রাজশাহী মহানগরীর শালবাগান এলাকায় একটি কমিউনিটি সেন্টারে গত শুক্রবার বিয়ের আয়োজন ছিল। দুপুরে বরযাত্রীরা যথা সময়ে উপস্থিত। আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেই খাবার আয়োজন। টেবিলের উপরে সাজানো আছে অনেক দামি সব খাবার। রোস্ট, পোলাও, মাংস, সালাদ, আরো কতো কি! খাওয়াও শুরু হয় বেশ উৎফুল্লচিত্তে। খাবার উপকরণগুলো যে সুস্বাদু সেটাও উচ্চারিত হয় অনেকের মুখে। কেউ কেউ নীরবেই খাবার উপভোগ করেন।
তবে খাবার শেষে দেখা যায় অন্যরকম দৃশ্য। অনেকের পাতেই থেকে যায় সুস্বাদু সেসব খাবারের অনেকখানি। কারো পাতে মাংস, কারো পাতে পোলাও, আবার কারো পাতে রোস্টের অবশিষ্ট অংশ। ব্যক্তি হিসেবে নিজের কাছে সামান্য এই অপচয়টা হয়তো কিছুই নয়। তবে সামষ্টিকভাবে দেখলে এই সামান্য অপচয়ই অনেক বড়। বলা যায়, বিন্দু বিন্দুতেই সিন্ধু পরিমাণে খাদ্য নষ্ট করছি আমরা। এতে বিপুল পরিমাণ নষ্ট করছি যে বছর শেষে এ পরিসংখ্যানটা চোখ কপালে উঠে যাওয়ার মতো।
২০২১ সালে জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে চোখ কপালে ওঠার মতো তথ্য। সংস্থাটির ফুড ওয়েস্ট ইনডেক্স রিপোর্ট ২০২১ এ বলা হয়েছে, এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই বছরে এক কোটি ৬ লাখ ১৮ হাজার ২৩৩ টন খাদ্যের অপচয় হয়। বাংলাদেশি পরিবার প্রতি বছরে গড়ে ৬৫ কেজি খাবার অপচয় হয়। এগুলো শুধু গৃহস্থালীতে ব্যবহৃত খাদ্যের অপচয়।
এর দুবছর আগে খাদ্য অপচয় সূচক প্রতিবেদনে ২০১৯ সালেরও একটি চিত্র তুলে ধরা হয়। এতে দেখানো হয়, ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাপী ৯৩ দশমিক এক কোটি টন খাদ্য অপচয় করা হয়েছে। এর মধ্যে গৃহস্থালী থেকে নষ্ট হয়েছে ৬১ শতাংশ খাবার। ২৬ শতাংশ খাবার নষ্ট করেছে খাদ্য বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। আর খুচরা বিক্রয়কেন্দ্রগুলো থেকে নষ্ট হয়েছে বাকি ১৩ শতাংশ খাবার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বিপুল পরিমাণে গৃহস্থালী খাদ্য অপচয় রোধে নাগরিক পর্যায়ে সচেতনতা বাড়ানো ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। খাদ্য নিয়ে কাজ করা এনজিও ব্যক্তিত্বদের মতে, ব্যক্তি পর্যায়ে সচেতনতা না বাড়লে এ খাদ্য অপচায় কোনোভাবেই রোধ করা যাবে না।
এবার গৃহস্থালী খাদ্য অপচয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর দিকে তাকানো যাক। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারতের প্রত্যেক পরিবার বছরে গড়ে ৫০ কেজি করে খাবার অপচয় করে, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে সর্বনিম্ন। তবে টনের হিসেবে বছরে যা ৬ কোটি ৮৭ লাখ ৬০ হাজার টন। পাকিস্তানে প্রতি বছর পরিবার প্রতি ৭৪ কেজি খাবারের অপচয় হয়। বছরে যা এক কোটি ৫৯ লাখ ৪৭ হাজার টন। এদিকে শ্রীলঙ্কায় বছরে পরিবার প্রতি ৭৬ কেজি খাবারের অপচয় হয়, যা সর্বোচ্চ। তবে টনের হিসেবে তা অনেক কম, মাত্র ১৬ লাখ ১৭ হাজার টন। এছাড়াও মালদ্বীপে প্রতি বছর পরিবার পর্যায়ে ৭১ কেজি খাবার নষ্ট হয়। আফগানিস্তানে এই পরিমাণ ৮২ কেজি, নেপাল ও ভুটানে ৭৯ কেজি খাদ্য অপচয় হয়।
বিশ্বে বছরে প্রায় ১৩০ কোটি টন খাদ্য অপচয় হয়, যা মোট উৎপাদিত খাদ্যের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। অপচয় হওয়া বিপুল পরিমাণ এই খাবারের এক-চতুর্থাংশ বাঁচানো গেলে ৮৭ কোটি মানুষের প্রয়োজন মেটানো সম্ভব। বিশ্বে খাদ্য অপচয়ের কারণে বছরে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে প্রায় পঁচাত্তর হাজার কোটি ডলার।
বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর ক্যাপাসিটি বিল্ডিং অফ ভলান্টারি অরগানাইজেশনের (সিসিবিভিও) চলমান রক্ষাগোলা গ্রামভিত্তিক স্থিতিশীল খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচির সমন্বয়ক আরিফ আনন্দবাজারকে বলেন, জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, সারা বিশ্বে প্রতি মাসে ১০ হাজার শিশু মারা যায় খাদ্যের অভাবে। প্রতিদিন সারা বিশ্বে ৮২ হাজার মানুষ রাতে না খেয়ে ঘুমায়। অথচ বিশ্বে উৎপাদিত খাবারের ১৩০ কোটি টন মানুষ নষ্ট করে। যা মোট উৎপাদনের এক-তৃতীয়াংশ। এমন পরিসংখ্যা থেকেই বোঝা যায় যে আমাদের সামান্য সচেতনতা দেশ ও বিশ্বে কি পরিবর্তন আনতে পারে।
আরিফ আরো বলেন, অপচয় হওয়া খাদ্যের পরিণাম ব্যাপকভাবে বিস্তৃত। এই খাদ্য অপচয় যদি কমানো সম্ভব হয় তাহলে খাদ্যের সরবরাহ বাড়বে, প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর চাপ কমবে।
আনন্দবাজার/শহক