শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

চিকিৎসা নিতে সংক্রমণ ঝুঁকি

চিকিৎসা নিতে সংক্রমণ ঝুঁকি

করোনার তৃতীয় দফায় উর্ধ্বমুখী সংক্রমণ রোধে সরকারের পক্ষ থেকে জারি করা হয়েছে ১১ দফা বিধিনিষেধ। গত ১৩ জানুয়ারি থেকে তা কার্যকরও হয়েছে। উন্মুক্ত স্থানে সবরকম সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও সমাবেশ তথা জনসমাগত বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে পরবর্তী সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত সবাইকে জারি করা বিধিনিষেধ বাধ্যতামূলকভাবে মেনে চলার কথাও বলা হয়েছে। নির্দেশনা জারির পর এক সপ্তাহ কেটে গেছে। তবে কঠোরভাবে বিধিনিষেধ মানার প্রবণতা সেভাবে দেখা যাচ্ছে না। বিশেষ করে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল, ক্নিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও স্বজনদের ভিড় করোনা সংক্রমণের আশঙ্কা বাড়িয়ে দিচ্ছে।

চিকিৎসা সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোতে জনসমাগম এড়িয়ে রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হলেও তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না। স্থানীয়দের মধ্যে নির্দেশনার কোনো প্রভাব পড়ছে না। অনেক শহর বা এলাকাকে সংক্রমণের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বলা হলেও সে ব্যাপারে সাধারণ মানুষের মধ্যে কোনো সচেতনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি। সন্দেহভাজন সংক্রমিতরা সমাগমে থাকায় চিকিৎসা নিতে আসা রোগী আর তাদের স্বজনরা পড়ছেন চরম ঝুঁকিতে। দৈনিক আনন্দবাজারের প্রতিনিধিরা দেশের এলাকা থেকে এমন উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার খবর পাঠিয়েছেন।

স্বপন চৌধুরী, বিশেষ প্রতিনিধি: ফের করোনা ভাইরাসের ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের মধ্যে উত্তরের বিভাগীয় নগরী রংপুরকে ইয়েলো জোন (মধ্যম ঝুঁকিপূর্ণ) হিসেবে ঘোষণা করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। চিকিৎসা সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোতে জনসমাগম এড়িয়ে রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হলেও তা মানা হচ্ছে না। বিশেষ করে স্থানীয়দের মধ্যে নির্দেশনার কোনো প্রভাব পড়েনি। করোনা সংক্রমণের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বলা হলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে নেই কোনো সচেতনতা। মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি।

জনসমাগমে করোনাভাইরাসের ঝুঁকি বেশি হলেও নগরীর বড় বড় ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে রোগীদের ভিড়ের কারণে সৃষ্ট জনসমাগম কিছুতেই রোধ করা যাচ্ছে না। প্রতিদিন এসব ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গড়ে দুই হাজারের বেশি মানুষের সমাগম ঘটছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এই জনসমাগমের কবলে পড়ে নাস্তানাবুদ হচ্ছেন চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা। ছোটখাট সমস্যাতেও একগাদা টেস্ট (পরীক্ষা-নিরীক্ষা) করাতে গিয়ে সিরিয়াল অনুযায়ী লাইনে দাঁড়িয়ে ভিড়ের চাপে পড়তে হচ্ছে রোগীদের। এসব কারণে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনরা করোনা সংক্রমণের চরম আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠায় থাকলেও প্রতিরোধে কোনো পদক্ষেপই নেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।

আরও পড়ুনঃ  ৫০০ পরিবারকে অনন্ত জলিলের খাদ্যপন্য বিতরণ

তবে স্বাস্থ্য বিভাগ দাবি করছে, করোনাভাইরাস রোধে সরকারি-বেসরকারি ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে জনসমাগম এড়ানোসহ বিশেষ করে হাঁচি-কাঁশির রোগীকে অন্য রোগীর সংস্পর্শে না এনে আলাদা চিকিৎসা দিতে বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে বাস্তবক্ষেত্রে সেসব দিক নির্দেশনা মেনে চলার কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না।

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে ঘিরে বিভাগীয় শহর রংপুর চিকিৎসার নগরী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। বিশেষ করে নগরীর মেডিকেল মোড়, আরকে রোড ও ধাপ এলাকায় গড়ে উঠেছে অসংখ্য প্রাইভেট ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। রংপুরসহ বিভাগের আট জেলার রোগীরা প্রতিদিন এখানে আসছেন চিকিৎসা নিতে। সুস্থ হতে অনেক দূর পাড়ি দিয়ে এখানে এসেই তারা ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে জনসমাগমের কবলে পড়ছেন। পাশাপাশি সন্দেহভাজন রোগীদের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হচ্ছেন। করোনাভাইরাস সংক্রান্ত স্বাস্থ্য বিভাগের নির্দেশনাও যেখানে উপেক্ষিত হচ্ছে।

সরেজমিনে নগরীর ধাপ এলাকা ঘুরে দেখা যায়, চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও স্বজনদের ভিড়ে বিশাল জনসমাগমের সৃষ্টি হয়েছে একেকটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। সকাল থেকে রাত অবধি চিকিৎসকের পরামর্শ ও বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে রোগীরা হাঁপিয়ে উঠছেন। তার ওপর অসুস্থ শরীরে সারাদিন ভিড়ের মধ্যে সন্দেহভাজন রোগীদের সঙ্গে থেকে নতুন করে করোনা সংক্রমণের শঙ্কায় রয়েছেন তারা।

নগরীর ধাপ এলাকার বহুতল ভবন পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার-১ এ গিয়ে দেখা যায়, সিঁড়ি থেকে সর্বত্র রোগীদের ভিড়ে তিল ধারণের জায়গা নেই। রোগী, চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্ট অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখানে প্রায় ২৫ জন চিকিৎসক নিয়মিত রোগী দেখেন। চিকিৎসক প্রতি গড়ে ৩০ জন রোগী দেখলে রোগীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৭৫০ জন। রোগী প্রতি গড়ে দুইজন স্বজন থাকলে তাদের সংখ্যা দাঁড়ায় দেড় হাজার। এছাড়া ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও চিকিৎসকের এটেনডেন্টসহ রয়েছেন আরও প্রায় শতাধিক লোকজন। অর্থাৎ প্রতিদিন এখানে রোগীসহ দুই হাজারের বেশি মানুষের সমাগম ঘটে।

গাইবান্ধার পলাশবাড়ি থেকে পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এসেছেন হৃদরোগে আক্রান্ত লোকমান হোসেন (৬৫)। সাইনবোর্ডে ওই রোগের চিকিৎসকের নাম খুঁজছিলেন। সঙ্গে এসেছেন তার ছেলে আকরাম ও ভাতিজা নিপুন। তারা আনন্দবাজারকে বললেন, অবস্থা দেখে মনে হয় এখানে মেলা বসেছে। চিকিৎসককে দেখাতে রাত ১১ থেকে ১২টা বাজবে। এই ভিড়ে রোগীতো আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে।

আরও পড়ুনঃ  মৌলভীবাজার-৪ আসনে উপাধ্যক্ষ ড. আব্দুস শহীদ বিজয়ী

নীলফামারী থেকে রংপুরের পপুলার-২ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অসুস্থ মাকে নিয়ে এসেছেন উত্তম সরকার। দেখাবেন নিউরোসার্জন ডা. সুকুমার মজুমদারকে। শতাধিক রোগীর ভিড়ে বসে অপেক্ষা করছিলেন সিরিয়ালের জন্য। উত্তম সরকার আনন্দবাজারকে বললেন, চিকিৎসক পর্যন্ত পোঁছাতে অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয়। তার ওপর একাধিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে ভিড়ের মাঝে লাইনে দাঁড়িয়ে রোগীর অবস্থা আরও কাহিল হয়ে পড়ে। এছাড়া হাঁচি-কাঁশিসহ সন্দেহভাজন রোগীদের আনাগোনাও রয়েছে এখানে।’ করোনার ব্যাপারে এখানে কোনো সতর্কতা নেই উল্লেখ করে উত্তম সরকার বললেন, হাজারো রোগীর সমাগমে এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটতেই পারে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিতে আসা প্রয়োজন।

এ ব্যাপারে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে পপুলার-১ ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কেউ কথা বলতে রাজি হননি। পপুলার-২ ডায়াগনস্টিক সেন্টারের জনসংযোগ কর্মকর্তা জামিল আহমেদ আনন্দবাজারকে বলেন, আসলেই রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হয়। কিন্তু চিকিৎসকদের সিরিয়াল নিয়ে রোগী এলে তো তাদের ফিরিয়ে দেওয়া যায় না। তবে করোনার ব্যাপারে জনসমাগম রোধসহ হাঁচি-কাঁশির রোগীদের চিকিৎসায় বিকল্প চিন্তা করা হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রংপুর শহরে ছোট-বড় মিলে প্রায় ১৫০টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার আছে। এর মধ্যে পপুলার, আপডেট, কছির উদ্দিন, ল্যাবএইডসহ বেশ কয়েকটি নামকরা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ২৪ ঘণ্টা রোগীদের ভিড় লেগেই থাকে। সচেতন মহল বলছেন, দেশের সর্বত্র যেখানে করোনাভাইরাস রোধে জনসমাগম এড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে রংপুরের ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে তখন চিকিৎসার নামে রোগী ও তাদের স্বজনদের বিশাল জনসমাগম সৃষ্টি করা হচ্ছে। বিষয়টি এখনই নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।

জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের রংপুর মহানগর সভাপতি অধ্যক্ষ ফখরুল আনাম বেঞ্জু আনন্দবাজারকে বলেন, শুধু বাইরের জনসমাগম সবার চোখে পড়ে, কিন্তু ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে হাজার হাজার রোগীর ভিড় কারো নজরে আসে না। এমনিতেই চিকিৎসকের সিরিয়াল পাওয়া, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকে চিকিৎসকের দেখা পাওয়া এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানোসহ রিপোর্ট নিয়ে পুনরায় চিকিৎসকের সাক্ষাৎ করতে অসুস্থ রোগীদের দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। তার ওপর জনসমাগমের কারণে তারা আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। অধ্যক্ষ ফখরুল আনাম আরো বলেন, বর্তমান সময়ে স্পর্শকাতর করোনাভাইরাস নিয়ে ওই ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে সচেতন করার কেউ নেই। তবে জেলা প্রশাসন, সিটি করপোরেশন ও সিভিল সার্জন এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে পারেন।

আরও পড়ুনঃ  স্থল বন্দর কর্তৃপক্ষের নতুন চেয়ারম্যান তরিকুল

যোগাযোগ করা হলে রংপুরের সিভিল সার্জন ডা. শামীম আহমেদ আনন্দবাজারকে বলেন, করোনাভাইরাস নিয়ে রংপুরের সরকারি-বেসরকারি ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ইতোমধ্যে সভা করা হয়েছে। জনসমাগম এড়ানোর পাশাপাশি তাদের হাঁচি-কাঁশির রোগীকে অন্য রোগীর সংস্পর্শে না এনে আলাদা চিকিৎসা দিতে বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কেউ তা না মানলে অভিযান পরিচালনা করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সিভিল সার্জন আরও জানান, রংপুর শহরে একশর বেশি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থাকলেও গুটিকয়েক ছাড়া বাকিগুলো খুব বড় আকারের নয়। বিভাগীয় শহর হওয়ায় বড় ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে রোগীদের প্রচণ্ড চাপ থাকে উল্লেখ করে তিনি বলেন, অসুস্থ হলে রোগীরা অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে আসবেন। তবে বর্তমান সময়ে করোনাভাইরাস রোধে সবাইকে জনসমাগম অবশ্যই এড়িয়ে চলতে হবে। এছাড়া সামান্য সর্দি, হাঁচি-কাঁশিতে জনসমাগমে না গিয়ে বাড়িতেই চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

উপল আরাফাত, বিভাগীয় প্রতিনিধি, রাজশাহী: রাজশাহী মহানগরীর শতাধিক বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনেস্টিক সেন্টারে মানা হচ্ছে না স্বাস্থবিধি। বেশিরভাগ রোগি ও হাসপাতালের কর্মচারীরা মাস্কবিহীন দেদারচে চলাচল করছে। মহানগরীর লক্ষ্মীপুর এলাকায় পপুলার ডায়াগনেস্টিক সেন্টার, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালসহ কয়েকটি নামিদামি ক্লিনিক ও ডায়গনেস্টিক সেন্টার রয়েছে। এগুলোতে প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষের যাতাযাত। বিশেষ করে গ্রাম থেকে আসা রোগিদের প্রচুর চাপ থাকে এসব জায়গায়।

সাধারণ মানুষের মধ্যে তো সচেতনতা নেই-ই, ক্লিনিক বা ডায়াগনেস্টিক কর্তৃপক্ষও এ বিষয়ে বেশ উদাসীন।
নওগাঁর জেলার পোরশা থানার শুড়িপুকুর গ্রামের মানিক মণ্ডল। তিনি রাজশাহী এসেছেন চিকিৎসা নিতে। গতকাল বুধবার দুপুরে লক্ষ্মীপুর এলাকায় এক ওষুধের দোকানে দেখা হয় তার সঙ্গে। নিজে রোগী হলেও মুখে ছিলো না মাস্ক। নিজের ভুল স্বীকার করে নিয়ে মানিক মণ্ডল পকেট থেকে মাস্ক পরে বলেন, আসলে মনে ছিল না। এটা ভুল হয়েছে। মানিক মণ্ডলের মতো অনেকেই এমন ভুল করে যাচ্ছেন।

আনন্দবাজার/শহক

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন