বাংলাদেশে গণমাধ্যম ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে এবং এর ব্যাপকতা জীবনের বিভিন্ন দিককে প্রভাবিত করছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে একাধিক সংবাদপত্র, টেলিভিশন, রেডিও ও ইন্টারনেট মিডিয়াসহ, গণমাধ্যমের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। সাংবাদিকদের মাঝে দুর্নীতি বেড়েছে। স্বাধীনতার এত বছর পার হয়ে গেলেও বাংলাদেশে স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ কোনো গবেষণা হয়নি। এমনকি জাতীয়ভাবে তেমন গুরুত্বের সাথে দেখা হয়নি।
গত ২০ জুলাই, ২০২০ তারিখে জারি করা একটি সমীক্ষা অনুসারে, বাংলাদেশে কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাব ঢাকাসহ মোট ছয়টি জেলার ৪৫৬টি স্থানীয় দৈনিক ও সাপ্তাহিক সংবাদপত্র বন্ধ করতে বাধ্য করেছে। বাংলাদেশ ইন্ডিপেন্ডেন্ট জার্নালিস্ট নেটওয়ার্ক (বিআইজেএন) সম্প্রতি ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল এবং সিলেটে একটি সম্মেলনে ঘোষণা করেছে যে বাকি ২৭৫টি স্থানীয় সংবাদপত্রের মধ্যে ১৬৩টি (৩৫.৭৫ শতাংশ) এখনও নিয়মিত প্রকাশের জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছে, যেখানে ১৮টি অনিয়মিতভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। স্থানীয় এই গণমাধ্যমগুলো বন্ধের ফলে প্রায় ১৬০০ স্থানীয় সাংবাদিক তাদের কর্মসংস্থান হারিয়েছেন।
জরিপ অনুসারে, স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীরা অর্থনৈতিক সংকটের কারণে সাংবাদিকতা পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হতে পারে, যা দেশের জন্য খুব ভালো কিছু বয়ে আনবে না। স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীরা জাতীয় গণমাধ্যমকর্মীদের থেকে পিছিয়ে নেই। বরং জেলা পর্যায়ের অনেক সংবাদকর্মীর মান যেকোন কেন্দ্রীয় পর্যায়ের সংবাদকর্মীর থেকে উচ্চমানের। অভাব শুধু যত্নের।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্থানীয় গণমাধ্যম এবং সংবাদকর্মীরা ঐতিহাসিকভাবে জাতীয় পর্যায়ে খুব কম মনোযোগ পেয়েছেন। ইতিহাস এবং দেশের বর্তমান সময় বলছে স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীরা সর্বদা সংগ্রাম করেছে যা চলমান। এখনো অর্থনৈতিক অবস্থানের দিক থেকে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের নিয়ে গবেষণা করলে যে চিত্রটি উঠে আসবে তা খুবই পীড়াদায়ক, স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের শুরু থেকেই খুব একটা যত্ন নেয়া হয়নি এমনকি এখনো হচ্ছে না। যার প্রভাব স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোর উপর পড়েছে এবং তা লক্ষণীয়, যা পুরো বাংলাদেশের গণমাধ্যম ব্যবস্থাপনার জন্য হুমকির। যদি কেন্দ্রীয়ভাবে মফস্বল সাংবাদিকদের যত্ন না নেয়া হয়, তাহলে হয়তো জেলা পর্যায় থেকে হারিয়ে যাবে সাংবাদিকতা পেশার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
বলতে বাঁধা নেই যে স্থানীয় এবং জাতীয় মিডিয়ার মধ্যে আজ বিশাল পার্থক্য গড়ে উঠেছে। যা সমাজের জন্য সুখকর নয়। সকলেই সাংবাদিক তবে বাংলাদেশের চিত্র আজ ভিন্ন, বাংলাদেশের মিডিয়ার দিকে তাকালে মনে হবে, সাংবাদিকতা শুধুমাত্র রাজধানী ঢাকাতেই হচ্ছে। জাতীয় মিডিয়া আউটলেটগুলো থেকে তেমন কোন সহযোগিতার হাত পাচ্ছে না বলে মনে করেন বেশীরভাগ মফস্বলকর্মীরা।
আমার এই গবেষণার এক পর্যায়ে আমি কিছু মফস্বল সাংবাদিকদের সাথে যেমন কথা বলে জানতে চেয়েছি তেমনি আমি জাতীয় পর্যায়ে কথা বলে জানতে চেয়েছি, আজ কেন এই বিশাল পার্থক্য? উত্তরটা কিছু লাইন পরেই না হয় দিচ্ছি।
উন্নত বিশ্বের মিডিয়া কার্যক্রম লক্ষ্য করলে দেখা যাবে স্থানীয় গণমাধ্যম ও তার কর্মীদের কিভাবে অতি গুরুত্বের সাথে নেয়া হয়। আন্তর্জাতিকভাবে গণমাধ্যম স্বাধীনতা সূচক ২০২১ বলছে নরওয়ে প্রথম এবং বাংলাদেশ ১৫২তম। যদি দ্রুততম সময়ের মধ্যে জাতীয় এবং আঞ্চলিক মিডিয়াগুলোকে সমন্বয় করা না যায়, তবে আশঙ্কা দেশের গণমাধ্যম ব্যবস্থা ভয়াবহ রূপ ধারন করতে পারে।
স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোকে জাতীয়ভাবে আরো বেশি অগ্রাধিকার দিয়ে সমাজে সঠিক ভারসাম্য বজায় রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ন হয়ে উঠেছে। সাথে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে, দায়িত্ব নিতে হবে জেলা প্রেসক্লাবগুলোকে। স্থানীয় সংবাদকর্মীদের সমস্যা জাতীয়ভাবে উপেক্ষা করলে দেশে সঠিক ভারসাম্য কখনই আনা সম্ভব নয় বরং অন্ধকারে রয়ে যাবে সমাজ। স্থানীয় গণমাধ্যম দেশের এবং সমাজের চোখ, তাদের উপেক্ষা করার অর্থই সমাজে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়া।
তবে এখানে আমি ফিরে যাচ্ছি আমার সেই উত্তরে, মফস্বল কর্মীদেরও আরো সচেতন হতে হবে, এবং নিজেদের স্কিল আরো উন্নতি করতে হবে, আজ কেন পিছিয়ে পরেছে জেলা সংবাদকর্মীরা তার প্রধান কারন জাতীয় পর্যায়ে অনেকেই মনে করেন শিক্ষা, হলুদ সাংবাদিকতা, এবং এই পেশার পাশাপাশি ভিন্ন পেশায় তারা যুক্ত। আবার অপর দিকে মফস্বল পর্যায়ে তারা ভাবছেন, আমরা জাতীয় পর্যায় থেকে কি পাচ্ছি? ঢাকা ট্রিবিউনের এক্সেকিউটিভ এডিটর রিয়াজ আহমেদসহ অনেকেই মনে করেন, মফস্বল সাংবাদিকদের কথায় অনেকটাই যুক্তি আছে, যেমন তাদেরও পরিবার আছে, যদি তারা জাতীয় পত্রিকার জণ্য শ্রম দিচ্ছে তার বিনিময়ে কোন সম্মানি কেন পাবে না? তবে এই প্রথা বাংলাদেশে প্রায় নেই বললেই চলে।
বাণিজ্যিক প্রভাবের কারণে, জাতীয় গণমাধ্যমগুলো মেট্রোপলিটন অঞ্চলগুলিতে বেশি মনোযোগ প্রদান করে। আমাদের অর্থনীতি গ্রামভিত্তিক হওয়া সত্ত্বেও, গ্রামীণ জনগণের গণমাধ্যমে সীমিত প্রবেশাধিকার রয়েছে। গণমাধ্যমে জেলার সংবাদগুলো কেবল প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং রাজনৈতিক উত্থান-পতনের মাধ্যমে আলোচিত হতে দেখা যায়। যদিও আমাদের সরকারের লক্ষ্য ২০২১ সালের মধ্যে আমাদের দেশকে ডিজিটাল করা, কিন্তু অর্ধেকেরও বেশি জেলার জনগণ এখনো আধুনিক মিডিয়ার আওতায় নেই।
স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মীদের জাতীয় পর্যায়ে মতামত রাখার সুযোগ খুবই স্বল্প। অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক উদ্বেগের কারণে স্থানীয় গণমাধ্যম বন্ধ হলে, আমাদের সমাজে অপরাধের হার কেবল বাড়বে। স্থানীয় গণমাধ্যম এতোটাই শক্তিশালি, যদি সঠিক যত্ন নেয়া না হয় তবে সমাজে ভারসাম্য ও দেশীয় মিডিয়া ব্যবস্থায় দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে, অতএব ক্ষতি আমার বাংলাদেশেরই।
স্থানীয় পর্যায়ে সংবাদকর্মীদের আরো সতর্কতার সাথে কাজ করতে হবে, সাংবাদিকতাকে ভয় নয় বরং সমাজ উন্নয়নে কাজে লাগাবতে হবে। আজ মফস্বল সাংবাদিকতার চিত্র বাংলাদেশের খুবই বিরক্তির সাথে লোকে নেয় তার প্রধান কারন, সাংবাদিকতাকে ঢাল বানিয়ে জেলা পর্যায়ে অনেকেই নৈরাজ্যের সৃষ্টি করেছে, যা মোটেও কাম্য নয়। মনে রখতে হবে এই সাংবাদিকতা এমন একটি শক্তি যা আমাদের যে কোন সময়ে, যেকোন জায়গায় যাবার স্বাধীনতা দেয়। এটিকে সঠিক ভাবে ব্যাবহার করতে যেমন জানতে হবে তেমনি জাতীয় পর্যায় থেকেও সেই সকল কর্মীদের যত্ন নিতে হবে। তবেই কিন্তু গণমাধ্যম শক্ত হয়ে দাঁড়াবে।
যদি এমনটি হতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জেলাভিত্তিক গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করছে, তবে হয়তো স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের মাঝে আশার আলো জ্বলে উঠতো, এবং সেই সাথে পেশার প্রতি দায়িত্ব শতগুন বেড়ে যেত, সঙ্গে জেলা ভিত্তিক মিডিয়াগুলোর মান উন্নতি হত। স্বপ্ন দেখি প্রধানমন্ত্রীর টেবিলে জাতীয় পত্রিকার পাশে জেলার পত্রিকাগুলো স্থান পাবে।
সবশেষে, স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মীদের শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকে ভাবলেই হবে না, শিক্ষাগত যোগ্যতার দিক থেকেও যোগ্য হয়ে ঊঠতে হবে। এটি সত্য শিক্ষার দিক থেকে স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মীরা পিছিয়ে। জেলা শহরগুলোতে শিক্ষিত সাংবাদকর্মী গড়ে তুলতে হলে স্থানীয় প্রশাসন, পিআইবি, জাতীয় প্রেসক্লাব এবং জেলা প্রেসক্লাবগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে, অন্যথায় ভুয়া সাংবাদিক ও হলুদ সাংবাদিকতার হার কেবলই বাড়বে। শিক্ষাকে অগ্রাধিকার না দিলে সংবাদ এবং মাধ্যমের মান উন্নতি করা প্রায় অসম্ভব। নরসিংদীর জেলা-উপজেলাগুলোতে ভুয়া এবং হলুদ সাংবাদিকতাকে রোধ করতে হলে, জেলা প্রশাসন এবং জেলা প্রেসক্লাবকে আরো কঠোর হতে হবে। স্বপ্ন দেখছি নরসিংদী হবে উন্নত এবং শিক্ষিত মিডিয়া কর্মীদের জেলা। সৃষ্টি হবে ইতিহাস।
কিছু করণীয় অবশ্যই জাতীয় পর্যায় থেকে নিতে হবে তবেই এগিয়ে যাবে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম। আজ মিডিয়া একটি বড় ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত হয়েছে, অতএব আমাদের আরো সচেতন হবে, ভিন্নতা তৈরি হলে সমাজের চোখই বরং নষ্ট হবে। আর এই অন্ধত্ব নিয়ে বেশি দুর চলার স্বপ্ন ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নে পরিণত হবে।
লেখক: সাংবাদিক এবং মিডিয়া গবেষক
kabirofficial99@gmail.com