। তখন ক্যাম্পাসে সাংস্কৃতিক অঙ্গণ ছিল খুবই প্রাণবন্ত। টিএসসি ছিল এর কেন্দ্রবিন্দু। রেজানুর লিখতো। সারারাত জেগে তৈরি করতাম দেয়াল পত্রিকা, টুকিটাকি। ছবি তুলে বাবা-কে পাঠাতাম। বাবা খুশি হতেন। প্রায়ই রাত বারোটার পরে আবু সাঈদ হলের মাঠে গানের আসর বসতো। চলতো কয়েক ঘণ্টা। মনে পড়ে ইকবাল ভাই, রতন ভাই, হেলাল ভাই আর হামিদের কথা। তারা আমার গানের ভক্ত ছিলেন। মাঝেমধ্যে সেই আসরে যোগ দিতেন আওরঙ্গ ভাই, রাউফুন বসুনিয়া, আরো অনেক নেতা। যাঁদের পরিচয় পরে জেনেছি। প্রতিদিনের আনন্দের জ্যোৎস্নায় ডুবে গিয়ে বাবা-মাকে ছেড়ে থাকার কষ্ট ভুলে যেতাম। প্রতিদিনের আনন্দ আমাকে দিতো উদ্দীপনা আর উন্মোচন করতো নিত্যনতুন স্বপ্নের দ্বার।

আরও পড়ুনঃ  মাদকের ভয়াল থাবায় আমাদের তারুণ্য

আমরা অনেকেই প্রতিদিন সকালে আবু সাঈদ হলের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে খেতাম ফুটপাতের রুটি, গুড় আর ডিম মামলেট। কখনও অর্ধেক ভাগ করে। ক্যাম্পাসের সেই রুটি-গুড়ের স্বাদই ছিল অন্যরকম। যা আজ অভিজাত কোনো রেস্টুরেন্টেও পাই না।

সকালে লাইন ধরে বাথরুম সেরে ক্লাসে। তারপর আবার রাতে গ্যারেজে। একটা কথা মনে উঠলে বেশ হাসি লাগে এখন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে প্রথম চিঠিটি বাবাকে লিখেছিলাম। কিন্তু ঠিকানা লিখতে গিয়ে বার বার হোঁচট খেলাম। গ্যারেজ আবার কোনো ঠিকানা হয় নাকি? সমস্যার সমাধান দিলো বন্ধু রেজানুর। সে বললো লেখো আবু সাঈদ হল গ্যারেজ সংলগ্ন। বাবা চিঠি পেয়েই পোস্টকার্ডে লিখলেন, ‘তুই কি সিট পাসনি বাবা’!

বাবা ঢাকা শহরে এসে আমি অনেক কিছুই পাইনি। তার মধ্যে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় যা ছিল তা হলো তোমার আর মায়ের সান্নিধ্য। আবার এমন কিছু পেয়েছি যা আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। চিনতে শিখিয়েছে, সমাজকে, মানুষকে, জীবনের প্রতিকুলতাকে।

একাশিতে কার্জন হল টিএসসি চত্বরে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে আমি বেশ ব্যস্ত। ডাক পড়তো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, ছাত্রলীগ, জাসদ, বাসদ, ছাত্র ইউনিয়নের আয়োজন। সাংস্কৃতিক জোটের র‌্যালিতে কাঁধে হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে গান করতাম, হেমাঙ্গ বিশ্বদাসের, মুকুন্দ দাসের, সলিল চৌধুরী অথবা প্রিয় লুৎফর ভায়ের। সেইসব মিছিল সমাবেশের প্রিয় অনেকের মুখ আজও চোখে ভাসে। তাদের অনেকেই আজ জীবনযুদ্ধে হারিয়ে গেছে। মনে পড়ে রুদ্র দা, হ্যাপী আকন্দ, জুয়েল, হাসান, বেলী, নিহার তারেকসহ আরো অনেকের কথা।

ঊনিশ ঊনআশির ক্যাম্পাসে ঢুকে যেমন অসহায় বোধ করেছিলাম, ছিয়াশিতে ক্যাম্পাস ছাড়তে তার চেয়ে বেশি কষ্ট বোধ করলাম। মনে হচ্ছিল দীর্ঘদিনের ক্যাম্পাস, তার মধ্যে গড়ে ওঠা অভিজ্ঞতাই আমার জীবনের সব, সবকিছু। যে বাবা-মা কোলে পিঠে পনের বছর লালন করলেন, কত সহজেই ক্যাম্পাস আর রাজধানীর রঙিন হাতছানি আমাকে সব কিছু ভুলিয়ে দিল। যে স্বপ্নের আলো তাঁরা দুচোখে জ্বেলে দিয়েছিলেন তা ক্রমান্বয়ে ডালপালা প্রসারিত করছে এখনও।

আরও পড়ুনঃ  করোনা উত্তর ৭ কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম

এখন বয়স কিছুটা গতি কমিয়েছে ঠিকই, তবুও মন টানে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। সময় পেলেই ঘুরে দেখে আসি স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে। থমকে দাঁড়াই টিএসসি, দোয়েল চত্বর, কলাভবন, নীলক্ষেত-এ। স্মৃতিরা এসে ভিড় জমায়। ভালোবাসায় মনটা ভরে যায়। মনে করতে চেষ্টা করি নস্টালজিয়া ভরা প্রিয় অতীতকে। হঠাৎ হঠাৎ মনে হয় ঐ তো ওখানে দাঁড়িয়ে প্রিয় বন্ধু সহপাঠি আমাকে বলছে, দোস্ত চল আজ নিউমার্কেট ঘুরে আসি, বলাকায় ছবি দেখি।
চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই জামান স্যার টিএসসি-তে ঘুরছেন। পিতৃস্নেহে কাছে ডেকে নিয়ে বলছেন ‘শুধু গান বাজনা করলে হবে না, পড়তে হবে’, মুকুলবোস চিৎকার করে বলছে, ‘সূর্যসেন হলের অনুষ্ঠানে গান গাইতে হবে ভাইটি’, চুন্নুভাই হাতে পঞ্চাশ টাকা গুঁজে দিতে দিতে বলছেন, ‘ফাংশন টা চালিয়ে নিও লেমন’। পিয়ারুভাই বলছেন ‘লেমন ইউনিভার্সিটি ফটোগ্রাফিক সোসাইটিকে বড় করতে হবে’। মিনু বলছে, ‘রাত হয়েছে বাসায় ফিরতে হবে’।

বন্ধুরা আমি ফিরে পেতে চাই আবার আমার ক্যাম্পাসের সেই সোনালি দিন। ভাগ করে খেতে চাই বন্ধুদের নিয়ে হাকিম চত্বর বা মধুর ক্যান্টিনের নাশতা। পেতে চাই প্রিয় বাবা-মার মমতা, আর আমার সেই উদ্দীপনা ও সাহস। যে সাহসে আমি গলা ছেড়ে মিটিং মিছিলে গাইতাম ‘তোমার ভয় নেই মা, আমরা প্রতিবাদ করতে জানি’ অথবা ‘সাথীদের খুনে রাঙা পথে দেখো হায়নার আনাগোনা’।

শত বর্ষের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রিয় ক্যাম্পাস তুমি দীর্ঘজীবী হও। তোমার অঙ্গণ আবার ভরে উঠুক মমতা আর আনন্দ উল্লাসে। দূর হোক সকল হিংসা, হানাহানি। সংস্কৃতি চর্চ্চায় মুখরিত হোক টিএসসি, কার্জন হলসহ পুরো ক্যাম্পাস। প্রিয় ক্যাম্পাস, আগামী প্রজন্ম যেন তোমাকে ঘিরে স্বপ্ন দেখতে শেখে, সুন্দর জীবনের জন্য, এই হোক আমাদের প্রত্যাশা।

আরও পড়ুনঃ  ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে একুশে পদকে ভূষিত করা হোক

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন