রেজ্জাকুল হায়দার
রাষ্টীয় হস্তক্ষেপের সংকোচন, রাষ্ট্রীয় জনগুরুত্বপূর্ণ সেবা প্রতিষ্ঠান বেসরকারিকরণ, নিয়ন্ত্রণহীন মুক্ত বাজার, বিলগ্নীকরণ, ব্যয়সংকোচন নিমিত্ত সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পগুলির বিলোপের চিন্তাধারাই নব্যউদারনীতিবাদ।
নব্যউদারবাদ বাজারের স্বাধীনতার কথা বলে এমন এক ব্যবস্থার সৃষ্টি করে সেখানে দুর্বলদের সাহায্যে দিয়ে এগিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা ব্যক্তিস্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ বলে বিবেচিত হয়, যেখানে জনসেবা খাতগুলোকে বেসরকারিকরণ করা হয়, যেখানে ট্রেড ইউনিয়ন বা শ্রমজীবীদের সংগঠনগুলোকে দেখা যায় “বাজার অর্থনীতির শত্রু” হিসেবে, ধনীর যাবতীয় সম্পদ, সুবিধাদি স্বাভাবিক আর গরীবের অবস্থার জন্য তার ভাগ্য, তার অযোগ্যতাকে দায়ী করা হয়। অর্থাৎ ধনীরা ধনী এবং গরীবরা আরও গরীব।
পাটকে বলা হয় সোনালী আঁশ। পাট ও পাটজাত পণ্য আমাদের অহংকার ও গর্বের ধন। স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশন (বিজেএমসি) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তখন বিজেএমসির অধীনে পাটকলের সংখ্যা ছিল ৭০ টিরও বেশী। কিন্তু বছরের পর বছর লোকসানের কারণে মিলসংখ্যা কমে ২৫ এ গিয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত ২ জুলাই বৃহস্পতিবার বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস আনুষ্ঠানিক ভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল গুলোর উৎপাদন বন্ধ ঘোষণা করেন। এ মহামারিকালে পাটকল বন্ধের এমন রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত যা ৫০ হাজার শ্রমিককে কর্মহীন ও লক্ষাধিক মানুষকে নতুন করে দারিদ্র্যের মধ্যে নিয়ে যাবে।
বছরের পর বছর যখন লোকসানের কথা বলে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ করা হচ্ছে আবার সেখানে বেসরকারি পাটকলের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। বর্তমানে দেশে বেসরকারি পাটকলের সংখ্যা ২৮৫ টির মতো।এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে বেসরকারি পাটকলগুলো এত ভালো করছে কিন্তু রাষ্ট্রীয় পাটকলগুলো বছরের পর বছর এত লোকসান গুনছে কেন?
আবার রাষ্ট্রীয় পাটকলগুলো কর্মচারী, শ্রমিকদের লোকসানের বক্তব্য দিয়ে বেতন, ভাতা, পেনশন আটকে রাখা হয়। যার দরুন শ্রমিকদের বকেয়া আদায়ের দাবিতে রাস্তায় নামতে, মিছিল করতে, ন্যায্য অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে অনশন করতে দেখা যায়। নতুন বেতন স্কেলে কর্মকর্তা ঠিকই বেতন পায় কিন্তু শ্রমিকদের বেলায় তা আর হয়ে উঠে না।
বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্র যখন পাটশিল্প নিয়ে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে স্থান করে নিচ্ছে তখন আমাদের রাষ্ট্রীয় পাটকলগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে যাচ্ছে।
পাটমন্ত্রী বলেন, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) মাধ্যমে পাটকলগুলোকে আধুনিকায়ন করে উৎপাদনমুখী করা হবে। তখন শ্রমিক সেখানে চাকুরির সুযোগ পাবে।
বিভিন্ন কারণে সরকারের আওতাধীন সেবাখাতগুলোকে বেসরকারিকরণের পক্ষে অনেকেই মতামত প্রদান করে থাকেন। এখানে দুই দিক থেকে বেসরকারিকরণ নীতির পক্ষে যুক্তি দেখানো যায়-
(১) সরকারের অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা ও দুর্নীতি।
(২) বেসরকারি সংস্থার কর্মদক্ষতা ও পরিকল্পনা কৌশল।
কিছু কথাঃ
প্রথমত, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কখনই সরকারের তুলনায় অধিক দক্ষ নয়। এই প্রতিষ্ঠানগুলো যত বিস্তৃত হতে থাকে ততই আমলাতান্ত্রিক হয়ে উঠে এবং কেবল মুনাফা অর্জনই একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। এখানে নিযুক্ত কর্মচারীদের শ্রমের বিনিময়ে তারা লাভের পাহাড় গড়ে।
দ্বিতীয়ত, সরকারী ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। যত সমস্যা হোক না কেন সরকারকে জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হয় কিন্তু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গুলোর লক্ষ্য থাকে অধিক লাভ করে নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। জনগণের কাছে জবাবদিহিতা তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না।
তৃতীয়ত, যতই উপেক্ষা করুক দারিদ্র্যের প্রতি সরকারের দায়বদ্ধতা থাকে কিন্তু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে তা থাকে না।
চতুর্থত, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যখন তখন শ্রমিক ছাটাই করতে পারে কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানে তা চাইলেই করতে পারে না।
পঞ্চমত, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকদের মেশিনের মতো ব্যবহার করা হয় কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দানে বাধ্য থাকে।
ষষ্ঠত, সরকারের অভ্যন্তরে যে দুর্নীতি চলে তার উল্টো পিঠে মূলত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফা অর্জনের বিষয়টি যুক্ত থাকে।
বেসরকারিকরণ প্রথা নব্য উদারবাদনীতিরই একটি অংশ। রাষ্ট্রীয় পাটকলগুলোকে বেসরকারিকরণ করে সরকার নব্যউদারবাদের দিকেই যাচ্ছে। যা কিনা ধনিক শ্রেণীকে ধনী আর গরীবদের আরও গরীর করে যাচ্ছে।
রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। সরকার তত্ত্বাবধায়ক মাত্র। রাষ্ট্রীয় সম্পদ জনগণের অনুমতি ছাড়া হস্তান্তর করা উচিত নয়। তাই রাষ্ট্রীয় সম্পদ বেসরকারিকরণ বন্ধ হোক।
লেখক: রেজ্জাকুল হায়দার
শিক্ষার্থী,
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ
আনন্দবাজার/ডব্লিউ এস/আর এ