শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

চাপ বাড়ছে গ্রামে

চাপ বাড়ছে গ্রামে

রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ইকরচালী এলাকার আয়শা খাতুন (৪৫) ঢাকায় একটি বাসাবাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ করতেন। করোনা আতঙ্কে বাড়িওয়ালা তাকে কাজ থেকে বাদ দেওয়ায় নিজ এলাকায় ফিরে এসেছেন। স্বামী পরিত্যক্তা এবং ভিটেমাটিহীন এই নারী এক সন্তান নিয়ে এখন দিশেহারা।

রংপুর নগরীর তাজহাট এলাকার হাসেন আলী (৫৫) ঢাকা ওয়ারীতে একটি প্রেসে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করতেন। প্রতি মাসে বেতন পেয়ে বাড়িতে টাকা পাঠাতেন। দুই ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে ভালোই চলছিল সংসার। কিন্তু করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার শুরুতে বাড়িতে ফিরে আসেন তিনি। প্রেস খোলার কথা থাকলেও আর খোলেনি। সেই সঙ্গে তাকে চাকরি থেকে ছাঁটাই করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এখন খুব কষ্টে জীবনযাপন করছেন তিনি।

এমনি করে করোনা দুর্যোগে রংপুর অঞ্চলের দুই লক্ষাধিক মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। অন্য পেশায় নিয়োজিত যাদের উপার্জন একেবারেই সীমিত, তারাও অর্থ সংকটে ভাড়াবাসা ছেড়ে দিয়ে ফিরেছেন গ্রামে। উন্নয়ন গবেষকরা বলছেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হতেই করোনার ঊর্ধ্বগতিতে গ্রামে ফের চাপ বাড়ছে। বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হলে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসার শঙ্কা রয়েছে।

শুরু থেকে করোনার থাবায় এমনিতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে আছেন গ্রামাঞ্চলের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। কর্মহীন হয়ে পড়া এসব মানুষের সঞ্চয় বলতে কিছু না থাকায় অর্থনৈতিক প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সমাজের নানা স্তরে। নতুন করে করোনার উধ্বমুখী সংক্রমণে মানুষের মনে এক ধরণের অস্থিরতা বিরাজ করছে, ভর করছে এক অজানা শঙ্কা। তার ওপর চাকরি হারানো বিশাল অঙ্কের জনগোষ্ঠী গ্রামে যুক্ত হওয়ায় পড়ছে কাজের আকাল। অভাব-অনটনে পড়ে অনেকেই জীবিকার তাগিদে অসৎ পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন।

আরও পড়ুনঃ  কুমিল্লায় উচ্ছেদ অভিযান অব্যাহত

রংপুরের সবচেয়ে অভাবি এলাকা হিসেবে পরিচিত গঙ্গাচড়া। এলাকায় কাজ না থাকায় এখানকার তিস্তার ভাঙনে সর্বস্বান্ত হওয়া পরিবারের প্রধানরা আয়ের সন্ধানে বছরের বেশিরভাগ সময় থাকতেন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। সেখানে তারা কৃষি শ্রমিক ও নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করাসহ কেউ রিকশা চালাতেন, কেউবা কাজ করতেন পোশাক কারখানায়। কিন্তু করোনার থাবায় সেখানেও আর সুবিধা মিলছে না। কাজ-চাকরি হারিয়ে বাধ্য হয়ে তারা ফিরে এসেছেন বেকারত্বের এলাকা নিজ গ্রামে।

চাকরিহারা তিস্তার চরের আব্দুল মতিন ঢাকার শাহবাগে একটি ছোট্ট গার্মেন্টস এ কাজ করতেন। করোনা শুরুর প্রাক্কালে ওই প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাড়িতে ফিরে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘কয় বছর থাকি ওইখানে চাকরি করি কোনমতে সংসার চলছিল। এ্যালা বাড়িত বসি আছি, কোন কাম (কাজ) নাই। বউ-ছাওয়া নিয়া খুব কষ্টে আছি।’

রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের চরগ্রাম জয়রামওঝা। এখানকার ইউপি সদস্য দুলাল মিয়া জানান, এই চরে ৮০০ পরিবারের বাস। জীবিকার তাগিদে ৬০০ পরিবারের প্রধানই বছরের বেশিরভাগ সময় কাজের সন্ধানে ছুটে যান ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। করোনার কারণে কাজ না থাকায় বর্তমানে তাদের অনেকেই বাড়িতে ফিরে এসেছেন। বেকার হয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছেন। অপরাধমুলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছেন কেউ কেউ।

উন্নয়ন গবেষকরা বলছেন, করোনা সংক্রমণে দেশের বিভিন্ন স্থানে চাকরি করা রংপুর বিভাগের আট জেলায় দুই লক্ষাধিক মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। এসব মানুষ এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন। দেশের মানচিত্রে উত্তরাঞ্চলে নতুন করে দারিদ্র্যের হার বাড়ছে। শহর থেকে কর্ম হারিয়ে গ্রামে ফিরে আসা মানুষদের নতুন করে কর্মসংস্থানের অভাব সৃষ্টি হয়েছে। এতে কর্মহীনদের মাঝে হতাশাসহ বাড়ছে অপরাধ প্রবণতা।

আরও পড়ুনঃ  গাজীপুরে সশস্র প্রতিরোধ দিবসে জেলা পরিষদের শ্রদ্ধা নিবেদন

রংপুরের উন্নয়ন নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য এখন সরকারি কর্মচারি ছাড়া কেউ ভালো নেই। গবেষণা বলছে, প্রায় দুই কোটি মানুষ চাকরি হারিয়ে গ্রামে এসেছেন। এর আগে দেশে চার কোটি মানুষ অসহায় ছিল। তাই আমরা বলছি এখন ৩৫ শতাংশ মানুষ দেশে দরিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। বিশেষ করে কর্ম হারিয়ে পিছিয়ে পড়া রংপুরে দুই লক্ষাধিক মানুষ ফিরে আসার বিষয়টি হতাশাব্যঞ্জক।

কর্মহীন মানুষদের মূল স্রোতধারায় আনতে না পারলে দেশের দারিদ্র্য মানচিত্রে বড় ক্ষতি হবে। সেজন্য কৃষিনির্ভর এই এলাকায় কৃষিভিত্তিক শিল্পকারখানা স্থাপন করে গ্রামীণ কর্মসংস্থান সৃষ্টির ওপর জোর দেন তিনি।

আনন্দবাজার/শহক

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন