শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পরিবেশবান্ধব রেলওয়ের চিন্তা

পরিবেশবান্ধব রেলওয়ের চিন্তা

রেলওয়ের সম্প্রসারণ, আধুনিকায় ও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে যুক্তরাজ্য, জার্মান, ফ্রান্স, স্পেন ও রাশিয়া সফর করেছেন রেলমন্ত্রীসহ রাষ্ট্রের ১৫ কর্মকর্তা। ৫টি দেশের ১২টি কোম্পানি পরিদর্শনসহ বিভিন্ন সেমিনার ও মেলায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশের রেলওয়েতে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়ে কোন সাড়া মেলেনি এ সফরে।

স্পেন ও রাশিয়া রেলওয়ের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে একসঙ্গে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের আগ্রহ দেখালেও নির্দিষ্ট পরিমাণে অর্থবিনিয়োগের বিষয়ে কোন কথা বলেননি। এমনকি বিশে^র বিভিন্ন কোম্পানিগুলোকে বিনিয়োগের আহ্বান জানালেও তারা পণ্যবিক্রির আগ্রহ দেখিয়েছে।

গতকাল মঙ্গলবার রাজধানী ঢাকার রেলভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে রেলপথমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা জানান।

২০২১ সালের ২২ নভেম্বর হতে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত যুক্তরাজ্য, জার্মান, ফ্রান্স, স্পেন সফর করেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. সেলিম রেজা (বর্তমানে অবসর), অতিরিক্ত সচিব ভুবন চন্দ্র বিশ^াস, অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অবকাঠামো) মো. কামরুল আহসান, অতিরিক্ত মহাপরিচালক (রোলিং স্টক) মো. আতিকুর রহমান, যুগ্ম-সচিব মো. মঞ্জুরুল ইসলাম চৌধুরী, উপসচিব মো. নাজমুল হক ও মন্ত্রীর একান্ত সহকারি সচিব মো. রাশেদ প্রধান।

অন্যদিকে ১৮ হতে ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত রাশিয়া সফর করেন রেলমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক ধীরেন্দ্র নাথ মজুমদার, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব শেখ সাকিল উদ্দিন আহমদ, উপসচিব মো. মীর আলমগীর হোসেন, প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশল (পূর্ব) মো. বোরহান উদ্দিন, চিফ অপারেটিং সুপারিনটেনডেন্ট (পশ্চিম) মো. শহিদুল ইসলাম, সহকারি প্রোগ্রামার মো. মাহফুজুর রহমান ও মন্ত্রীর একান্ত কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিসহ ৮ সদস্যের আরো একটি কমিটি।

৫টি দেশ সফর করে কি পরিমাণ বিনিয়োগের প্রস্তাব পাওয়া গেছে এমন প্রশ্নে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, আমরা ভিক্ষা করতে যাইনি। তাদের কাছ থেকে অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে গিয়েছিলাম। কেননা আমাদের দেশে রেলের যাত্রা শুরু সাড়ে তিনশ বছর আগে অর্থাৎ ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বরে। মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু কিছু কাজ করলেও অন্যকোন সরকার আর কোন কাজ করেনি। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে কিছু কাজ হয় এবং দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতা গ্রহণ করে ২০০৯ সালে রেলপথ নিয়ে নতুন করে কাজ শুরু করেন। এ বিষয়ে আলাদা মন্ত্রণালয় গঠন করে রেলপথ নিয়ে মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করে কাজ করছেন।

আরও পড়ুনঃ  আগামীকাল দেখা দেবে ক্ষুদ্রতম চাঁদ

মহাপরিকল্পনার আলোকে কত শতাংশ ও গত তিন বছরে বর্তমান মন্ত্রীর নেতৃত্বে কাজের অগ্রগতি কত শতাংশ হয়েছে দৈনিক আনন্দবাজারের এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, অগ্রগতি হয়েছে। তবে শতাংশ হিসেবে আমরা বলতে পারবো না। কাজ চলমান। আমরা একটি রুপরেখাকে সামনে ধরে কাজ করছি। অচিরেই তা দৃষ্টিতে আসবে।

তিনি জানান, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনকে মাল্টি মডেল হাবে পরিণত করতে জাপানের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। ২০২৪ সালে এটির কাজ শুরু হবে। এখন সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ চলছে।

মন্ত্রী জানান, ঢাকা-চট্টগ্রামে ইলেক্ট্রিক রেলপথ চালুর ব্যয় নিয়ে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ চলমান। বিশে^র অনেক দেশ তেলের পরিবর্তে গ্যাসে রেললাইন চালু করছে। আমরা সেসব বিষয় নিয়ে কাজ করছি। বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা বিনিময়ের জন্য কাজ করছি।

তিনি জানান, গতবছরের নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রী কপ-২৬ সম্মেলনে বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছে রোড শো করেছেন। নানান দেশকে বিনিয়োগ করতে সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছেন, তার আলোকে রেলকে নতুন আঙ্গিকে সাজানো হচ্ছে।

মন্ত্রী জানান, যুক্তরাজ্যের আইএম পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডকে ঢাকা-ভাঙ্গা-পায়রা-কুয়াকাটা পর্যন্ত ডেডিকেটেড ফ্রেইড করিডোর নির্মাণে বিনিয়োগের প্রস্তাব করা হয়। এতে তাদের আগ্রহের বিষয়টি জানিয়েছে। তারা রেলওয়ের জনবলের কারিগরি প্রশিক্ষণ ও ক্যাপাসিটি বিল্ডিং এ কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করায় একটি প্রস্তাবনা আহ্বান করা হয়েছে। স্পেনের ট্রান্সপোর্ট, মোবিলিটি ও আরবান এজেন্ডা বিষয়ক মন্ত্রী র‌্যাকুয়েল সানচেজ জেমিনজ রেলওয়েতে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের (এমওইউ) আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

অন্যদিকে রাশিয়ার ট্রান্স মেস হোল্ডিং (টিএইচএম) কোম্পানি রেলওয়ের আধুনিকায়নে আরামদায়ক যাত্রাবাহী কোচ, মালবাহী ওয়াগন, লোকোমোটিভ এবং অন্যান্য রোলিং স্টক যন্ত্রপাতি সরবরাহ, স্থানীয়ভাবে সংযোজন এবং বিক্রয় পরবর্তী রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়ে এমওইউ’র আগ্রহ জানিয়েছে।

আরও পড়ুনঃ  প্রধানমন্ত্রী বই বিতরণ উৎসবের উদ্বোধন করবেন আজ

তবে জার্মানির একটি কোম্পানি প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে প্লাস্টিক স্লিপার তৈরিতে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ময়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মতোই প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে এটি তৈরি করা হবে। পরবর্তীতে তা আবার রুপান্তর করে অন্য কাজও কারা যাবে।

রেলমন্ত্রী জানান, স্পেনের তালগো ফেক্টরি কর্তৃক ডিজেল, ইলেকট্রিক ও ডিজেল-ইলেকট্রিক লোকোমোটিভসহ হাইস্পিড ট্রেন ডিজাইন করে তাকে। তাদের তৈরিকৃত লোকোমোটিভসমূহ স্বল্প ইমিশনের কারণে পরিবেশবান্ধব ও ইন্ডিপেন্ডেন্ট গাইডেড হুইলের কারণে ওজনে হালকা হওয়ায় রেল ট্র্যাকের রক্ষণাবেক্ষণে খরচ হ্রাস করে। এটি ঘণ্টায় ৩০০ কিলোমিটার গতিবেগে চলে। দেশে এটি ব্যবহার উপযোগী কিনা সে বিষয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতা নেয়া হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোঃ হুমায়ুন কবীরসহ বিভিন্ন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

বাংলার প্রথম রেলপথ চালু হয় ১৮৫৪ সালে পশ্চিম বঙ্গের হাওড়া থেকে হুগলি পর্যন্ত ৩৮ কিলোমিটার। ১৮৭৪ সাল থেকে ১৮৭৯ সালের মধ্যে নর্থ বেঙ্গল স্টেট রেলওয়ে নামে ব্রিটিশ সরকার একটি নতুন ২৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ মিটারগেজ রেললাইন স্থাপন করে। লাইনটি পদ্মার বাম তীর ঘেঁষে সারা (হার্ডিঞ্জ ব্রিজ) থেকে ভারতের শিলিগুড়ি পর্যন্ত বিস্তৃত। ১৯১৫ সালের ৪ মার্চে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ রেল চলাচলের জন্য খুলে দেয়ার ফলে উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়ি থেকে চিলাহাটি হয়ে কলকাতা ও ভারতের অন্যান্য স্থানে মালামাল সরবরাহ ও যাত্রী চলাচল গাড়ি বদল ছাড়াই সম্ভব হয়ে ওঠে। ১৯২০ সালে ময়মনসিংহ থেকে জগন্নাথগঞ্জ ঘাট পর্যন্ত ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে দ্বারা পরিচালিত ৮৮ কিলোমিটার বেসরকারি রেললাইন রাষ্ট্রীয়করণ করা হয়। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ভারত বিভক্তির পর বেঙ্গল-আসাম রেলওয়ে পাকিস্তান এবং ভারতের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যায়।

আরও পড়ুনঃ  শ্রীপুরে ৬৩হাজার যাত্রীকে হাত ধুয়ে দিবে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এসআরটি

পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তান উত্তরাধিকার সূত্রে পায় ২,৬০৬.৫৯ কি.মি. রেললাইন এবং তা ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে (ইবিআর) নামে পরিচিত হয়। ইবিআর পায় ৫০০ কিলোমিটার ব্রডগেজ এবং ২,১০০ কিলোমিটার মিটারগেজ। ১৯৪৭ সালের পূর্বে অবিভক্ত ভারতবর্ষে রেলওয়ে বোর্ডের মাধ্যমে তৎকালীন রেলওয়ে পরিচালিত হতো। ১৯৭৩ সালে বোর্ডের কার্যক্রম বিলুপ্ত করে একে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সাথে সংযুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৮২ সালে রেলপথ বিভাগ গঠন করা হয়।

১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ রেলওয়ে অথরিটি (বিআরএ) গঠন করা হয়। ১৯৯৬-২০০৩ সময়কালে এডিবি এর অর্থায়নে বাংলাদেশ রেলওয়ে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়। এরপর যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে সড়ক ও রেলপথ বিভাগ হতে বাংলাদেশ রেলওয়ের কার্যক্রম পরিচালিত হতো। ২০১১ সালের ২৮ যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের আওতায় রেলপথ বিভাগ নামে নতুন বিভাগ সৃষ্টি করে। পরবর্তীতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সেই বছরের ৪ ডিসেম্বর রেলপথ মন্ত্রণালয় গঠন করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ের ২৮৭৭ কিঃমিঃ রেল লাইন নেটওয়ার্ক দেশের ৪৪টি জেলায় সংযুক্ত।

রেলওয়েকে জনবান্ধব বিবেচনায় সরকার এ খাতের সার্বিক উন্নয়ন বাস্তবায়নে বহুমুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে স্বল্প খরচে ও নিরাপদে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে রেলওয়েকে গড়ে তুলতে (২০১৬ থেকে ২০৪৫ সাল পর্যন্ত) ৩০ বছর মেয়াদে ৫ লাখ ৫৩ হাজার ৬৬২ কোটি টাকার মহাপরিকল্পনা নেয়া হয়। এ মহাপরিকল্পনার আওতায় রেলওয়ে সম্প্রসারণ, নতুন রেলপথ নির্মাণ ও সংস্কার, রেলপথকে ডুয়েল গেজে রূপান্তর, নতুন ও বন্ধ রেলস্টেশন চালু, নতুন রেল চালু ও সার্ভিস বৃদ্ধিসহ ট্রেনের কোচ ও লোকোমোটিভ সংগ্রহ করা হবে। তা ছাড়া পদ্মা সেতুতে রেললাইন সংযুক্ত করা।

আনন্দবাজার/শহক

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন