ঢাকা | শনিবার
২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সীসার বিষক্রিয়া থেকে বাচঁতে হবে

নুরুদ্দিন আহমেদ

গত ৩০শে জুলাই ইউনিসেফ ও পিওর আর্থ প্রকাশিত এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে সীসা বিষয়ক এক ভয়ংকর তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়; সীসার বিষক্রিয়ায় শিশুরা ব্যাপক হারে এবং আগের চেয়ে অজানা মাত্রায় আক্রান্ত হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে প্রতি তিনজন শিশুর একজন বা প্রায় ৮০ কোটি শিশুর রক্তে সীসার মাত্রা প্রতি ডেসিলিটারে পাঁচ মাইক্রোগ্রাম বা তার বেশি। অর্থাৎ এসব শিশুর রক্তে সীসার মাত্রা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে।

বিংশ শতাব্দীতে সভ্যতার উৎকর্ষতার ফলে আবিষ্কার হয়েছে নানান প্রযুক্তি, জীবন হয়েছে আরো সহজ। তবে মানবসৃষ্ট সব আবিষ্কারে ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিকই থাকে। ইতিবাচক দিকটাকে স্বাগত জানিয়ে এবং নেতিবাচক দিক থেকে কিভাবে নিজেদের রক্ষা করতে হবে সেই পদ্ধতি আবিস্কার করতে হয়। সেইসাথে সুষ্ঠুভাবে সেই নিয়ম কানুনগুলো মেনে চলতে হয়। তবেই তা মানবজাতির জন্য সার্বিকভাবে সুফল বয়ে আনে।সীসা হলো একটি মৌলিক যৌগ। যার রাসায়নিক সংকেত পিবি(চই) এবং এর পারমাণবিক সংখ্যা ৮২। সীসা অম্ল এসিড ব্যাটারি, গোলাবারুদ, সিসড গ্লাস,পেইন্টস, জল পরিবহনের পাইপ,সিরামিক সহ নানান কাজে ব্যবহার করা হয়। গাড়ির ব্যাটারি এবং সীসা এসিড ব্যাটারির একটি প্রধান উপাদান এটি।

সীসা-আর্সনেট কীটনাশক তৈরিতে, টেট্রায়িহিলে সীসা পেট্রোলের আ্যন্টিকথমক যৌগ হিসেনে ব্যবহৃত হয়। গত কয়েক দশক যানবাহনের পরিমাণ বিপুল বেড়ে যাওয়ায় সীসার ব্যবহারও বেড়ে গেছে। সীসা প্রয়োজনীয় বস্তু হলেও এটি মানুষের শরীরের জন্য খুবই ক্ষতিকর; বিষতূল্য।বিশেষ করে শিশু ও গর্ভবতী মায়েদের জন্য এটি মারাত্মক বিপর্যয় বয়ে আনে।কোন শিশু সীসার বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হলে তার পরবর্তী জীবনে কিডনি নষ্ট হওয়া এবং কার্ডিওভাসকুলার রোগে আক্রান্ত হওয়া সহ মারাত্মক ক্ষতির কবলে পড়তে পারে। শৈশবে সীসাজনিত বিষক্রিয়ায় শিকার হওয়া শিশুদের জীবনভর সম্ভাব্য অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলির প্রায় এক ট্রিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ ক্ষতি হয়। প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় ছোট বাচ্চাদের জন্য সীসা অনেক বেশি বিপজ্জনক। সীসা বিকাশশীল স্নায়ুতন্ত্রকে লক্ষ্য করে এবং ক্রমবর্ধমান ডোজ সহ বুদ্ধিমত্তাকে হ্রাস করে বাংলাদেশে আনুমানিক তিন কোটি ৫৫ লাখ শিশুর রক্তে সীসার মাত্রা গ্রহণযোগ্য মাত্রার বেশি রয়েছে।

করোনা আমাদের শিখিয়ে দিয়েছে আমাদের সাস্থ্য খাত কত দুর্বল।২০ কোটি মানুষের জন্য মাত্র ১১২টি আইসিইউ ইউনিট; যা মোট জনসংখ্যার জন্য একেবারে অপ্রতুল। স্বাস্থ্যখাতে ক্রমবর্ধমান হারে ব্যয় বাড়ালেও বিশাল দুর্নীতির কারণে জনগণ তেমন সুফল পাচ্ছে না। এখন সীসার বিষক্রিয়া যদি ব্যপক হারে দেখা দেয়, সরকারের পক্ষে তা সামাল দেয়া যে কঠিন হয়ে যাবে তা সহজেই অনুমেয়। এ দেশের মানুষ স্বাস্থ্যের প্রতি একদিকে যেমন উদাসীন অন্যদিকে কুসংস্কার প্রবণতা। সীসার বিষক্রিয়া সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষ অজ্ঞাত।

সীসার ভূমিকাজনিত কারণে বাংলাদেশে আইকিউ হ্রাস পাওয়ায় অর্থনৈতিক যে ক্ষতি হয়, তা দেশের জিডিপির ৫.৯ শতাংশেরএ সমান। বাংলাদেশের মানুষের রক্তে সিসার উপস্থিতির গড় হার ৬.৮৩ মাইক্রোগ্রাম বা ডেসিলিটার, যা সর্বোচ্চ হারের দিক থেকে বিশ্বে ১১তম। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোয় বসবাসকারী শিশুদের মধ্যে সিসাজনিত বিষক্রিয়ায় প্রধান ভূমিকা রাখে সিসা-এসিড ব্যাটারিগুলোর অনানুষ্ঠানিক ও নিম্নমানের পুনর্ব্যবহার। যা ২০০০ সালের পর থেকে যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে তিন গুণ বেড়েছে। যানবাহনের মালিকানা বৃদ্ধির পাশাপাশি গাড়ির ব্যাটারি পুনর্ব্যবহার বিষয়ক নিয়মকানুন ও অবকাঠামোগত ঘাটতি অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে প্রায় ৫০ শতাংশ সিসা-অ্যাসিড ব্যাটারি অনিরাপদভাবে পুনর্ব্যবহারে ভূমিকা রাখে।

বাংলাদেশের ঢাকা নগরিতেই প্রায় দুই কোটি মানুষের বসবাস। জনসংখ্যার সাথ পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলছে যানবাহন। ঢাকার কোন রাস্ততেই এখন যানবাহনের ঘন্টায় গতিবেগ ৮ কিলোমিটারের বেশি নয়।বুঝাই যাচ্ছে সীসার চাহিদা ব্যপক। এই সীসার চাহিদা মেটাতে নামে বেনামে গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিত, অস্বাস্থ্যকর সীসা কারখানা। এসবের অধিকাংশ অনিবন্ধিত। খুলনা নগরের আবাসিক এলাকায় অন্তত ৩০টি, ময়মনসিংহ অ ল ও কাঠগড়াতে বেশ কয়েকটি সহ দেশের নানা প্রান্তে অবৈধ কারখানা গড়ে উঠেছে। সীসা কারখানা গড়ে তোলা পরিবেশ আইনে একেবারে নিষিদ্ধ। কিন্তু কারখানাগুলো রাজনৈতিক ক্ষমতাশীলদের ছত্রছায়ায় গড়ে উঠায় কারখানা মালিকদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপও নেয়া যায় না। তাছাড়া লাভজনক ব্যবসা হওয়ায় কোথাও বাধাগ্রস্ত হলে এরা শীঘ্রই নতুন জায়গায় কারখানা স্থানান্তর করে ফেলে। সীসা বাতাসে পোড়া হলে তার গুড়ো আকারের ধাতুটি নীল সাদা,শিখা তৈরি করে। সীসা কারখানা থেকে সীসা ধুলাবালি ও বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে।

বর্তমানে ঢাকার রাস্তার ধুলাবালিতে অস্বাভাবিক মাত্রায় সীসা দেখা যাচ্ছে; বিষয়টি উদ্বেগজনক। সিসার মাত্রা বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে সিসা – এসিড ব্যাটারির পুনঃ ব্যবহার করার লক্ষ্যে গড়ে উঠা অপরিকল্পিত সীসা কারখানা। এসকল কারখানা গড়ে উঠার ফলে কারখানার আশেপাশের লোকজনের মধ্যে বিশেষ করে শিশু ও গর্ভবতী মায়েদের মাঝে বিষক্রিয়া দেখা দিচ্ছে। তাদের মধ্যে হরমোনজনিত রোগ,পরিপাকতন্ত্রের জটিলতা, কোষ্ঠকাঠিন্য, বমিভাব, ক্ষুধামন্দা, রক্তশূন্যতা, উচ্চ রক্তচাপ, বিষন্নতা ও স্নায়ুবিক বৈকল্য সহ নানান রোগের সৃষ্টি করছে। আমরা খুব সহজেই অনুধাবন করছি, এসকল অবৈধ কার্যক্রম শক্ত হাতে দমন করতে না পারলে অচিরেই সীসার বিষক্রিয়ায় দেশের মানুষকে মারাত্মক কুফল ভোগ করতে হবে।

বাংলাদেশে সীসার বিষক্রিয়া শুধু কারখানা থেকেই ছড়ায় না, পেইন্টের বোতলে মাত্রাতিরিক্ত সীসা ব্যবহার করা হয়। নিম্ন মানের মসলা হলুদের রং কে উজ্জ্বল করার জন্য লেড ক্রোমেট ব্যবহার করা হয়, যা বাজারে কাঠালি রং হিসেবে পরিচিত। এছাড়াও বাজারে বিভিন্ন প্রকার খাদ্যদ্রব্যে সীসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে । যার ফলে খুব সহজেই সীসা দেহের ভিতরে প্রবেশ করছে।বাংলাদেশ সেন্টার ফর কমিউনিকেশন প্রোগ্রামস (বিসিসিপি) এবং যুক্তরাষ্ট্রের জন্স হপকিন্স বুক্সেমবার্গ স্কুল অব পাবলিক হেলথের এক যৌথ গবেষণা থেকে উঠে এসেছে, সব ধরনেরতামাকজাত পণ্যের ভেতরেই সীসা, ক্রোমিয়াম ও ক্যাডমিয়ামের অস্তিত্ব রয়েছে বাংলাদেশে। ভয়ের বিষয় হলো একজন প্রাপ্ত বয়ষ্ক লোকের শরীরে ২০ থেকে ৩০গ্রাম সীসা জমা হলে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি মারা পর্যন্ত যেতে পারে।

মোদ্দাকথা, সামনের দিনগুলোতে জনগণকে সীসার বিষক্রিয়া থেকে বাচাঁতে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ জোরদার ও বাস্তবায়ন করতে হবে। সেক্ষেত্রে সরকার, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়,অধিদপ্তর যেসব পরামর্শ আমলে নিয়ে সামনের দিকে এগুতে পারে। এক. রক্তে সীসার মাত্রা পরীক্ষার জন্য সক্ষমতা গড়ে তোলাসহ পর্যবেক্ষণ এবং প্রতিবেদন তৈরির ব্যবস্থা; দুই. নির্দিষ্ট কিছু সিরামিকস, রং, খেলনা ও মসলার মতো সীসাযুক্ত উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ স্থান ও পণ্যের সংস্পর্শে শিশুদের আসা ঠেকানোসহ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ; তিন. স্বাস্থ্যব্যবস্থা যাতে শিশুদের মাঝে সীসার বিষক্রিয়া শনাক্ত, পর্যবেক্ষণ ও চিকিৎসার জন্য যথাযথভাবে প্রস্তুত থাকে সেজন্য এগুলো শক্তিশালী করা ছাড়াও ব্যবস্থাপনা, চিকিৎসা ও প্রতিকারের ব্যবস্থা করা; চার. সীসার সংস্পর্শে আসার বিপদ ও এর উৎসগুলো সম্পর্কে নিয়মিত গণশিক্ষামূলক প্রচার চালানো ও জনসচেতনতা সৃষ্টি করা; পাঁচ. শিশুদের সীসার সংস্পর্শে আসার নেতিবাচক প্রভাবগুলো সম্পর্কে সচেতন করতে তাদেরকে বিস্তৃত শিক্ষা প্রদান; ছয়. সীসা এসিড ব্যাটারি ও ই-বর্জ্য উৎপাদন এবং আবার ব্যবহারযোগ্য করার জন্য পরিবেশগত, স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা মানদন্ড গড়ে তোলা, বাস্তবায়ন ও প্রয়োগ করা; সাত. ব্যবহৃত সীসা এসিড ব্যাটারি পুনর্ব্যবহার এবং পরিবহন ঘিরে আন্তর্জাতিক মান ও নিয়মনীতি তৈরি করাসহ বৈশ্বিক ও আ লিক পদক্ষেপ গ্রহণ; আট. ধাতু গলানোর কার্যক্রমের জন্য পরিবেশগত নিয়মকানুন, সীসার অবৈধ কারখানা নিরসন ও খাদ্যে সীসার ব্যবহার নিষিদ্ধকরণ বিষয়ক কঠোর আইন তৈরি ও বাস্তবায়ন করা।

নুরুদ্দিন আহমেদ
সদস্য, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা

আনন্দবাজার/শাহী/নরুদ্দিন

সংবাদটি শেয়ার করুন