শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ভবিষ্যৎ প্রজম্মের বাতিঘর শহীদ কাদিরের স্মৃতিসৌধ

ভবিষ্যৎ প্রজম্মের কাছে বাতিঘর শহীদ কাদিরের স্মৃতিসৌধ

রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলাধীন দামোদরপুর ইউনিয়নের মোস্তফাপুর গ্রাম। যেখানে জন্মেছিলেন শহীদ বীরমুক্তিযোদ্ধা ও বুদ্ধিজীবি লেফটেন্যান্ট কর্ণেল মুহাম্মদ আব্দুল কাদির। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর ওই গ্রামে নির্মাণ করা হল স্মৃতিসৌধ।

আব্দুল কাদির ও স্থানীয় শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি রক্ষায় নির্মিত স্মৃতিসৌধটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয় গত ৮ জানুয়ারি। শহীদ লেফটেন্যান্ট কর্ণেল মুহাম্মদ আব্দুল কাদিরের ছেলে রক্তধারা’ ৭১ এর সভাপতি ও বিশিষ্ট সাংবাদিক নাদিম কাদির নিজ উদ্যোগে তার বাবার জন্মভিটা মোস্তফাপুর গ্রামে চিকলি নদীর তীরে স্মৃতিসৌধটি নির্মাণ করেন। শহীদ লেফটেন্যান্ট কর্ণেল মুহাম্মদ আব্দুল কাদির মোস্তফাপুর গ্রামের মরহুম আবুল হোসেন মিয়ার ছেলে। তৎকালীন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একজন সিনিয়র বাঙালি অফিসার ছিলেন তিনি।

১৯৭০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর বন্দরনগরী চট্টগ্রামে প্রধান নিয়ন্ত্রক হিসেবে তেল ও গ্যাস উন্নয়ন কর্পোরেশনে যোগদান করেন। চট্টগ্রামে দায়িত্ব নেয়ার পর তিনি গোপনে বর্তমান সংসদ সদস্য মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তম, আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতা এবং কয়েকজন জুনিয়র বাঙালি সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু করার ঠিক আগে লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাদির তার অফিসে মজুদ বিস্ফোরক স্বাধীনতাকামী জনগণকে সরবরাহ করেছিলেন। সেই বিস্ফোরক ব্যবহার করে স্বাধীনতাকামী জনতা ফেনীর শুভপুর সেতু উড়িয়ে দিয়ে চট্টগ্রামে পাকিস্তানি সেনাদের প্রবেশপথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেন। পরে লেফটেন্যান্ট কর্ণেল কাদির পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে অন্যদের সাথে চট্টগ্রাম ত্যাগ করে ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলায় যান। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল কর্ণেল কাদির তার গর্ভবতী স্ত্রীকে দেখতে চট্টগ্রামে আসলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাকে তার বাসভবন থেকে আটক করে নিয়ে যায়। সেই থেকে নিখোঁজ ছিলেন কর্নেল কাদির।

আরও পড়ুনঃ  অন্য ব্র্যান্ডের চাল প্রস্তুত করায় লাখ টাকা জরিমানা

স্বাধীনতার ৩৬ বছর পর ২০০৭ সালে চট্টগ্রামের পাঁচলাইশে বাবার কবর খুঁজে পান শহীদ লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাদিরের ছেলে ‘রক্তধারা’ ৭১ এর সভাপতি সাংবাদিক নাদিম কাদির। তিনি জানান, ব্রিগেডিয়াার জেনারেল মো. বায়েজিদ সারওয়ারের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ২০০৭ সালে আমাদের চট্টগ্রামের বাসভবনের নিকটবর্তী স্থান থেকে লেফটেন্যান্ট কর্ণেল কাদিরের কবর না পাওয়া পর্যন্ত তিনি নিখোঁজ ছিলেন। পরে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ২০১১ সালে তার দেহাবশেষ নাটোরের কাদিরাবাদ সেনানিবাসে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পুনরায় সমাহিত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে শহীদ লেফটেন্যান্ট কর্ণেল মুহাম্মদ আব্দুল কাদিরের নামে নাটোরের কাদিরাবাদ সেনানিবাসের নামকরণ করা হয়।

শহীদ লেফটেন্যান্ট কর্ণেল মুহাম্মদ আব্দুল কাদিরের জন্মভিটা বদরগঞ্জের মোস্তফাপুরে জাতীয় পতাকা উত্তোলনসহ ফিতা কেটে ও বেদীতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে নবনির্মিত স্মৃতিসৌধের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন সংসদ সদস্য আরোমা দত্ত। এসময় তিনি বলেন, ৭১’র মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস আগামী প্রজন্মের মাঝে তুলে ধরতে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে প্রতিটি গ্রামে স্মৃতিসৌধ নির্মাণসহ মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে চর্চাকেন্দ্র গড়ে তোলা উচিত। স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরে হলেও প্রত্যন্ত একটি গ্রামে যে স্মৃতিসৌধ নির্মিত হলো তা ভবিষ্যৎ প্রজম্মের কাছে বাতিঘর হিসেবে থেকে যাবে। এসময় শহীদ বীরমুক্তিযোদ্ধা এবং বুদ্ধিজীবি লেফটেন্যান্ট কর্ণেল মুহাম্মদ আব্দুল কাদিরের স্মরণে যারা এই স্মৃতিসৌধ নির্মাণে উদ্যোগী হয়েছেন তাদের প্রতিও শ্রদ্বা এবং কৃতজ্ঞতা জানান আরোমা দত্ত।

মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের উত্তরসূরীদের সংগঠন রক্তধারা’ ৭১ আয়োজিত স্মৃতিসৌধের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট সাংবাদিক নাদিম কাদিরের সভাপতিত্বে আরো বক্তব্য রাখেন স্থানীয় সংসদ সদস্য আবুল কালাম মো. আহসানুল হক চৌধুরী ডিউক, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক ব্রিগেডিয়াার জেনারেল মো. বায়েজিদ সারোয়ার, রক্তধারা’ ৭১ এর সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান তালুকদার, স্মৃতিসৌধের স্থপতি ফুয়াদ হায়দার, বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব রহমান হাবলু, শহীদ কর্ণেল কাদির পরিবারের সদস্য সালেক মিয়া, বদরগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান ফজলে রাব্বী সুইট, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুর রহমান প্রমুখ।

আরও পড়ুনঃ  করোনায় ছোবল থেকে বাঁচতে পারেনি গার্মেন্টস মালিক

শহীদ লেফটেন্যান্ট কর্ণেল মুহাম্মদ আব্দুল কাদিরের ছেলে বিশিষ্ট সাংবাদিক এবং স্মৃতিসৌধ নির্মাণের প্রধান পৃষ্ঠপোষক সাংবাদিক নাদিম কাদির বলেন, ‘আমার বাবা মারা যাওয়ার প্রায় ৫০ বছর পর ২০১৮ সালে আমি গ্রামে ফিরে আসি। এখানে এসে বাবার কোনো স্মৃতিচিহ্ন না পেয়ে কষ্ট পাই। তাই বাবাসহ এই গ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিকে ধরে রাখা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধরে রাখতে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের উদ্যোগ নেই।’

স্থানীয় সংসদ সদস্য আহসানুল হক চৌধুরী ডিউক বলেন, শিগগিরই মোস্তফাপুর গ্রামে চিকলি নদীর ওপর নির্মিত সেতুটির নামকরণ করা হবে শহীদ বীরমুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট কর্ণেল মুহাম্মদ আব্দুল কাদিরের নামে। এছাড়া এদেশের শ্রেষ্ঠ সূর্য সন্তানদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য বদরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন সেতু ও সড়কের নামকরণ বীরমুক্তিযোদ্ধাদের নামে করারও ঘোষণা দেন তিনি।

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন