শনিবার, ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মূল্যবোধের অবক্ষয় ; অভাব নৈতিক শিক্ষার

আব্দুল্লাহ আলম নুর

‘সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত সন্দেহে বৃদ্ধ পিতাকে বাস টার্মিনাল এলাকার পরিত্যক্ত জায়গায় ফেলে গিয়েছেন তার ছেলে নজরুল ইসলাম’। এমন ঘটনা শুধু একটি-দুটি নয়। বাংলাদেশে কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী সনাক্তের পর থেকে, সংবাদপত্রের পাতা খুললেই চোখে পড়ছে এমন মর্মান্তিক সংবাদ। যা পারিবারিক বন্ধনের, পারস্পরিক মমত্ববোধে পরিপূর্ণ এই বাংলাদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে নিতান্তই বেমানান।

রোগাক্রান্ত হলেই, জ্বর, সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত হলেই দূরে ঠেলে দিচ্ছে, একঘরে করে দিচ্ছে, কখনো কখনো বের করে দেয়া হচ্ছে নিজ বাসা থেকেও। ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যু পথযাত্রী হচ্ছে নিজ সন্তান, প্রতিবেশীর অবহেলায়।

একইভাবে কেউ মৃত্যুবরণ করলে ফেলে রাখা হচ্ছে লাশ। ভয়ে কাছে যাচ্ছে না, দাফন কার্যে অংশ নিতে, মুখাগ্নি করতেও অপারগতা প্রকাশ করছে সন্তান। চাকরিসূত্রে অবস্থান করা শহর কিংবা ঢাকার কোনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে, লাশ নিতে দেয়া হচ্ছে না গ্রামের বাড়িতে। মৃত লাশের সঙ্গেও নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করা হয়! প্রাণহীন দেহটাকে পারিবারিক কবরস্থানে রাখতে, জানাযা পড়তে, দাফনকাজে অংশ নিতে আসছে না সন্তান-প্রিয়জন।

পত্রিকান্তরে খবর, ‘ফেনীতে কোভিড-১৯ উপসর্গ জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে বদ্ধ ঘরে মৃত্যু হওয়া সাহাব উদ্দীনের (৫৫) মৃত্যুর পূর্বে প্রকাশ পায় বিভৎস চিত্র। মৃত্যুর পূর্বে পরিবারের লোকজন ঘরে তাকে একাকী রেখে বাহির থেকে আটকে দেয় ছিটকিনি। দেয়া হয়নি দুপুরের খাবার। মৃত্যু মুহূর্তে বারবার চেয়েও মেলেনি পানি। ছোট ছেলে এগিয়ে যেতে চাইলেও তাকে বাধা দেয় বড় বোনেরা। মৃত্যুর পরও তার কাছে যাননি স্ত্রী, ছেলে-মেয়েসহ কোনো স্বজন’।

আরও পড়ুনঃ  এক্সিলেন্স বাংলাদেশের সহযোগিতায় এইচআর মিটআপ করবে 'কর্ম বাই গুগল'

কিন্তু কেন হচ্ছে এমন? কেন ঘটছে এসব? এর জন্য দায়ি নৈতিক শিক্ষার অভাব, নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, যার ফলে এমন অপ্রত্যাশিত চিত্র অবলোকন করছে আমাদের সমাজ। অসুস্থের প্রতি এমন নিষ্ঠুর আচরণ কেবল নৈতিক শিক্ষাবঞ্চিত কেউই করতে পারে।

সব ধর্মগ্রন্থেও পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। আল-কুরআন ও হাদিসগ্রন্থেও অসংখ্যবার শিক্ষা দেয়া হয়েছে পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্য পালনের, তাদের প্রতি সদাচরণের। অন্যদিকে অসুস্থ ব্যক্তির সেবা করলে, তাকে সাহায্য-সহযোগিতা করলে পরকালে পুরস্কারের ঘোষণাও দেয়া হয়েছে।

শুধু করোনাকালীন এই সময়েই নয় বরং আমাদের সমাজে প্রয়াশই পরিলক্ষিত হয় সন্তান কর্তৃক পিতা-মাতার প্রতি সংগঠিত বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। এমনকি আপন পিতা-মাতার ঘাতকেও পরিণত হচ্ছে সন্তানরা। সম্প্রতি চট্টগ্রামে সন্তানের হাতে খুন হন দু’জন পিতা-মাতা। গতবছরের ১৩ অক্টোবর টাকা চেয়ে না পেয়ে, বৃদ্ধা মা রওশন আক্তারকে ছুরিকাঘাতে খুন করে ছেলে জহির। ২০১৩ সালে ঘুমন্ত বাবা-মাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিলো তাদেরই কন্যা ঐশি। এছাড়া মোটরসাইকেল চেয়ে, টাকা চেয়ে না পেয়ে পিতা-মাতাকে হত্যার মত ঘটনাও ঘটছে হামেশাই।

বস্তুত পাঠ্য শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়াই এর জন্য দায়ি। পিতা-মাতার প্রতি সন্তান, সন্তানের প্রতি পিতা-মাতা পারস্পরিক দ্বায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন থাকলে সন্তানের হাতে খুন হওয়ার মত ঘটনা দেখতো না আমাদের সমাজ। এসব অন্য দশটি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের মত নয় বরং এসব অপরাধ মনস্তাত্ত্বিক। নীতি- নৈতিকতার অবক্ষয় না হলে, এমন ঘটনা ঘটতো না।

আরও পড়ুনঃ  মৃতদের উৎসব থেকে বলছি

নীতির প্রতি মূল্যায়ন বা নীতিবোধের উপস্থিতিই হচ্ছে নৈতিকতা। আর ভালো-মন্দ বিচার বিশ্লেষণ বা মূল্যায়নের মানসিকতা হচ্ছে মূল্যবোধ। অন্যদিকে অবক্ষয়ের সূচনা করে মূল্যবোধের অনুপস্থিতি। সাধারণত অবক্ষয় বলতে বুঝায় সামাজিক কিছু স্খলন বা বিচ্যুতি ঘটা। আরো বিস্তৃতভাবে বললে সততা, নিয়মানুবর্তীতা, শৃঙ্খলা ইত্যাদি নৈতিক গুণাবলী লোপ পাওয়া এবং সামাজিক অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়া।

নৈতিকতার বিচ্যুতি আমাদের সমাজের সর্বক্ষেত্রে বর্তমান। বিচ্যুতিহীন ক্ষেত্র খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর হয়তো। আদর্শহীনতার আঁচড় লেগেছে আমাদের সামাজিক ও ব্যক্তিজীবনেও, বিস্তৃত হয়েছে অবক্ষয়। মূল্যবোধের অনুপস্থিতি ও অবক্ষয়ের বিস্তৃতির কারণে ক্রমেই বাড়ছে অপরাধমূলক কার্যক্রম। কাউকে অপদস্ত করা, নারীদের কটুক্তি করা, তুচ্ছ বিষয়ে মারামারি-হত্যার মত নিত্যকার ঘটনা যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

নৈতিকতার মানোন্নয়ন ব্যতীত সমাজ তথা রাষ্ট্র থেকে অন্যায়, দূর্নীতি ও যে-কোনো দুষ্কর্ম দূর করা সম্ভব নয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নৈতিক অবক্ষয়ের মূল কারণ, আমাদের শিক্ষার্থীদের নৈতিক শিক্ষার অভাব রয়েছে, হারিয়ে যাচ্ছে সামাজিক শৃঙ্খলা আর মূল্যবোধ। সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের দিকে দৃষ্টিপাত করলেই বুঝা যায়, আমাদের সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় কোন পর্যায়ে বর্তমান। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে সামাজিক শৃঙ্খলা এবং সামাজিক সম্পর্ক।

নৈতিকতাহীন শিক্ষা, মৌলিক শিক্ষার অভাবে যুবসমাজ পরিণত হয় মূল্যবোধহীন সমাজে। সমাজে ছড়িয়ে পড়ে অন্যায়, অত্যাচার, বিশৃঙ্খলা, কলহ, দূর্নীতি, ধর্ষণ, খুনের মত অপরাধ। নৈতিক মূল্যবোধের বক্রতা রোধে প্রয়োজন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টিপাত। এর থেকে উত্তরোণে সিলেবাস ভিত্তিক শিক্ষার পাশাপাশি মৌলিক শিক্ষার প্রতিও সমান গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধে সচেতন হতে হবে, নিজেদেরকে বিরত রাখতে হবে অনৈতিক কার্যকলাপ থেকে। প্রত্যেকের স্ব স্ব স্থান থেকে সচেতনতাই পারে সমাজ থেকে অন্যায় দুর্নীতি দূর করতে।

আরও পড়ুনঃ  করোনা সংকটে শিক্ষার্থীদের পাশে জবি শিক্ষকরা

নৈতিকতার এই অবক্ষয় রোধে সিলেবাস ভিত্তিক পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। ধর্মগ্রন্থ পড়া, সাহিত্য পড়া, সামাজিক ও শিক্ষামূলক চলচ্চিত্র দেখা, সামাজিক-সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণের আগ্রহ গড়ে তোলাও নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখতে পারে। নৈতিক শিক্ষা ব্যতিত ব্যক্তির মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত হয় না।

একজন মানুষের প্রাথমিক স্তর তথা শিশুকাল থেকেই নৈতিকতা ও মূল্যবোধ শেখার সূচনা হয়। প্রাথমিক শিক্ষাকালই শিশুর মানসিক বিকাশ ঘটনের গুরুত্বপূর্ণ সময়। সর্বোপরি এ শিক্ষা প্রক্রিয়ায় পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমাজ তথা রাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। শিশুকালে নৈতিকতার সুন্দর বিকাশ হলে, তা সৌরভ ছড়াতে পারে পরিণত বয়সে।
সুতরাং নৈতিক অবক্ষয় রোধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠ্যবিষয়ের পাশাপাশি একজন শিক্ষার্থীকে নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষা দেয়াও জরুরি। তবেই তার মধ্যে প্রস্ফুটিত হবে সহানুভূতি, ধৈর্য-সংযম শক্তি, মমত্ববোধ, সহমর্মিতা, ভ্রাতৃত্ব, দেশপ্রেমের মত গূণাবলির।

লেখক:
আব্দুল্লাহ আলম নুর।
শিক্ষার্থী ও সংবাদকর্মী,
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা। 

সংবাদটি শেয়ার করুন