শুক্রবার, ২৬শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১১ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

উত্তরাঞ্চলে ‘অগ্নিদানব’ শর্ট সার্কিট

উত্তরাঞ্চলে ‘অগ্নিদানব’ শর্ট সার্কিট

দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় গেল এক বছরে ৭ হাজার ৬৫৩টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনার মধ্যে শহর এলাকার ৭০ শতাংশই ঘটেছে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে। এসব অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাতের পেছনে রয়েছে নিম্নমানের নকল বৈদ্যুতিক ক্যাবল এবং ফিটিংস সুইস, সকেটসহ অন্যান্য বৈদ্যুতিক সামগ্রীর ব্যবহার। বাসাবাড়ি এবং বাণিজ্যিক স্থাপনাসমূহে ত্রুটিপূর্ণ এবং নিম্নমানের উপরকরণে বৈদ্যুতিক সংযোগ দেয়ার ফলেই ঘটে চলেছে ভয়াবহ এসব অগ্নিকাণ্ড। এমন তথ্য দিয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স দফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ি, ঠিকাদার ও ইলেট্রিশিয়ানের লোভ আর নির্বুদ্ধিতার কারণে এসব ঘটছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিজেদের মূল্যবান আবাসন, বাড়ি-ঘর এবং মিল কল-কারখানা নির্মাণের সময় বৈদ্যুতিক ক্যাবল এবং যন্ত্রপাতির সঠিক মান যাচাই-বাছাই করেই ব্যবহার করতে হবে। তাহলেই এমন দুর্ঘটনা কিছুটা কমানো সম্ভব। বিদ্যুৎ ব্যবহারে সচেতনতার অভাবেই বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিটের ঘটনা ঘটে। আর এতে বিশেষ করে আবাসিক ভবনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়ে থাকে। সে কারণে বিদ্যুৎ ব্যবহারে আরো বেশি সতর্ক ও সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স দফতরের সূত্রমতে, গেল বছরে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার মধ্যে রাজশাহী, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, জয়পুরহাট, রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও এবং পঞ্চগড়ে মোট ৭ হাজার ৬৫৩টি অগ্নিকাণ্ডে ১৮৯ জন নারী-পুরুষ প্রাণ হারান। আহত হন অন্তত ৮৯ জন। এসব ঘটনায় সোয়া ৪৬ কোটির বেশি টাকা মূল্যের সম্পদ পুড়ে ছাই হয়ে যায়। তবে ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকর্মীরা প্রায় ১৬৫ কোটি টাকা মূল্যের সম্পদ রক্ষা করেন। পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল ২১৬ দুর্ঘটনায় ১৬০ জন পুরুষ ও ২৯ জন নারীর মরদেহ উদ্ধার করে।

আরও পড়ুনঃ  মারা গেছেন হেফাজত মহাসচিব কাসেমী

অনুসন্ধান ও প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গ্যাস সিলিন্ডার, বিভিন্ন মার্কেট ও হাট-বাজারের অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের সংখ্যা অনেক বেশি। অন্যদিকে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকেই সবচেয়ে বেশি এক হাজার ৯৯২ অগ্নিকাণ্ড হয়েছে। এছাড়া ইলেকট্রিক চুলা, গ্যাস ও মাটির চুলা থেকে ৯১৭টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এরপরেই রয়েছে বিড়ি-সিগারেটের আগুন থেকে ৮২৪টি, ছোট শিশুদের আগুন নিয়ে খেলার মাধ্যম ৩২০টি, উত্তপ্ত ছাই ও জ্বালানি থেকে সৃষ্ট ২৬৩টি, খোলা বাতির যথেচ্ছা ব্যবহার থেকে ১৮৩টি, উশৃঙ্খল জনতা ও শত্রুতামূলক অগ্নিসংযোগে ৮০টি, যন্ত্রাংশের ত্রুটিজনিত কারণে ৪৫টি, গ্যাস লাইনের ত্রুটি থেকে ১৩টি, গ্যাস সিলিন্ডার এবং বয়লার বিস্ফোরণের মাধ্যমে ৮টি, যানবাহনের দুর্ঘটনার কারণে ৩টি, বজ্রপাতের মাধ্যমে ২টি, মেশিনের মিস ফায়ারে ২টি, রাসায়নিক বিক্রিয়ায় ১টি, বাজি পোড়ানোর মাধ্যমে ১টি, উচ্চতাপজনিত কারণে ১টি এবং অজ্ঞাত অন্যান্য কারণে ৩৮৪টি অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স রংপুর বিভাগীয় কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক মোহাম্মদ ছালেহ উদ্দিন দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে শহর এলাকার ৭০ শতাংশই সূত্রপাত হয়েছে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে। বিভিন্ন মিল-কারখানা, আবাসিক ভবন, পাটের গুদাম, বস্ত্র ও সুতার কারখানা, গুদাম, সরকারি-বেসরকারি অফিস, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে এসব অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়।
অগ্নিকাণ্ডের কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে উপপরিচালক বলেন, নিম্নমানের নকল বৈদ্যুতিক ক্যাবল, ফিটিংস সুইস, সকেটসহ অন্যান্য বৈদ্যুতিক সামগ্রী ব্যবহারের মাধ্যমে বাসাবাড়ি, বাণিজ্যিক স্থাপনাসমূহে বৈদ্যুতিক সংযোগ দেয়ার ফল হিসেবেই সাধারণত অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী, ঠিকাদার ও ইলেট্রিশিয়ানের স্বার্থপরতা মূলত দায়ী।

আরও পড়ুনঃ  ঢাকা মেডিকেলে আগুন আতঙ্ক

ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা মনে করছেন, একশ্রেণির মানুষ সস্তায় কম দামের বৈদ্যুতিক সামগ্রী ব্যবহার করতে গিয়ে এসব ভয়াবহ দুর্ঘটনার শিকার হয়ে থাকে। বিদ্যুতের লোড ক্যাপাসিটি এবং নিয়ম না জেনেই অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন যন্ত্রপাতির ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া অসচেতনতা, চোরাইভাবে বৈদ্যুতিক সংযোগের মাধ্যমে অবৈধভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হয়। এর ওপর বিদ্যুৎ ব্যবহারে জ্ঞানের অভাবে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট হয়ে থাকে। বিশেষ করে আবাসিক ভবনসমূহে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়ে থাকে।

এসব অগ্নিকাণ্ড বিষয়ে জনসাধারণকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে মোহাম্মদ ছালেহ উদ্দিন বলেন, নিজেদের মূল্যবান আবাসনের জন্য বাড়ি-ঘর এবং মিল কল-কারখানা নির্মাণ করার সময় বৈদ্যুতিক ক্যাবল এবং যন্ত্রপাতির সঠিক মান যাচাই-বাছাই করে সেসব ব্যবহার করতে হবে।

প্রাপ্ত সূত্রমতে, ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১ হাজার ৩৪১টি অগ্নিকাণ্ড বাসা-বাড়ি ও আবাসিক ভবনে, ৯৩০টি গোশালা ও খড়ের গাদা থেকে, ৬২৪টি রান্নাঘর থেকে, ৩১৩টি বিভিন্ন দোকান থেকে, ৯৯টি হাট-বাজার থেকে, ৮৭টি বস্তি থেকে, ৬৪টি বিভিন্ন হোটেল রেস্তোরাঁ থেকে, ৫১টি শপিংমল ও মার্কেট থেকে, ৪২টি পাট গুদাম ও পাটকল থেকে, ৩৯টি গ্যাস লাইন ও গ্যাস সিলিন্ডার থেকে, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ২৫টি, গাড়ির আগুনে ২১টি, কল কারখানায় ১৫টি, হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ১৫টি, বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে ২১টি, সরকারি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা কেপিআইয়ে ৪টি এবং অন্যান্য কারণে ৫৭৩টি অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়।

সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, শহর ও গ্রামে বিদ্যুতের ব্যবহার ও আগুনের যথাযথ ব্যবহার সম্পর্কে তেমন কোনো প্রচারণা না থাকায় এ ধরণের ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে। তার সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে প্রচার প্রচারণা চালিয়ে সর্বস্তরের মানুষকে আগুন ও বিদ্যুতের ব্যবহার সর্ম্পকে সচেতন করতে হবে। অন্যথায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বেড়ে গিয়ে আরো প্রাণহানি হতে পারে।

আরও পড়ুনঃ  করোনায় শহরের ৬৯ ভাগ মানুষ খাবার কেনা কমিয়েছেন

আনন্দবাজার/শহক

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন