শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মরুকরণে বরেন্দ্রভূমি

মরুকরণে বরেন্দ্রভূমি

মাত্র একটি টমেটো উৎপাদনের পুরো প্রক্রিয়ার জন্য প্রয়োজন পড়ে ১৩ লিটার পানির। তেমনি ৫০ লিটার পানির বিনিময়ে পাওয়া যায় একটিমাত্র কমলালেবু। এভাবে যেকেনো ধরনের এক এক কিলোগ্রাম (কেজি) ফল উৎপাদনের জন্য ৯৬২ লিটার পানির দরকার পড়ে। তাহলে এক কেজি ধান উৎপাদনে কী পরিমাণ লাগতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তর বের করেছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগ। তাদের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে দরকার হয় দেড় থেকে দুই হাজার লিটার পানির। আরো কিছু জরিপে আরো বেশি পানির প্রয়োজনের বিষয় উঠে এসেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের একটি হিসাব বলছে, গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশে ৫ কোটি ২৬ লাখ টন ধান উৎপন্ন হয়েছে। যা বিশ্বে চতুর্থ সর্বোচ্চ। এই পরিমান ধান উৎপাদনে কী পরিমাণ পানি লেগেছে তা হিসাব কষলেই বের হয়ে আসবে। হিসাবটা এখানে শেষ না করে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্যের দিকে দৃষ্টি দিতে পারি। এফএও-এর হিসাব বলছে, এক কেজি চিনি উৎপাদনে দরকার হয় ১৯৭ লিটার পানির। সবজি উৎপাদনে ৩২২ লিটারে আর ডাল উৎপাদনে ৪০৫৫ লিটার পানির প্রয়োজন পড়ে।

এবার অন্য খাদ্যদ্রব্যের হিসাবে এফএও বলছে, প্রতি কেজি বাদাম উৎপাদনে ৯০৬৩ লিটার, দুধ উৎপাদনে ১০২০ লিটার, ডিম উৎপাদনে ৩২৬৫ লিটার পানির দরকার হয়। আবার এক কেজি ঘি বানাতে প্রয়োজন হয় ৫৫৫৩ লিটার! ভাবা যায়? দেশে ফল বা সবজি কিংবা খাদ্যদ্রব্য উৎপাদনে কি বিপুল পরিমাণ পানির প্রয়োজন পড়ে? এফএও বলছে, পৃথিবীতে যে পরিমাণ পানি আছে তার মধ্যে মাত্র এক ভাগ রয়েছে মিঠা পানি। আর এই একভাগ পানির মধ্যে ৭০ শতাংশ খরচ হয় শুধু কৃষিকাজে।

আরও পড়ুনঃ  ৩৯৮ বাংলাদেশি কাতার থেকে দেশে ফিরেছেন

আগে কৃষি উৎপাদনে বিপুল পরিমাণ পানির সিংহভাগের যোগান আসতো নদ-নদী, খাল-বিল, পুকুর-জলাশয় থেকে। তবে গেল কয়েক দশকে পানির উপরিতলের উৎস আশঙ্কাজনকহারে কমে এসেছে। সে কারণে এখন সুপেয় পানির শতভাগ আর কৃষি উৎপাদনের সিংগভাগ সংগ্রহ করতে হয় পানির ভূ-গর্ভস্থ উৎস থেকে।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, দেশে মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ প্রায় ৮৬ লাখ হেক্টর। এর মধ্যে সেচের মাধ্যমে ফসল ফলে এমন জমির পরিমাণ ৭৬ লাখ হেক্টরের বেশি। দেশে আউশ, আমন ও বোরো এই তিন মৌসুমেই কমবেশি সেচের প্রয়োজন পড়ে। তবে শুধু আমন মৌসুমেই বিভিন্ন পর্যায়ে ২০ লাখ হেক্টর জমিতে সেচের প্রয়োজন হয়। যদিও বোরো মৌসুমে সবচেয়ে বেশি সেচের দরকার হয়। যার প্রায় সবটুকুই ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে সেচ দেয়া হয়। শুকনো মৌসুমে আবার পানির চাহিদা ব্যাপকহারে বেড়ে যায়। যা মেটাতে ভূ-গর্ভস্থ পানি বেশি পরিমাণে উত্তোলন করা হয়। এতে ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর যেমন ব্যাপক চাপ পড়ছে তেমনি পরিবেশগত ভারসাম্য বিঘ্নিত হচ্ছে।

সম্প্রতি ভূগর্ভস্থ পানির জরিপ করে বরেন্দ্র অঞ্চলের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা (ওয়ারপো)। জনমতের ভিত্তিতে রাজশাহীর তানোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল, নওগাঁর সাপাহার ও পোরশা উপজেলার ১২৫টি ইউনিয়নের ৫০টি জায়গায় এই জরিপ চালানো হয়। পরে তানোর উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে অংশগ্রহণমূলক গ্রামীণ মূল্যায়ন খসড়া প্রতিবেদন উপস্থাপন করে ওয়ারপো।

সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, তানোরের সব ইউনিয়নেই পানির স্তর অনেক নিচে। তার মধ্যে বাধাইড় ইউনিয়নের উচ্চাডাঙ্গা গ্রামের পানির অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। এখানে মাটির নিচে মোটা বালু, চিকন বালু ও মিহি বালুর স্তরে পানি থাকে। মোটা বালুর স্তরের পানি আহরণ করা যায় এবং তা পানযোগ্য। উচ্চাডাঙ্গা গ্রামের ১২০ থেকে ১২৬ ফিট পর্যন্ত বোরিং করে পানি পাওয়া গেছে। তবে সেখানে পানির সঙ্গে চিকন ও মিহি বালু রয়েছে। তারপর এক হাজার ৪৬০ ফুট পর্যন্ত পানির কোনো অ্যাকুইফার (জলাধার) পাওয়া যায়নি।

আরও পড়ুনঃ  মারা গেলেন ব্যারিস্টার রফিক-উল হক

জরিপের ফলাফল প্রতিফলিত হয়েছে মাঠ পর্যায়ে। দেখা যাচ্ছে, মাঠের পর মাঠে ফাঁকা জমি পড়ে রয়েছে। অল্প কিছু জমিতে চৈতালির আবাদ করা হয়েছে। পাশের মুণ্ডমালা বাজারের ব্যবসায়ী আসাদুজ্জামান মিঠু বলেন, বর্ষায় ভালো বৃষ্টি হলে ধান হয়। তারপর জমি পড়ে থাকে। গ্রামে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) তিনটি গভীর নলকূপ রয়েছে। তবে আগের মতো আর তাতে পানি উঠে না। আগে একটি নলকূপের অধীনে ২০০ বিঘা জমিতে পানি দেয়া যেত। এখন ৫০ বিঘা জমিতেও পানি দেয়া যায় না।

ভূগর্ভস্থ পানি নিচে নেমে যাওয়ার বিষয়ে বেশ ভাবনায় পড়েছে ১৯৮৫-৮৬ সাল থেকে গভীর নলকূপের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানি তুলে সেচকাজ চালানো বিএমডিএ। তাদের সেচ কাজের কারণে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। প্রতিবছর যে হারে পনি নিচে নেমে যাচ্ছে, তা আর পুনর্ভরণ হচ্ছে না। রাজশাহী বিভাগে এখনো তাদের ৮ হাজার ৮২৬টি নলকূপ চালু রয়েছে। তবে কিছুদিন ধরে তারা অল্টারনেট ওয়েট অ্যান্ড ড্রয়িং (এডাব্লিউডি) পদ্ধতিতে বোরো ধান চাষের কথা বলে আসছে। বাংলায় এ পদ্ধতিকে বলা হয় পর্যায়ক্রমে ভেজানো ও শুকানো। সম্প্রতি সময়ে এ বিষয়ে তারা সেমিনারও করেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত প্রায় এক যুগে বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্বিগুণেরও নেমে গেছে। আগামীতে যে এ অঞ্চলে পানির চরম সংকট দেখা দেবে সে কথা অনেক আগে থেকেই বলে আসছেন পরিবেশবিদরা। আজ তা বাস্তবে দেখা যাচ্ছে।

সূত্রমতে, এর আগে ২০১৫ সালে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমাগতভাবে নিচে নেমে যাওয়ার কারণে বরেন্দ্র অঞ্চলের তিনটি পৌরসভা ও ১৫ ইউনিয়নকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল বে-সরকারি সংস্থা ডাসকো ফাউন্ডেশন। সমন্বিত পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রকল্প নামে এক জরিপ চালিয়ে ওইসব এলাকাকে চিহ্নিত করেছিল। যেসব এলাকা থেকে অতি জরুরিভাবে ভূগর্ভ থেকে পানি উত্তোলন বন্ধ করে বিকল্প উপায়ের মাধ্যমে পানির ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছিল সংস্থাটি। এর আগে ২০১৪ সালে পুরো বরেন্দ্র অঞ্চলে মাঠপর্যায়ে জরিপ চালিয়ে সরকারকে এমন প্রতিবেদন দিয়েছিল তারা। ডাসকো ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, এক যুগ আগেও ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষিত অঞ্চলে ৬০ থেকে ৯০ ফুটের মধ্যে সচরাচর পানি মিলতো। অথচ এখন ১৬০ ফুট বা তারও নিচে গিয়েও আর পানি মিলছে না।

আরও পড়ুনঃ  শিশু ধর্ষণ মামলায় দুই আসামি ৩ দিনের রিমান্ডে

ওয়ারপোর প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী মো. রেজাউল করিম বলছেন, ভূগর্ভস্থ পানির সুষ্ঠু ও সুষম বণ্টন নিশ্চিত করার জন্য পানিসম্পদের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে আগামীতে পরিস্থিতি আরো বেশি ভয়াবহ হয়ে উঠবে। অন্যদিকে, বিএমডিএ-এর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবদুর রশীদ আনন্দবাজারকে বলেন, বরেন্দ্র অঞ্চলে আর নতুন করে কোনো নলকূপ বসানো হচ্ছে না। যে কয়টি চলমান, পানি না পেলে সেগুলোও বন্ধ করে দেয়া হবে।

আনন্দবাজার/শহক

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন