ঢাকা | শুক্রবার
২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আবেগ নয়, বিবেক দিয়ে বিচার করুন

সাজ্জাতুল সবুজ

“অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত কোনো অভিযুক্ত-ই অপরাধী নয়”। কোনো মামলার ক্ষেত্রে আদালত বাদী-বিবাদী উভয়পক্ষের বক্তব্যের উপর ভিত্তি করেই মামলার রায় প্রদান করেন। উভয়পক্ষের বক্তব্য-ই সমান গুরুত্বপূর্ণ। একপক্ষের বক্তব্যের উপর ভিত্তি করে বিচারকার্য সম্পাদন করা হলে সেখানে ন্যায়বিচার মুখ থুবড়ে পড়ে। আইনজীবীর পরামর্শ নেওয়া এবং বক্তব্য পেশ করা অভিযুক্তের সাংবিধানিক অধিকার।

সম্প্রতি সিলেট এমসি কলেজের গণ-ধর্ষণ মামলায় অভিযুক্তদের পক্ষে সিলেট আইনজীবী সমিতির না দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচুর সাড়া ফেলেছে। যশোরের গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতি ঐক্যবদ্ধভাবে কোনধরনের ধর্ষণ মামলার বি-বাদীর পক্ষে না দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

ধর্ষণ বা খুনের মত মামলায় বিবাদীর পক্ষে কোনো আইনজীবী কোর্টে দাঁড়ালে তাকে সামাজিকভাবে বিভিন্ন বাজে পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাধারণ জনগণের বাজে মন্তব্যের শিকার হতে হয়। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ধর্ষণ মামলাগুলোতে অভিযুক্তের পক্ষে কোনো আইনজীবীকে না দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিয়মিতভাবে ঝড় তুলছেন সাধারণ জনগণ। সুষ্ঠু বিচারকার্য সম্পন্ন এবং আদালতে অপরাধ প্রমাণিত হওয়া ব্যতীত কাউকে অপরাধী বলার উপায় না থাকলেও বর্তমান সময়ে কোর্টের রায়ে নয়, বিচারকার্য অনেকটুকু-ই সম্পন্ন হয়ে যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই। সোশ্যাল মিডিয়ায় সাধারণ জনগণ নিজেদের মতাদর্শে-ই দিয়ে দিচ্ছেন বিভিন্ন আলোচিত-সমালোচিত মামলায় রায়। পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের বিচারকার্য শেষে অভিযুক্ত ব্যক্তি নির্দোষ প্রমাণিত হলেও অভিযুক্ত এবং তার পরিবারকে সামাজিকভাবে কোণঠাসা হয়ে থাকতে হয়।

যদিও মিথ্যা মামলার উদাহরণও রয়েছে প্রচুর। “জয়পুরহাটে ধর্ষণের মিথ্যা মামলা করায় বাদীকে ৫ বছরের কারাদণ্ড” প্রতিশোধ প্রবণ হয়ে শত্রুকে শাস্তি পাওয়ানোর উদ্দেশ্যে এই মামলা করা হয়েছিলো।(ডিবিসি নিউজ) জয়পুরহাটের-ই আরও একটি মামলায়, জমি নিয়ে বিরোধ থেকে শত্রুর বিরুদ্ধে নিজের প্রতিবন্ধী মেয়ে শিশুকে ধর্ষণের মামলা করেন পিতা এবং মিথ্যা মামলা প্রমাণিত হওয়ায় বাদী কে ৫ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। (বিডিনিউজ২৪)

বাংলাদেশ সংবিধানের ২৭ নং অনুচ্ছেদ আইনে সবার জন্যে সমতা এবং ৩১ নং অনুচ্ছেদ প্রত্যেকের আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার নিশ্চিত করে। ৩৩(১) অনুচ্ছেদ অভিযুক্তের মনোনীত আইনজীবীর সহিত পরামর্শের ও তাঁহার দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকারের বিষয়টি নিশ্চিত করে। বাংলাদেশ সংবিধানের ২৭-৪৪ নং অনুচ্ছেদ মৌলিক অধিকার হওয়ায় এগুলো আইন দ্বারা স্বীকৃত। এছাড়াও ভারতে ‘শুভরাম বনাম দ্য স্টেট অফ মধ্যপ্রদেশ’ মামলায় কোর্ট জানায়, কোনো আইনগত বিধান অনুচ্ছেদ ৩৩(১) লঙ্ঘন করলে সে বিধান বাতিল বলে গণ্য হবে।

আইনজীবী দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকারটির পুনরাবৃত্তি হয় ‘মোছলেউদ্দিন বনাম চিফ সেক্রেটারি’ মামলায়। এ মামলায় বলা হয়, “যেহেতু মৌলিক অধিকার সেহেতু আইন দ্বারা প্রয়োগ্য। কোন মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তখন পলাতক অভিযুক্তেরও আত্মপক্ষ সমর্থন করার অধিকার রয়েছে। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনের অভিযুক্তদের পক্ষেও আইনজীবী নিয়োগ করা হয়েছিল। “রাষ্ট্র বনাম নুরুন নাহার জামান” মামলায় কোর্ট আকস্মিক এবং যুগান্তকারী রায় দেন। ফৌজদারি আইন-১৮৯৮ এর ধারা ৩৪০ অনুযায়ী ফৌজদারি মোকদ্দমায় প্রত্যেক অভিযুক্তের-ই তার আইনজীবী দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার রয়েছে। একই বিধান ‘রাষ্ট্র বনাম হানিফ গণি’ মামলায়ও দেওয়া হয়। আরও বলেন, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্যেই এই বিধান, অপরাধীকে বাঁচানোর জন্যে নয়।

কমন ল এর উত্তরসূরি হওয়ায় বাংলাদেশ বিচার ব্যবস্থায় বিবাদী নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষে তাদের অভিযোগ দায়ের করে। উন্মুক্ত আদালতে নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের সামনে বি-বাদীপক্ষ তাদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে প্রমাণ পেশ করে এবং বাদীপক্ষ তার আত্মপক্ষ সমর্থনে বক্তব্য এবং প্রমাণাদি পেশ করে। উভয়পক্ষকেই নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের উপস্থিতিতে তাদের বক্তব্য উপস্থাপন, বিতর্ক, কারণ দর্শানো এবং প্রমাণ দাখিল করার সুযোগ দেওয়া হয়। উভয়পক্ষের উপস্থাপিত প্রমাণের প্রেক্ষিতে বিচারক মামলার রায় দেন। সুষ্ঠু বিচারকার্য সম্পাদনার ক্ষেত্রে বিবাদীর পক্ষে আইনজীবী থাকা আবশ্যক।

বিবাদী পক্ষের বক্তব্য না শুনেই চূড়ান্ত রায় দেওয়া স্বৈরাচারী এবং অন্যায্যের পর্যায়ে পড়ে। ন্যাচারাল জাস্টিসের কয়েকটি মূলনীতির মধ্যে একটি ‘Audi alteram partem’ অর্থাৎ ‘কারো বক্তব্য না শুনেই কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না’। অভিযুক্তের অবশ্যই তার আইনজীবী পরামর্শ সাপেক্ষে তার বক্তব্য পেশ করার সুযোগ থাকতে হবে।

“আব্দুল লতিফ বনাম বাংলাদেশ সরকার” মামলায় মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আপিলেড ডিভিশন ন্যাচারাল জাস্টিসের নীতিকে দেশের আইনের একটি অংশ হিসেবে নিশ্চিত করেন। এছাড়াও “হরি বিষ্ণু কামাথ বনাম আহমেদ ইশতিয়াক” মামলায় ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট ‘অডি আল্টেরেম পার্টেম’ লঙ্ঘন করে বিচারকার্য সম্পন্ন করাকে অবৈধ বিচার বলে গণ্য করেন।

নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক চুক্তি, ১৯৬৯ এর ১৪(২) অনুচ্ছেদে ক্রিমিনাল কেসে অভিযুক্তের সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে। অনুচ্ছেদটি লাতিন ম্যাক্সিম ‘ei incumbit probatio qui dicit, non qui negat’ বা ‘নিরপরাধের ধারণা’ যার বাংলা বিশ্লেষিত অর্থ “যে ব্যক্তি অভিযোগ দায়ের করে প্রমাণ করার দায়িত্ব তার, যিনি অভিযোগ অস্বীকার করতেছেন তার নয়।”

যা পুনরায় মানবাধিকার সার্বজনীন ঘোষণাপত্র-১৯৪৮ এর ১১(১) অনুচ্ছেদে আলোচনা করা হয়েছে যে, কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তি অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত নিরপরাধ।

আন্তর্জাতিক আইনের এই অনুচ্ছেদগুলো বাংলাদেশের সংবিধানের সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ। নিউটনের তৃতীয় সূত্রানুযায়ী প্রতিটি ক্রিয়ারই সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে। মুদ্রার দুইটি দিক রয়েছে। তেমনি মিথ্যা ধর্ষণ মামলারও অস্তিত্ব রয়েছে যা ন্যায়বিচারকে বাধাগ্রস্ত করছে।

সত্যকে খুঁজে বের করতে, আসল অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করতে এবং নিরপরাধকে বাঁচাতে ফেয়ার ট্রায়াল নিশ্চিতকরণ প্রয়োজন। আর ন্যায্য-বিচারের প্রাথমিক উপাদান-ই হচ্ছে উভয়পক্ষে আইনজীবী দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থন নিশ্চিতকরণ। জনসাধারণের অনুভূতি যেন কখনোই আইনগত বিধান অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়ার অন্তরায় না হতে পারে। ফেয়ার ট্রায়াল হোক, অপরাধীরা শাস্তি পাক। আইনের সুশাসন নিশ্চিত হোক।

লেখক: সাজ্জাতুল সবুজ, শিক্ষার্থী
আইন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

আনন্দবাজার/শাহী/সবুজ

সংবাদটি শেয়ার করুন