ঢাকা | শুক্রবার
২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

‘ট্যুরিজম: ‘স্টার্ট উইথ নো বিগিনিং’

‘টুরিজম: ‘স্টার্ট উইথ নো বিগিনিং’

পর্যটনশিল্পকে বলা হয় জ্যাক অফ অল ট্রেড। কোভিড পূর্ববর্তীকালে, কোভিডকালীন এবং কোভিড পরবর্তী সময়েও পর্যটনশিল্প পৃথিবীর একক বৃহত্তম শিল্প হিসাবে স্বীকৃত। একজন ট্যুরিস্ট যখন কোথাও যান, যাতায়াতের জন্য তিনি যানবাহন ব্যবহার করেন, প্লেনে উঠেন, হোটেলে থাকেন, চাল-ডাল-তেল-নুন-চিনি-চা-কফি-দুধ-চিকেন-বিফ-মাটনসহ বহুবিধ জিনিস আহার করেন। স্থানীয় পণ্য কেনাকাটা করেন। অর্থাৎ একজন ট্যুরিস্ট আগমনের ফলে অনেকগুলো ভোগ-উপভোগের সাথে সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অর্থনৈতিক কর্মসম্পাদন হয়। পরিবহনে তিনি অর্থ ব্যয় করেন।

হোটেলে সাবান-শ্যাম্পু-টাওয়েল-বেডশিট, চিরুণি, কটন বাডস, কাপ-পিরিচ, গ্লাস, টিসু, বাস্কেট, বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাস ইত্যাদি ব্যবহার করেন। ফিরে যাওয়ার আগে বিভিন্ন প্রকার উপহার সামগ্রি ক্রয় করেন। এসকল কার্যক্রমের ফলে যাতায়াতের সাথে যুক্ত কোম্পানি, হোটেল, স্থানীয় ব্যবসায় ও সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরিভাবে ব্যবসা করতে পারছে। আবার এসবকিছুর সাথে যুক্ত কৃষক, উৎপাদক, কর্মী, সরবরাহকারিসহ সংশ্লিষ্টরাও বাণিজ্যের অংশিদার হচ্ছেন। পৃথিবীর পরীক্ষিত, প্রমাণিত এবং প্রতিষ্ঠিত পরিসংখ্যান বলছে পর্যটন একযোগে ১০৯টি শিল্পকে সরাসরি প্রভাবিত করে, চালিত করে, প্রসারিত করে। পরোক্ষভাবে এর উপখাতের সংখ্যা আরও প্রায় ১১০০টি।

অর্থাৎ একজন ট্যুরিস্ট আগমন ও উপস্থিতি কৃষি ও শিল্প উৎপাদনে অন্যতম প্রধান সহায়করূপে কার্যকর ভূমিকা রাখে। সেবাখাতে ব্যাপক কর্মযজ্ঞের সুযোগ সৃষ্টি হয়। একইসাথে জাতীয় অর্থনীতির অগ্রযাত্রায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে দেশের উন্নতি ও মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নেও তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ব্যাংকসহ আর্থিকখাতে গতির সঞ্চার হয়। কোভিড-১৯সহ পৃথিবীতে চলমান নানা দুর্যোগ এবং অর্থনৈতিক বিপত্তির কারণে বহু মানুষ কর্মহীন হওয়ার পরেও পর্যটনক্ষেত্রে প্রতি আড়াই সেকেন্ডে একটি করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। একজন পর্যটকের আগমনে সেবাখাতে ১১জন মানুষের সরাসরি কর্মসংস্থান হয়। পরোক্ষভাবে কাজ পান আরো ৩৩ জন। অর্থাৎ ১ লক্ষ পর্যটকের আগমনের সাথে ১১ লক্ষ কর্মসংস্থান যুক্ত। কোনো স্থানে যদি ১০ লাখ নিয়মিত অভ্যন্তরীণ বা আন্তর্জাতিক পর্যটক থাকে সেখানে স্থায়ী কর্মসংস্থান হয় ১ কোটি ১০ লাখ লোকের। ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশে এটি আরো ব্যাপকভাবে হতে পারে। কারণ এই জনগোষ্ঠির ৪কোটি মানুষ তরুণ। সম্প্রতি বিশ্ববিখ্যাত ফোর্বস ম্যাগাজিন এই সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। সেখানে ২০১৯ সালে পর্যটনক্ষেত্রে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে শীর্ষ দশটি দেশের তালিকা প্রকাশ করেছে যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান হচ্ছে প্রথম।

কোভিড-১৯ বিশ্বকে বদলে দিয়েছে। এই বদল হওয়া অব্যাহত থাকবে দীর্ঘসময় ধরে। স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বপর্যটনেও এর প্রভাব অনস্বীকার্য। তবে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে কোভিড-১৯ পরবর্তী বিশ্বে ৫টি খাত ব্যাপকভাবে এবং বহুমাত্রিকতা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে, হচ্ছে এবং অর্থনীতি ও সমাজজীবনে গতির সঞ্চার ঘটছে। উল্লেখিত ৫টি খাতের একটি হচ্ছে ট্যুরিজম। বিশেষভাবে অভ্যন্তরীণ পর্যটন। বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ি এখানে হাতেগোনা যে দেশগুলোর সফল হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি তারমধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। জাতিসংঘ মহাসচিবও তার বিশেষ বার্তায় বলেছেন পর্যটন হবে কোভিড-১৯ পরবর্তি বিশ্বে ঘুরে দাড়ানোর অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে আমরা তার সুস্পষ্ট প্রতিফলন দেখছি, দেখতে পাচ্ছি। কোভিড প্রেক্ষাপটে পর্যটনের সংজ্ঞা বদলে গেছে। পর্যটকের সংজ্ঞায় পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তনের ফলে পর্যটনের পরিধি আরও ব্যাপকতা পেয়েছে, একইসাথে এর বহুমাত্রিক ও বৈচিত্রময় অন্তর্ভুক্তি যুক্ত হয়ে পর্যটনকে নতুন মাত্রা দিয়েছে।

বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের রাষ্ট্রের মর্যাদা অর্জনের পথে রয়েছে। ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বকে যে ১৭টি টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ঠলক্ষ্য অর্জন করতে হবে, তারমধ্যে ৩টিকে বলা হচ্ছে সরাসরিভাবে পর্যটনের সাথে যুক্ত। পরোক্ষভাবে সংযুক্ত আরও ১৩টি। কিন্তু দেশভেদে এই লক্ষ্যসংখ্যা ভিন্ন। গবেষণা বলছে বাংলাদেশের মতো রষ্ট্রে এই সংখ্যা কমপক্ষে ৬টি। সুতরাং আগামিদিনে সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল অর্জনের ক্ষেত্রে পর্যটনে কাঙ্খিত সাফল্য নিশ্চিত করবার জন্য কুশলী, কৌশলী এবং দূরদর্শি পথে অনিবার্যভাবে ছুটে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। বরং কোভিড-১৯ পরবর্তি পর্যটন পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য একদিক থেকে সেই লক্ষ্য অর্জনে সহায়কসঙ্গের আভাস দিচ্ছে।

উল্লেখ্য পর্যটনের মাধ্যমে সাফল্যলাভের সম্ভাবনাময় সফল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম হওয়ার কারণ বহুবিধ। পর্যটন সম্ভাবনা বিবেচনায় বাংলাদেশকে বলা হয় ‘ইউনিক ডেল্টা অফ সেভেন টিএ (সেভেন টিএ- সেভেন ট্যুরিস্ট এট্রাকশনস)। এই সেভেন টিএ হচ্ছে নদী, সমুদ্র, পাহাড়, বন, ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি, ঋতু বৈচিত্র এবং আতিথেয়তা। অর্থাৎ কোনো স্থানে বা কোনো দেশে এই সেভেন টিএ-এর একটি যদি উপস্থিত থাকে পর্যটনের জন্য তাকে বলা হয় গুড, যদি দুইটি থাকে তাকে বলা হয় বেটার, আর যদি দুইয়ের অধিক থাকে তবে বলা হয় বেস্ট। সেই বিচারে বাংলাদেশের অবস্থান হচ্ছে বেস্ট প্লাস প্লাস প্লাস।

বাংলাদেশের আসন্ন পর্যটনবিপ্লব: বিভিন্ন গবেষণা এবং পরিসংখ্যান বলছে পোস্ট কোভিড-১৯ পৃথিবীতে সাধারণভাবে কেউ ছুটি কাটাতে বা পারিবারিক অবসর সময় উপভোগ করতে কিংবা যেকোনো প্রকার হলিডে মেকিং করবার জন্য ১০০ থেকে ৩০০ মাইল বা ১৬১কি.মি থেকে ৪৮২কি.মি দূরত্বের ভ্রমণকে প্রথম পছন্দরূপে অগ্রাধিকার দেবেন। ফলে অভ্যন্তরীণ পর্যটন, সম্ভাব্য পর্যটনসফল দেশের তালিকাভুক্ত বাংলাদেশর মতো স্থানে আরও বেগবান হবে। যার প্রভাব আমরা দেখছি। আরেকটি তাৎপর্যময় বিষয় হচ্ছে প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে ৪.৬ মিলিয়ন পর্যটক নানা কারণে বিদেশ ভ্রমণ করেন; যারমধ্যে ভারতে যান প্রায় ২.৯ মিলিয়ন বা ২৯ লক্ষ বাংলাদেশি পর্যটক, থাইল্যান্ডে যান ৫লক্ষের বেশি, মালয়েশিয়া ভ্রমণ করেন প্রায় ৩লক্ষ, সিঙ্গাপুর যান ২লক্ষ, এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের আরব আমিরাত, কাতার, ওমান, সৌদি আরবসহ ইউরোপ, আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণ করেন আরও ৫.৫ লক্ষ মানুষ।

পর্যটনকে সফল করার জন্য সাধারণভাবে দেশভেদে ১১Ñ১৩টি মন্ত্রণালয়ের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা ও সংযুক্তি প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা ২২ এবং বিভাগ বা সংস্থার সংখ্যা প্রায় ৫৫টি (টিআরডি রিসার্চ ২০২০)। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য এবং বড় আশার কথা, যথার্থ এবং নের্তৃত্বশীল কর্তৃত্বই কেবল বাংলাদেশের এই আসন্ন পর্যটনকে টেকসই রূপ দিতে পারে। আবার আশংকার বিষয় হচ্ছে এই পর্যটনবিপ্লব যদি যথাযথ কর্তৃপক্ষের নের্তৃত্বের দুর্বলতায় বা ভুলে ব্যর্থ হয় তাহলে বাংলাদেশের পর্যটন ২০২৩ সালের পরে বড় বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে বলে বিশেষজ্ঞরা আভাস দিচ্ছেন। এখানে কে, কোন কর্তৃপক্ষ কেমন করে নের্তৃত্ব দেবেন তার একটি রূপরেখা এখনই নির্দিষ্ট করতে হবে এবং সেজন্য প্রয়োজন গবেষণা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য কোভিড-১৯ প্রেক্ষাপটে জাপান, ইটালি, ভারত, ভিয়েতনাম, শ্রীলংকা, নেপাল, মালয়েশিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ তাদের প্রচলিত মাস্টার টুরিজম প্লানের বদলে তিন থেকে ১০ বছর মেয়াদি কোভিড-১৯ পরবর্তি টুরিজম পরিকল্পণা প্রণয়ন করেছে এবং সেই লক্ষ্যে কাজ করে এরইমধ্যে তাৎপর্যপূর্ণ সফলতা পেয়েছে। বাংলাদেশের পর্যটনে এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি এখনও করা হয়নি।

দুনিয়াজুড়ে নানা কাজেরই একটি ‘প্রারম্ভ’ থাকে। কিন্তু পর্যটনের কোনো ‘প্রারম্ভ’ নেই। এখানে ‘শুরু’ করতে হয়, অর্থাৎ ‘স্টার্ট উইথ নো বিগিনিং বা ‘প্রারম্ভহীন শুরু’। এই ‘প্রারম্ভ’হীন ‘শুরু’ করবার জন্য যে মেথড সফল হিসাবে পরীক্ষিত, প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত তাকে বলা হয় ‘উইন্ডো ড্রেসিং মেথড’। ‘উইন্ডো ড্রেসিং মেথড’ হচ্ছে যেগুলো যে অবস্থায় আছে সেগুলো প্রয়োজন অনুযায়ি সেই অবস্থা থেকেই ঠিকঠাক করা, কিছু সংস্কার করা, যেমনটা ঘরে অতিথি এলে আমরা করি, ঘরের পর্দাগুলো ধুয়ে দেই, দেয়ালে ময়লা থাকলে রং করি, পাপোষটা পুরণো হলে বদল করি, বিছানায় ধোয়া পরিস্কার চাদর বিছাই, ভাত না করে পোলাও রান্না করি, অতিথির পছন্দমতো সঙ্গতি অনুযায়ি কিছু বাড়তি আয়োজন করি ইত্যাদি।

প্রথাগত পদ্ধতিতে ‘প্রারম্ভ’ খুজতে গিয়ে পর্যটনের যথার্থ ‘শুরু’টা হয়নি বঙ্গন্ধুর সোনার বাংলাদেশে। ফলে বিশাল পর্যটনভান্ডার বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ তার প্রাপ্য পর্যটনসাফল্য থেকে এখনও বঞ্চিত থেকেছে। কোভিড-১৯ পরবর্তী পর্যটন পরিস্থিতি পূর্বাভাস আমাদের জন্য নতুন সুযোগ ও সম্ভাবনা এনে দিয়েছে যা এসডিজি অর্জনে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য পেনাল্টিশুট হিসাবে কাজ করবে।

লেখক: সম্পাদক, ভ্রমণ ম্যাগাজিন
পরিচালক, টুরিজম রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট (টিআরডি)
এডজাংকট ফ্যাকাল্টি মেম্বার, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির

সংবাদটি শেয়ার করুন