বেল্লাল আহমেদ ভূঞা অনিক
গ্রীক দার্শনিক প্লেটো আজ থেকে আড়াই হাজার বছর পূর্বে ‘দ্য রিপাবলিক’ গ্রন্থে একটি আদর্শ রাষ্ট্রের সম্পূর্ণ জীবনব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করেছেন। রিপাবলিকে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা রয়েছে আদর্শরাষ্ট্রে শিক্ষার উদ্দেশ্য, পদ্ধতি ও স্বরূপ কী হবে- এসব বিষয়কে কেন্দ্র করে। প্লেটো শিক্ষাকে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কল্যাণের উপযুক্ত মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করেছেন এবং সুশিক্ষার মাধ্যমে সুনাগরিক গড়ে তোলার কথা বলেছেন। শিক্ষাদর্শনের ক্ষেত্রে প্রাচীনকালের মহামতি প্লেটো থেকে শুরু করে যুগে যুগে বিভিন্ন দার্শনিক ও শিক্ষাচিন্তাবিদরা বিভিন্ন দর্শনের আলোকে শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য উন্মোচনের মাধ্যমে শিক্ষাদর্শন বিনির্মাণে সচেষ্ট হয়েছেন।
বাঙ্গালি জাতির মহান শিক্ষক ও দার্শনিক শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫) এর শিক্ষা ভাবনায় ছিলো মৌলিকত্ব, অভিনবত্ব ও বাস্তবিকতা। প্লেটোর শিক্ষাদর্শন একটি আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সূত্র থেকে উৎসারিত আর শেখ মুজিবুর রহমানের শিক্ষাদর্শন স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণের লক্ষ্য থেকে উৎসারিত। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শনের মূলে ছিলো, শিক্ষাখাতে সর্বোচ্চ পুঁজি বিনিয়োগ করে বাংলার মানুষকে গণতন্ত্র, দেশপ্রেম, জ্ঞান ও দক্ষতা, মানবতা, নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করে একটি বৈষম্যহীন, প্রগতিশীল, বিজ্ঞানমনস্ক, অসাম্প্রদায়িক ও নৈতিকমূল্যবোধসম্পন্ন স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণের অমূল্য দিকনিদের্শনা। মূলত বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন থেকেই শিক্ষাদর্শন উৎসারিত।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক দর্শন, দার্শনিক চিন্তা, রাষ্ট্র ভাবনা এবং সমাজচিন্তাসহ সকল চিন্তা-চেতনা ও দর্শনের মূলে রয়েছে বাংলার গণমানুষের মুক্তি। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শন একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের আলোকে পর্যালোচনা করতে হবে। শিক্ষা অধিকার প্রতিষ্ঠায় মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিনি প্রথম কারাবরণ করেন। তিনি বেঁচে ছিলেন মাত্র ৫৪ বছর, এর মধ্যে ৩০৫৩ দিন কেটেছে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। তিনি বাংলার মাটি ও গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি কল্যাণকর জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, যেখানে শিক্ষা হবে আলোকবর্তিকাস্বরূপ ও উন্নয়নের সোপান। মূলত বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা ভাবনা তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের অন্যতম ভিত্তি। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী মোট ছয়টি প্রধান শিক্ষা কমিশন গঠনের মধ্য দিয়ে শিক্ষা নিয়ে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এর বিপরীতে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন সময় শিক্ষানীতির বৈষম্যমূলক সুপারিশের প্রতিবাদে সবসময় ছাত্র-শিক্ষক-জনতার পাশে থেকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন এবং গণমুখী, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মনস্ক, মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষাতত্ত¡ উপস্থাপন করেন যা এক মৌলিক শিক্ষাদর্শনের প্রতিচ্ছবি। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শনের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে: গণমুক্তির মানবতাবাদী রাষ্ট্রদর্শন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে তিনি প্রথমে মনোযোগি হয়েছিলেন যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশের শিক্ষাকে পূণর্গঠনের এবং ঘোষণা করেছিলেন-“শিক্ষাই হবে মুক্তির হাতিয়ার”। এই মুক্তি হবে গণমুক্তি, মানবতার মুক্তি, অর্থনৈতিক মুক্তি, শোষণ-বৈষম্য থেকে মুক্তি এবং সর্বোপরি মানবিক মূল্যবোধ ও চেতনা বিকাশের মাধ্যমে গণমুক্তির রাষ্ট্রদর্শন প্রতিষ্ঠা।
বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শনের বিভিন্ন উৎস পাওয়া যায় ১৯৪৭ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত বিভিন্ন ভাষণ, আওয়ামী লীগের ঘোষিত কর্মসূচি, ১৯৭০ এর নির্বাচনী ইশতেহার, ১৯৭২ এর মূল সংবিধান, কুদরাত-ই-খুদা কমিশনের প্রতিবেদন, ১৯৭২-১৯৭৫ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্র পরিচালনায় তাঁর গৃহীত পদক্ষেপ, তাঁর গ্রন্থ ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ‘কারাগারের রোজনামচা’ ‘আমার দেখা নয়া চীন’ সহ বিভিন্ন গবেষণাধর্মী পত্রিকা ও নানা কর্মকান্ডের মাধ্যমে তাঁর শিক্ষাদর্শন সম্পর্কিত চিন্তাচেতনা, পরিকল্পনা ও প্রায়োগিক দিকগুলো ফুটে ওঠে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু একজন রাষ্ট্রচিন্তাবিদ, রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়কই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন শিক্ষাদার্শনিকও। তিনি দেশের মানুষকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে দক্ষ জনসম্পদে রূপান্তরিত করতে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু শিক্ষার উপর যে অধিক গুরুত্বারোপ করেছেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৭৩ সালের স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাজেটে। শিক্ষা খাতে সে বাজেটে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিলো, প্রতিরক্ষা খাতের চেয়ে শিক্ষাখাতে ৭% (৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা) বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিলো।
১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ড. কুদরত-এ-খুদার নেতৃত্বে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ‘প্রথম শিক্ষা কমিশন’ গঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শনের প্রতিফলন কুদরাত-এ-খুদা কমিশনের রির্পোটে প্রতিফলিত হয়েছিলো। “বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সুস্পষ্টবোধ শিক্ষার্থীর চিত্তে জাগ্রত করে তাকে সুনাগরিকরূপে গড়ে তোলাই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার অন্যতম লক্ষ্য”- এই কমিশন দুই বছর নিরন্তর কাজ করে তাঁদের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন তৈরি করে। এই কমিশনের সুপারিশের বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার দিকগুলো গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চশিক্ষা, কারিগরিসহ সব ক্ষেত্রে মানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। তবে তিনি আমূল পরিবর্তনটা করেছিলেন প্রাথমিক ও উচ্চশিক্ষায়। যুদ্ধবিধ্বস্ত নানা সমস্যায় জর্জরিত সদ্য স্বাধীন একটি দেশের ভঙ্গুর অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্যে দাঁড়িয়েও তিনি সাড়ে সাঁইত্রিশ হাজার প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করেছেন, এগারো হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন, ৪৪ হাজার শিক্ষক নিয়োগ ও চাকরি সরকারিকরণ, ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বই প্রদানের ব্যবস্থা করেছেন। উচ্চশিক্ষা প্রসার এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে মুক্তবুদ্ধির চর্চাকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে স্বৈরশাসক আইয়ুব খান প্রণীত কালো অধ্যাদেশ বাতিল করে দেশের চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করেছেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক দর্শন, সমাজদর্শন ও শিক্ষাদর্শনের মৌলিক বিষয়গুলো প্রতিফলিত হয়েছে ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে। তাঁর শিক্ষাদর্শন ছিলো: গণমুক্তির মানবতাবাদী দর্শন। তিনি বিশ্বাস করতেন গণমুখী শিক্ষা ছাড়া অর্থনৈতিক ও মৌলিক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। আর তাঁরই নির্দেশনায় সংবিধানের ১৭ নং অনুচ্ছেদে একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
বঙ্গবন্ধু সোনার দেশে সোনার মানুষ গড়ে তোলার লক্ষ্যে শিক্ষার গুণগতমান উৎকর্ষ সাধনের জন্য সংবিধানে শিক্ষা বাধ্যতামূলক, প্রাথমিক শিক্ষা সরকারিকরণ, কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন, গণশিক্ষায় অর্থ বরাদ্দ, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার উন্নয়ন, জাতীয় গ্রন্থাগার স্থাপন, মাদ্রাসা বোর্ড গঠন, বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ জারি, তরুণ শিক্ষকদের বৃত্তির ব্যবস্থা করা, কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড গঠন, নারী শিক্ষার প্রসারসহ নানা যুগান্তরকারি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
পরিশেষে বলা যায়, সুদীর্ঘ আড়াই হাজার বছর পূর্বে উপস্থাপিত গ্রীক দার্শনিক প্লেটোর শিক্ষাদর্শন এখনও প্রাসঙ্গিক, ঠিক তেমনি বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা ভাবনা ও শিক্ষাদর্শন প্রাসঙ্গিক এবং এর উপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে বাংলাদেশের শিক্ষানীতি। উভয়ের শিক্ষাদর্শনের মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ছিলো কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে আলোকিত মানুষ সৃষ্টির মাধ্যমে জাতীয়, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির পথ দেখিয়েছে। বাঙ্গালি জাতির আত্মপ্রকাশ, সাহসিকতা ও স্বাধীনতার প্রতীক শেখ মুজিবুর রহমানের চিন্তা-চেতনায় ছিলো বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা, তিনি আমাদের অনুপ্রেরণার অনিঃশেষ বাতিঘর। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, রাষ্ট্রচিন্তা, শিক্ষাদর্শন ও শিক্ষা ভাবনাকে অনুসরণ ও প্রয়োগ করে আমরা স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে সক্ষম হবো।
লেখক: বেল্লাল আহমেদ ভূঞা অনিক
প্রভাষক, দর্শন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
আনন্দবাজার/শাহী