বিশ্বের প্রায় সব দেশেই নানা ধরনের উৎসব-আনন্দ ঘিরে আতশবাজি পোড়ানো হয়। প্রবল শব্দের সঙ্গে রাতের অন্ধকার ভেদ করে আলোর রোশনাই ছড়িয়ে পড়ে আকাশে। অপূর্ব সেই দৃশ্যে বিমোহিত হয় মানুষ। অন্যরকম এক উল্লাসে ফেটে পড়ে সব বয়সীয়রাই। বিশেষ করে ইংরেজি বর্ষবরণে আতশবাজি পোড়ানোর মহোৎসবে মেতে ওঠে গোটা বিশ্বের মানুষ। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বহুদিন ধরেই দেশে আতশবাজি পোড়ানোর উৎসব দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে ইংরেজি বছরের শেষ দিন ৩১ ডিসেম্বর রাতে রাজধানীসহ সারাদেশেই চলে আতশবাজি, পটকা আর ফানুস উড়ানোর উৎসব।
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, বহুকাল আগে থেকেই নানা উদ্দেশ্যে আতশবাজি ব্যবহার করে আসছে বিভিন্ন দেশের মানুষ। অনেকের মতে, আতশবাজির প্রথম প্রচলন হয় চীনে। আজ থেকে প্রায় দু’হাজার বছর আগে হ্যান রাজবংশের রাজত্বকালে প্রথম আতশবাজির প্রচলন হয়। তখন মনে করা হতো পৃথিবীতে অনাবৃষ্টি, মহামারী, ভূমিকম্পসহ নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে অপদেবতাদের অপকর্মের ফলে। সেজন্য অপদেবতাদের ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে হ্যান রাজারা আকাশে আতশবাজি ছুঁড়তেন। ফোটাতেন নানারকম বাজি-পটকা। সেই থেকেই চীনা সংস্কৃতির অংশ হয়ে যায় আতশবাজি।
অন্যদিকে, ১৫৭২ সালের দিকে রানি এলিজাবেথের আমলে ইংল্যান্ডের ওভারভিচ শহরে আতশবাজি পোড়ানোর বিশাল উৎসবের তথ্য পাওয়া যায়। আবার অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাজা পঞ্চদশ লুইয়ের উৎসাহে এবং পৃষ্ঠপোষকতায় ফরাসি দেশেও আতশবাজি-পটকা নিয়ে নানারকম উৎসব আয়োজনের সূচনা হয়।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, ৬৩৫ সালের দিকে হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালে বৌদ্ধ সন্যাসীরা আতশবাজি তৈরির কলা কৌশল চীন থেকে বঙ্গদেশে আমদানি করেছিলেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৭৮৩ সালে ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধ করার সময় টিপু সুলতান খবর পাঠানোর উদ্দেশ্যে সংকেত হিসেবে আতশবাজি ব্যবহার করেছিলেন। এরপর থেকে বঙ্গদেশে তথা ভারতীয় উপমহাদেশে আতশবাজির প্রচলন হয়।
বর্তমানে সারাবিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও বাংলা নববর্ষ আর ইংরেজি বর্ষবরণ তথা থার্টি ফার্স্ট নাইটে আতশবাজি আর ফানুস উড়ানোর উৎসব দেখা যায়। করোনাকালীন প্রকাশ্যে বাজি ফাটানো সরকারিভাবে নিষিদ্ধ করা হলেও বাসাবাড়ির ছাদে ব্যক্তিগত আয়োজনে এসব উৎসব চলছে। তবে সম্প্রতি কিছু দুর্ঘটনা আর বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তার কারণে আতশবাজি পোড়ানো নিয়ে নানামুখী আলোচনা চলছে।
রসায়নবিদদের মতে, একটি আতশবাজিতে ৭৫ শতাংশ পটাশিয়াম নাইট্রেট, ১৫ শতাংশ চারকোল এবং ১০ শতাংশ পর্যন্ত সালফার থাকতে পারে। এগুলোর প্রত্যেকটিই পরিবেশের জন্য বেশ ক্ষতিকর। তাছাড়া বিকট শব্দ, তীব্র আলোর ঝলকানি এবং এর সঙ্গে যে পরিমাণ ক্ষতিকর রাসায়নিক কণা বাতাসে ছড়ায় তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এগুলোর প্রত্যেকটিই পরিবেশের জন্য বেশ ক্ষতিকর।
বিজ্ঞানীরা আরো জানাচ্ছেন, বাজি-পটকার মধ্যে থাকে সহজদাহ্য মিশ্রণ। যা বাতাসের সাহায্য ছাড়াই জ্বলতে পারে। এজন্য প্রধানত ব্যবহার করা হয় পটাশিয়াম ক্লোরেট বা নাইট্রেট অথবা সোডিয়াম নাইট্রেট। এছাড়া দাহ্যপদার্থ হিসেবে থাকে কাঠ-কয়লার গুঁড়ো, সালফার বা গন্ধক ইত্যাদি। আগুন লাগলে, পটাশিয়াম ক্লোরেট থেকে প্রচুর অক্সিজেন বেরিয়ে আসে। আর তারই সাহায্যে অন্য পদার্থগুলো জ্বলতে থাকে।
ফোর্বসের এক প্রতিবেদনেও আতশবাজির ভয়াবহতা উঠে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, আতশবাজির কণাগুলো ধাতুর লবণের সঙ্গে বিক্রিয়া করে শুধু যে ধোঁয়ার সৃষ্টি করে তা নয়, এর ফলে গ্রিনহাউস গ্যাস হিসেবে চিহ্নিত কার্বন মনোঅক্সাইড, কার্বন ডাই অক্সাইড এবং নাইট্রোজেনযুক্ত গ্যাস তৈরি হয়। যা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণগুলোর অন্যতম। এই গ্যাস এবং ধাতুযুক্ত কণাগুলো শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে খুব দ্রুত ফুসফুস এবং রক্তে মিশে যেতে পারে। ফলস্বরূপ তাৎক্ষণিক বা দীর্ঘমেয়াদী শারীরিক প্রতিক্রিয়া ঘটতে পারে।
অন্যদিকে, আতশবাজির সময় যে ভয়াবহ শব্দ তৈরি হয়, তা শুধু যে নারী, শিশু আর বয়স্কদেরই শ্রুবণ ইন্দ্রিয় বা হৃদযন্ত্রের ক্ষতি করে তাই নয়, বরং প্রাণিজগতে ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনে। বিশেষ করে গভীর রাতে যখন প্রাণিরা ঘুমিয়ে থাকে তখন অকস্মাৎ বিকট শব্দ তাদের মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠে। অন্যদিকে, শব্দবাজির মতো আলোর বাজিও দূষণ ছড়ায়। যে কোনো বাজিই স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। বাজির বিষাক্ত ধোঁয়ায় করোনা আক্রান্তদের অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যায়।
আতশবাজিতে কয়েকশ পাখির মৃত্যু: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ২০২১ সালের ২ জানুয়ারি প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ইংরেজি নববর্ষ পালনের সময় পটকাবাজিতে ইতালির রোমের প্রধান রেলস্টেশনে কয়েকশ স্টারলিংস পাখি মরে পড়ে থাকতে দেখা যায়। আহত হয় বহু পাখি। ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব প্রোটেকশন অব অ্যানিমেলস (ওআইপিএ) একে ‘হত্যাকাণ্ড’ আখ্যা দেয়। তারা পাখিদের মৃত্যুর জন্য উচ্চশব্দে পটকাবাজি ফোটানো ও আতশবাজি দায়ি করে।
ফানুসের আগুনে চিড়িয়াখানায় ৩০ প্রাণির মৃত্যু: ২০২০ সালে নববর্ষ উদযাপনের জন্য উড়ানো ফানুস থেকে জার্মানির পশ্চিমাঞ্চলে ক্রেফেল্ড শহরে এক চিড়িয়াখানায় আগুন লেগে যায়। এতে গরিলা, ওরাংওটাং, শিম্পাঞ্জিসহ অন্তত ৩০টি বন্যপ্রাণী পুড়ে যায়। পুলিশ জানায়, বর্ষবরণের কিছু আগে ফানুস থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ ফেসবুকে জানায়, সবচেয়ে ভীতিকর আশঙ্কাই সত্য হয়েছে। বানরদের খাঁচায় কোনো প্রাণী বেঁচে নেই। নিরাপত্তার আশঙ্কায় আগে থেকেই কংমিং নামে পরিচিত চাইনিজ ফানুস শহরটিতে নিষিদ্ধ। তবে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই এসব ফানুস উড়ানো হয়।
বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে নিষিদ্ধ করার পরও থামছে না আতসবাজি ফোটানো। এতে অগ্নিকাণ্ডের মতো ঘটনাও ঘটছে। বিকট শব্দ আর আলোর ঝলকানির প্রভাব পড়ছে প্রাণিজগতেও। মিরপুর-১২ এর বাসিন্দা শাকিরুল হক জানান, ২০২০ সালের থার্টি ফার্স্ট নাইটে তার বাসার পাশের বাড়িতে একটি ফানুস আকাশ থেকে পড়ে। এতে আগুন ধরে যায় টিনের চালে। মধ্যরাতে মানুষজন এসে কোনোভাবেই পানি দিয়ে আগুন নেভাতে সহায়তা করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় বিভিন্ন ধরনের ফানুস ওড়ানো হয়। এতে যেকোনো সময় আগুন লাগতে পারে। ঘনবসতিপূর্ণ জায়গা হলে তো কথাই নেই।
থার্টি ফার্স্টে শত কোটি টাকার আতশবাজি: গেল বছরে (২০২০) সালে উন্মুক্ত স্থানে ও বাসাবাড়ির ছাদে ‘থার্টি ফার্স্টে’ আতশবাজি ফোটানো-পোড়ানো ও ফানুস ওড়ানো নিষিদ্ধ করেছিল ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। তবে সে নিষেধাজ্ঞায় কোনো কাজ হয়নি। ৩১ ডিসেম্বর মধ্যরাতে ঘড়ির কাটা ১২টা স্পর্শ করতে না করতেই রাজধানী যেন পরিণত হয় আতশবাজির শহরে। একঘণ্টারও বেশি সময় ধরে টানা ফাটতে ও পুড়তে থাকে আতশবাজি। হাজার হাজার ফানুসে ছেয়ে যায় ঢাকার আকাশ। সে বছর রাজধানীর বিভিন্ন স্থানেও আতশবাজি আর ফানুসের কারণে আগুন ধরে গিয়েছিল। আতশবাজি ও ফানুসের আগুনে পুড়ে দগ্ধ হয়েছেন রাজধানী বিভিন্ন এলাকার বেশ কয়েকজন।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা বিশেষ করে পুরান ঢাকায় মনস্টার, ফায়ার ওয়ার্কস, ড্রিম নাইট, আতশবাজি ও ফানুস নামে ফেসবুক পেজ ওপেন করে এসব পণ্য বিক্রি করা হয়। একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মালিকের দেয়া তথ্যমতে, ২০২০ সালে শুধুমাত্র ৩১ ডিসেম্বর একদিনেই অনলাইনের মাধ্যমে আতশবাজি ও ফানুস বিক্রি করেছেন ৪০ লাখ টাকার উপরে। এক সপ্তাহে বিক্রি করেছেন অন্তত ৩ কোটি টাকা। প্রতি বছর ১৪ জানুয়ারি সাকরাইন উৎসবে থার্টি ফাস্টের চেয়ে অন্তত ১০ গুণ বেশি আতশবাজি ও ফানুস বিক্রি হয়।
বিক্রেতাদের দেয়া তথ্যমতে, কমান্ডো ব্র্যান্ডের একটি আতশবাজি বিক্রি হয় ৫৫০ টাকায়। তবে ৩১ ডিসেম্বর দাম বেড়ে হয় ৯০০ টাকা পর্যন্ত। অন্যান্য ব্র্যান্ডের আতশবাজিও বিক্রি হয় কয়েকগুণ দামে। বিক্রেতাদের হিসেবে শুধু পুরান ঢাকাতেই ৩০ হাজার বাড়ি আছে। প্রতিটি বাড়িতে গড়ে ১০ হাজার টাকা করে বাজেট রাখলেও প্রায় ত্রিশ কোটি টাকার আতশবাজিতে ব্যয় হয়। সারাদেশে আতশবাজির হিসাব ধরলে শত কোটি টাকার বাজার ধরা যায়।
বিস্ফোরক পরিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, জাতীয় অনুষ্ঠানগুলোর জন্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আতশবাজি আমদানি করতে পারবে। এর বাইরে আতশবাজি আমদানি, ব্যবহার ও মজুদ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষিত। তবে এর মধ্যেও যারা আতশবাজি বিক্রি করছেন তারা চোরাইপথে অথবা অবৈধভাবে আনছেন।
পাবলিক প্লেসে থার্টি ফাস্ট নয়: চলতি বছরেও ডিএমপি থেকে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে যে বাইরে বা পাবলিক প্লেসে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান না করে ঘরের মধ্যে সীমিত আকারে করা যাবে।
পরিবেশবিদরা বলছেন, ধীর পদক্ষেপে মানবসভ্যতার দিকে এগিয়ে আসছে জলবায়ু পরিবর্তনের মহাবিপর্যয়। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে বিষাক্ত কার্বন-ডাই অক্সাইডসহ গ্রিনহাউজ গ্যাস বেড়ে চলেছে। দিন দিন উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হয়ে উঠছে পৃথিবী। গলছে দুই মেরুর বরফ। বাড়ছে সমুদ্র তলের উচ্চতা। তলিয়ে যাচ্ছে বহু নিম্নভূমি। এমন পরিস্থিতিতে শুধু আনন্দের জন্য, উল্লাসের জন্য পরিবেশবিরোধী কোনো কিছুই করা যাবে না। সেজন্য পরিবেশবান্ধব আতশবাজি ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ এইচ এম সাদাত দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, পটকা, আতসবাজি, ফানুসসহ এসব কার্যক্রম আবাসিক এলাকার জন্য অবশ্যই ক্ষতিকর। রাষ্ট্রীয় কোন অনুষ্ঠান হলে ভিন্ন কথা। স্বাভাবিক অনুষ্ঠানগুলোতে পটকাবাজি থেকে বিরত থাকাই ভালো। তিনি বলেন, ফানুস থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। পটকা, আতসবাজিতে শব্দদূষণ হচ্ছে। তাতে পরিবেশের ক্ষতির সাথে মানসিক বড় ক্ষতির আশঙ্কাও রয়েছে।
আনন্দবাজার/শহক