শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৫ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

করোনা মোকাবিলায় গ্রামগুলো কী প্রস্তুত?

ড. সাজিদ উল ইসলাম

যেখানে করোনা ভাইরাস নিয়ে সারা বিশ্ব ‌’আপন প্রান বাঁচা’ অবস্থা, সেখানে অবহেলিত, অসচেতন গ্রামবাংলা নিয়ে আমরা কি ভাবছি? শহর, বিশেষ করে বাংলাদেশে করনার আঁতুড়ঘর ঢাকার অনেক স্থানে জীবাণুমুক্ত করা হচ্ছে, সকল পরীক্ষা কেন্দ্র, চিকিৎসা সুবিধাও ঢাকা বা বিভাগীয় শহরগুলোকে কেন্দ্র করে পরিকল্পনা করা হচ্ছে, এখনও অপ্রতুল ডাক্তারদের সুরক্ষা পোশাক, পরীক্ষা করার সরঞ্জাম। এমন অবস্থায় জেলা, থানা বা গ্রাম পর্যায়ে করোনা পরীক্ষা বা সেবা পৌঁছাতে এখনো যে ‘পাঞ্জেরী বহু পথ দেরী’, সেটা সহজেই অনুমেয়।

তাহলে কি হতে পারে আমাদের গ্রামের সহজ সরল মানুষদের? যেখানে তারা এখনো অবাধে ঘোরাফেরা করছে, অথবা আক্রান্ত হলেও পরিক্ষার অভাবে সনাক্তের বাইরে থেকে যাচ্ছে এবং অজান্তেই সংক্রামণের হার বাড়িয়ে দিচ্ছে। আবার এমনও হচ্ছে, আক্রান্ত ব্যক্তি সামাজিক ও মানসিক চাপে তথ্য গোপন রাখছেন। যার প্রমাণ পাই যশোরে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় একজন মারা গেলে জানা যায়, তিনি করোনা আক্রান্তের তথ্য গোপন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। (সূত্র : প্রথম আলো)

এছাড়াও গুজব, থানকুনি পাতা খাওয়া, পানিপরা বা মধ্য রাতে আজানের মত ঘটনা গ্রামে অহরহ ঘটছে। তবে এটা পরিস্কার যে, মানুষ আতংকিত, কোথাও থেকে তেমন আশ্বস্ত না পারা মানুষগুলোকে সহজেই কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হবার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিচ্ছে।

হজ ক্যাম্পে সাময়িক অবস্থান কালে বিক্ষুব্ধ ইতালি প্রবাসীর মতে (মন্ত্রীর ভাষ্য মতে নবাবজাদা) বাঙ্গালীদের করোনা হয় না, কারণ তারা মদ পান করেন না, শুকর খান না। তার বিশ্বাস ভুল প্রমাণ করে গত ৮ মার্চ থেকে তাদেরই বহন করে নিয়ে আসা জীবাণু আজ সারাদেশে ছড়িয়ে গেছে। মৃত্যু আর আক্রান্তের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। প্রবাসী ভাইবোনদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলা যায়, আক্রান্ত দেশ থেকে আসার আগে আরেকটু বিবেচনা করতে পারতেন অন্ততপক্ষে তাদের বয়স্ক প্রিয় মানুষদের কথা ভাবতে পারতেন। দেশে এসেও সরকারের হোম কোয়ারেন্টিন লংঘন করে অবাধে না ঘুরতে পারতেন, বিয়ে করা, শপিং বা দাওয়াত খেতে না গেলেও পারতেন। এখন অবস্থা এমন যে, সারাদেশ আবদ্ধ করতে হচ্ছে।

আরও পড়ুনঃ  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়স্থ ভাষা ও ভাষা-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জ্ঞানচর্চা সহায়ক কোমল অবকাঠামোর চালচিত্র

প্রশ্ন হচ্ছে, ওই সকল প্রবাসী অসচেতন ভাইবোনদের মত আমরাও কি ধারণা করছি এই ভাইরাস আমাদের আক্রান্ত করবে না? প্রশ্নের নির্মম নির্জলা সত্য উত্তর হল ‘হ্যাঁ’ আমরাও তাই ভেবেছি, যার কারণে ছুটি হতে না হতেই ট্রেন, বাসে ঘেঁষাঘেঁষি করে ঈদের আনন্দ নিয়ে গ্রামে চলে এসেছি। আমরা এতটুকু চিন্তা করি নাই যে পাশের সহযাত্রী কি ঘাতক জীবাণুর বাহক কিনা। আমরা এটাও ভাবিনি, আমাদের গ্রামের অসহায় গরিব বাবা মাদের আক্রান্ত করতে চলেছি কিনা? সহযাত্রীর মাধ্যমে আক্রান্ত হবার প্রমাণও আছে, রাজশাহীর নার্স (যিনি ইতালি ফেরতের সাথে ট্রেনে ভ্রমণ করেছিলেন) করোনা আক্রান্ত সন্দেহে ঢাকায় এসেও চিকিৎসা পাচ্ছেন না, কারণ সবখানেই ডাক্তার ভয় পাচ্ছেন। ইতোমধ্যে, ডাক্তার নার্সদের ও আক্রান্ত হবার খবর পাচ্ছি।
এই অবস্থায় আমাদের গ্রামের প্রস্তুতি কি হওয়া উচিত?

১. শুধুমাত্র প্রবাসী নয়
কেবলমাত্র প্রবাসী নয়, যারা ঢাকা থেকে বা আক্রান্ত এলাকা ভ্রমণ বা যেকোনো ভ্রমণ থেকে গ্রামে ফিরেছেন তাদের সনাক্ত করতে হবে। ১০ দিন ছুটি শেষে আবার গণপরিবহন চলাচল করবে, গ্রামে বাইরে থেকে এসে কেউ যেন ভাইরাস ছড়াতে না পারেন, তার দায়ভার আমাদের সকলের নিতে হবে। সবার আগে সচেতন হতে হবে নিজেকে। বাইরে থেকে যেই আসুক না কেন, তার থেকে পরিবারের সদস্যদের কমপক্ষে তিন চার দিন দূরত্ব বজায় রাখা উচিত। আক্রান্ত হবার উপসর্গ দেখা না গেলেও ঘরের বাইরে না যাওয়া উচিত, কারণ অনেক সময় এটির লক্ষণ দেরিতেও প্রকাশ পেতে পারে।

এক্ষেত্রে প্রত্যেক গ্রামে, পাড়ায় আগুন্তক বা বাইরে গেছেন এমন মানুষদের একটি তালিকা করা যেতে পারে, তাহলে ওই সকল পরিবার আক্রান্ত হলে সহজেই সনাক্ত করা যাবে। পাড়া বা গ্রামে এসকল তালিকা করা কোন কঠিন কাজ নয়। কারণ সবাই সবাইকে চিনি, তালিকা করার জন্য তরুণ ভাইবোনদের আহবান জানাই (কারণ তাঁরা বয়স্কদের তুলনায় কম ঝুঁকিতে আছেন)। গ্রামের মেম্বারেরা তাদের প্রত্যেক এলাকার এসব মানুষ ও তাদের পরিবারের তালিকা এবং মোবাইল নাম্বার চেয়ারম্যানকে সরবরাহ করতে পারেন। চেয়ারম্যান নিজে এসকল মানুষ ও পরিবারদের নজরদারিতে রাখবেন, আক্রান্ত হবার খবর পাবার সাথে সাথেই ব্যবস্থা নিতে হবে, যেন আশেপাশের আর কেউ আক্রান্ত না হন।

আরও পড়ুনঃ  এমন ঘটনা নতুন নয়!

মনে রাখতে হবে, যতো দ্রুত আমরা আক্রান্তদের সনাক্ত করে সকলের থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারব তত দ্রুত এই ভাইরাস মোকাবেলা করা যাবে। মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লরার মতে, করোনা কমিউনিটি পর্যায়ে এখন মৃদু ছড়াচ্ছে। সেহেতু এখনও সময় আছে আক্রান্তদের আলাদা করার। ব্যাপক আকার নিলে তখন ব্যাপারটা খুব কঠিন হয়ে পড়বে এটা জানা যে, কে আক্রান্ত আর কে আক্রান্ত নয়। গণহারে পরীক্ষা করা খুবই ব্যয়বহুল ও কষ্ট সাধ্য হবে। চীনের করোনা মোকাবেলার সফলতার প্রথম ধাপ তারা আক্রান্তদের আলাদা করতে পেরেছিল ।

২. প্রতিবেশির খবর রাখুন
যেহেতু দোকানপাট, চা দোকান, দৈনিক কাজ কর্ম বন্ধ, সেহেতু আমাদের পাশের বাড়ির গরিব মানুষটার হাড়ির খবরও নিতে হবে। খাবার অভাবে যেন কাউকে বাইরে যেতে না হয়। প্রয়োজনে চেয়ারম্যান বা মেম্বারদের জানান। মনে রাখা উচিত, আজকে আপনার প্রতিবেশী কোনভাবে আক্রান্ত হলে আপনারও আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকবে।

৩. শুধুমাত্র মাস্ক নয়
মাস্ক পড়লেই করনা ঠেকানো যায় না। যেখানে সেখানে থুতু, কফ ফেলা, কথা বলার সময় খুব কাছাকাছি থাকা, অথবা আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহার্য জিনিসপত্র, থালা বাটি, এমন কি যে স্থানে তিনি স্পর্শ করবেন সেখানেও এই ভাইরাস অনেক সময় বেঁছে থাকতে পারে এবং অন্যকে আক্রান্ত করতে পারে। এজন্য বাজার করতে গেলেও যেন দূরত্ব বজায় থাকে, পাশাপাশি টাকা পয়সা লেনদেনের পর মুখে নাকে, চোখে হাত না দেয়া এবং ভাল করে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া। ব্যবসায়ীদের টাকা গণনা করতে থুতু ব্যবহার পরিহার করতে হবে।

আরও পড়ুনঃ  অনুসন্ধান ও গবেষণা জোরদার করা দরকার

৪. আক্রান্ত হলে পালাবেন না, ধর্মীয় নীতি মানুন
অবিশ্বাসী মানুষের তুলনায় বিশ্বাসী মানুষেরা বিপদে বেশি মনোবল পান। ধর্মে বিশ্বাসী না হলেও নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখুন যেটা আপনার করোনা মোকাবেলায় মানসিক শক্তি জোগাবে । ইসলামের নবী (স.) এর নির্দেশ, কোথাও মহামারী দেখা গেলে সেখান থেকে পালানো বা সেখানে গমন না করা। সেক্ষেত্রে বলা যায়, বর্তমান করোনা

যেহেতু মহামারী সেহেতু আক্রান্ত হলে পালিয়ে গেলে বা আক্রান্ত স্থান থেকে অন্য স্থানে এই ভাইরাস ছড়িয়ে দিয়ে রাসুলের নির্দেশ অমান্য করা হবে।

একই সাথে অনেক আলেমদের মত হল, করোনা আক্রান্ত মৃত ব্যক্তি, মহামারিতে মারা গেলে শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করবেন । অতএব , দুশ্চিন্তা নয়, আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হন। যেকোনো বায়ুবাহিত অসুখে (সর্দি, কাশি), জ্বরে আক্রান্ত হলে মসজিদ, মন্দির এড়িয়ে ঘরে প্রার্থনা করুন। মসজিদ যেহেতু বন্ধ নয়, সেহেতু কার্পেট উঠিয়ে ফেলে (শীতের মউসুম যেহেতু শেষ) প্রতিবার নামায শেষে জিবাণু মুক্ত পানি দিয়ে মেঝে ধুয়ে মুছে ফেলা উচিত। (কারণ সেজদার স্থানে আমরা হাত রাখি এবং নিঃশ্বাস ফেলি, ফলে উক্ত স্থান দুষিত হতে পারে)

সবশেষে, গুজব নয়, সঠিক তথ্য জানুন। গ্রামে কেউ আক্রান্ত হলে, তার অনিরাপদ চলাচলের কারণে শুধুমাত্র তিনি বা তার পরিবারই ভুগবেন এমন নয়, সমস্ত গ্রাম অনিরাপদ হয়ে উঠবে। গ্রামীণ জীবন নিবির সামাজিক সম্পর্কে আবদ্ধ একটি সমাজ ব্যবস্থার কারণে আক্রান্ত ব্যক্তিদের উপর এক ভীষণ চাপের সৃষ্টি হয়, এজন্য তাদের প্রতিও সহানুভুতিশীল হতে হবে আমাদের সকলের। মনে রাখতে হবে, আমরা যে কেউ যেকোনভাবে এই বিপদে আক্রান্ত হতে পারি। এই যুদ্ধ শুধুমাত্র ১০ দিনের নয়, অনির্দিষ্ট কালের। ৪ এপ্রিলের পর মানুষের চলাচল বাড়বে, এজন্য গ্রাম রক্ষায় এখনি সময় সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করার।

আনন্দবাজার/বারেক কায়সার

সংবাদটি শেয়ার করুন