বৃহস্পতিবার, ১৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৪ঠা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ঐতিহ্যের আলো ছড়ালো রংপুরে নবান্ন উৎসব

ঐতিহ্যের আলো ছড়ালো রংপুরে নবান্ন উৎসব

ষড়ঋতুর লীলাবৈচিত্রে বিচিত্র কৃষিনিভর বাংলাদেশে অগ্রহায়ণ মাস আসে নতুন ফসলের সওগাত নিয়ে। কৃষককে উপহার দেয় সোনালি দিন। তাদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফলানো সোনালী ধানের সম্ভার সগৌরবে বুকে ধারণ করে হেসে ওঠে বাংলাদেশ। কবিগুরুর ভাষায়-‘ও মা, অঘ্রাণে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি।’ হাসি ফোটে কৃষকের মুখেও; মাঠ ভরা সোনালি ফসল নতুন স্বপ্ন জাগায় চোখে। কবি সুকান্ত’র দৃষ্টিতে ‘নতুন ফসলের সুবর্ণ যুগ আসে।’ দিন-রাতের অবিশ্রান্ত শ্রমে-ঘামে কৃষকের ঘরে ওঠে সোনার ধান। বাংলার গ্রাম-গঞ্জ মেতে ওঠে নবান্নের উৎসবে।

প্রকৃতিতে এখন যাই যাই করছে হেমন্তকাল। তার পরও মাসজুড়ে চিরায়ত এ ঐতিহ্যকে ধারণ করে চলছেন গ্রাম বাংলার কৃষকরা। বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে শুক্রবার রংপুরে বর্ণাঢ্য আয়োজনে নবান্ন উৎসব উদযাপন করা হয়েছে। রংপুর জেলা প্রসাশনের আয়োজনে সদর উপজেলার চন্দনপাট ইউনিয়নের কালাপাড়া এলাকায় মাঠে গিয়ে পাঁকা ধানকাঁটা, নানান রকম পিঠা-পুলির আয়োজন, নবান্নের নাচ-গান দিয়ে উৎসব উদযাপন করা হয়।

নবান্ন উৎসবের শুরুতে মাথায় গামছা বেঁধে হাতে কাঁচি নিয়ে কৃষকদের সাথে মাঠে ধান কাটেন জেলা প্রশাসক আসিব আহসানসহ অনুষ্ঠানের অতিথিবৃন্দ। এরপর শুরু হয় গ্রামীণ ঐতিহ্য লাঠি খেলা এবং ঘোড়-দৌঁড় প্রতিযোগীতা। এর ফাঁকে ফাঁকে চলে পিঠা-পুলি খাওয়া। সেই সঙ্গে ছিল গরুর গাড়িতে ঘুরে বেড়ানো, ঢেঁকিতে ধান ভাঙা। পরে বিকেলে অনুষ্ঠিত হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ। এসময় জেলা প্রশাসক পত্নী নাজিরা বানু, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) শাহানাজ পারভিনসহ জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারি এবং তাদের পরিবারবর্গ উপস্থিত ছিলেন।

আরও পড়ুনঃ  আত্মসমর্পণের সুযোগ ফিরেছে নিম্ন আদালতে

এদিকে সরেজমিনে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, রোপা আমন ধানের কাটা-মাড়াই প্রায় শেষ। কৃষক-কৃষাণী বসে নেই কেউ। অগ্রহায়ণ মাসজুড়ে পিঠা-পায়েসসহ নবান্নের আয়োজনে কেউ বা ধান কাটছেন, কেউ বা করছেন মাড়াই। গৃহবধূরা ঢেঁকি কিংবা উরুন-গাইনে ধান থেকে চাল তৈরি করছেন। দিনরাত চলছে রোপা আমন ধান কাটা-মাড়াইয়ের কাজ। পা চালিত ধান মাড়াই যন্ত্রের ঘরঘর শব্দে গ্রামের পরিবেশটাই যেন পাল্টে গেছে।

রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার লটারী ইউনিয়নের বিজয় বাঁধ এলাকায় সৈয়দ আলীর স্ত্রী লিপি বেগম ‘উরুন-গাইনে’ নতুন ধানের চাল থেকে আটা তৈরি করছিলেন। তিনি বলেন, ‘নবান্নের দিনে পিঠা-পায়েস না খাইলে কি হয়!’ তবে মনে শান্তি নাই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ঘরোত খালি ধান আছে-বাজারোত তার দাম নাই। পেঁয়াজ কেনার বুদ্দি নাই, তরকারিরও দাম বেশি।’ এসব কারণে গ্রামাঞ্চলে নবান্নের আনন্দ ম্লান হয়ে গেছে বলেও জানান তিনি। কাউনিয়া উপজেলার শহীদবাগ ইউনিয়নের মীরবাগ গ্রামের শরিফুল আলম বলেন, নতুন ধানে নবান্ন উৎসবের আয়োজনে খুব মজা হয়। তবে এবারে জিনিসপত্রের দাম বেশি এবং ধানের দাম কম হওয়ায় গ্রামে নবান্নকে ঘিরে তেমন আয়োজন নেই।

পীরগাছা উপজেলার কল্যাণী ইউনিয়নের তালুক উপাসু গ্রামের ভাই ভাই চাল কলে গিয়ে দেখা যায়, ধান ভাঙতে উপচে পড়া ভিড়। চালকলের মালিক শাহ আলম জানান, নবান্নকে ঘিরে কৃষকরা ধান ভাঙতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। কৃষকরা জানান, নবান্নের দিনে প্রতিবছর নতুন ধানের পিঠা-পায়েসসহ ভাল খাবারের আয়োজন করা হয়। এছাড়া বিশেষ প্রার্থনা করা হয় যাতে আগামীতেও মহাধুমধামের সাথে নবান্ন উৎসব পালন করা যায়। কিন্তু এবারে পেঁয়াজসহ দ্রব্যমুল্যের দামের কারণে বাপ-দাদার আমল থেকে পালন করে আসা নবান্ন উৎসবে যেন ভাটা পড়েছে। তবে উৎসব না হলেও বেঁচে থাকার তাগিদে নতুন ধানের ভাত খাবেন তারা।

আরও পড়ুনঃ  বইমেলায় মুনির আহমেদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রান্তে প্রান্তে স্বপ্ন’

অন্যদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রংপুর আঞ্চলিক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, কৃষি অঞ্চলের পাঁচ জেলা নীলফামারী, রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও গাইবন্ধায় চলতি মৌসুমে ৬ লাখ ১৪ হাজার ২৯৫ হেক্টর জমিতে আমন চাষ হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৭ লাখ ১৯ হাজার ২৩১ মেট্রিকটন চাল। যার গড় বাজার মূল্য প্রায় ৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এ বছর নানা প্রতিকূলতার পরও আশানুরুপ ফলন হয়েছে বলেও সূত্র জানায়।

আনন্দবাজার/এম.আর

সংবাদটি শেয়ার করুন