এক সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি)। শিক্ষার গুণগত মান ধরে রাখার জন্য জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালীন থেকে চেষ্টা করেছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়টি গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় যাওয়ার পরই এর স্বকীয়তা হারায়। ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত এই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে যে আগ্রহ ছিল তা ধীরে ধীরে ভাটা পরে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষ থেকে। এর নেপথ্যে কারণ খুঁজতে যেয়ে পাওয়া যায় গুচ্ছে অন্তর্ভুক্তি।
গুচ্ছে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর কমানো হয় জবির আবেদন শর্ত, এমনকি আসন ফাঁকা থাকতে পারে এই আশঙ্কায় চালু করা হয় সেকেন্ড টাইম আবেদন। জানা যায়, বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমাতে করোনা মহামারিতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) পরামর্শ ও নির্দেশনায় ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষ থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান ও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবির) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড.ফরিদ উদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে ২২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে দেশে প্রথমবারের মতো সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা (জিএসটি) অনুষ্ঠিত হয়। সেই পদ্ধতিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল না ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
সরকার বা উচ্চ মহল যদি শিক্ষার্থীদের কল্যাণে এই গুচ্ছ চালু করে থাকতো তাহলে এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে কেন অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি সেই প্রশ্নের ধোঁয়াশা রয়ে গেছে আজও। এরপর করোনা মহামারি চলে গেলেও এ পরীক্ষা পদ্ধতি এখনো বহাল রয়েছে। তবে চলতি শিক্ষাবর্ষ থেকে আগের ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতিতে ফিরেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বাদ দেয়া হয়েছে সেকেন্ড টাইম। পরীক্ষা হবে লিখিত ও বহুনির্বাচনি প্রশ্নে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গুচ্ছ সময়ের ভর্তি বিজ্ঞপ্তিগুলো দেখলে বুঝা যাচ্ছে একদম নিজেদের অবস্থান ও বৈশিষ্ট্যকে জলাঞ্জলি দিয়ে গুচ্ছে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়টি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক শওকত জাহাঙ্গীর জানান, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছে অন্তর্ভুক্ত হওয়া ছিল বিরাট একটা ক্ষতি। আগে যেমন সবার কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামটি খুব পরিচিত ছিল গুচ্ছে অন্তর্ভুক্ত হবার ফলে সে চাহিদায় ভাটা পড়ে।
তিনি জানান, তখনকার রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমেই গুচ্ছ চালু হয়। আর যে উদ্দেশ্যে গুচ্ছ চালু হয় তা বাস্তবায়ন হয়নি। তিনি আরও বলেন, জবিকে গুচ্ছে নিতে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন তখনকার ভিসি ড. মীজানুর রহমান। এ নিয়ে শিক্ষকরা বহুবার প্রতিবাদ করলেও কিছু সুবিধাভোগী শিক্ষকদের জন্য সেই প্রতিবাদ আলোর মুখ দেখেনি বলে জানান এই অধ্যাপক।
এ বছর গুচ্ছ থেকে বের হয়ে গেছে জবি, আশা করা যায় আবার সেই আগের মহিমায় ফিরবে বিশ্ববিদ্যালয়টি। এছাড়াও জানা যায়, গুচ্ছের প্রথম বছর সেকেন্ড টাইম না থাকলেও শিক্ষার্থী সংকট হতে পারে আঁচ করতে পেরে ২০২১-২২, ২০২২-২৩, ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি নেয়া হয় সেকেন্ডে টাইম পরীক্ষার্থী। এত কিছুর পরেও ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে ১৯২ আসন ফাঁকা রেখেই চালু হয় ক্লাস। এমনকি ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত চলে ভর্তি কার্যক্রম। ২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে নতুন যারা ভর্তি হচ্ছে তাদের সহপাঠীরা ইতোমধ্যে মিডও দিয়ে ফেলছে। এখন প্রশ্ন থেকেই যায় নতুন ভর্তিকৃতরা কীভাবে তাদের সাথে মানিয়ে নিবে। তাছাড়া গুচ্ছের মাইগ্রেশন পদ্ধতিটির সুষ্ঠু পরিচালনার অভাবে এটি দীর্ঘ সময় ধরে চলে ভর্তি প্রক্রিয়া। শুধু ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষেই নজর দিলে দেখা যায় গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা শেষ হবার ৯ মাস পর্যন্ত চলেছে ভর্তি কার্যক্রম। ফলস্বরূপ সৃষ্টি হয় শিক্ষাবর্ষে অন্যদের থেকে পিছিয়ে পরা সহ সেশনজোটের মত নানা সমস্যার।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে গুচ্ছ থেকে বের হতে চাইলেও অদৃশ্য শক্তিতে গুচ্ছে রয়েই যায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি সূত্রে জানা যায়, গুচ্ছের বেড়াজালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে গত চার বছরে ৩৬০টি আসন ফাঁকা ছিল। এতকিছুর পরেও ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে একদম শেষ মূহুর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য্যের নির্দেশে গুচ্ছে থাকতে বাধ্য হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে বিজ্ঞান বিভাগের জন্য জিপিএ অপরিবর্তিত ৮ পয়েন্ট রাখলেও মানবিকের জন্য কমানো হয় ২ দশমিক ৫ পয়েন্ট। ওই বছর মানবিকের শিক্ষার্থী টানতে জিপিএ শর্ত দেওয়া হয় এএসএসসি ও এইচএসসি মিলিয়ে মাত্র ৬ পয়েন্ট। অপরদিকে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের জন্য আগের শিক্ষাবর্ষ থেকে কমানো হয় ১ পয়েন্ট। নতুন জিপিএ শর্ত দেয়া হয় ৬ দশমিক ৫ পয়েন্ট। এছাড়া নাট্যকলা ও চারুকলা অনুষদের জন্য শর্ত থাকে ৬ পয়েন্ট। ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষেও একই শর্তে শিক্ষার্থীদের ভর্তি আবেদন আহ্বান করে বিশ্ববিদ্যালয়টি। ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে বিজ্ঞান ও মানবিকের জন্য পয়েন্ট শর্ত একই থাকলেও শুন্য দশমিক ৫ পয়েন্ট বাড়ে ব্যবসায় অনুষদের আবেদন শর্ত। একই থাকে নাট্য ও চারুকলা অনুষদের আবেদন শর্ত।
এদিকে গুচ্ছ থেকে বেরিয়ে একক পরীক্ষার সিদ্ধান্ত জানাতেই সেই আগের রুপে আবেদন শর্ত দিয়ে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি দেয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। তুলে দেয়া হয়েছে সেকেন্ড টাইম। ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে ভর্তির আবেদন যোগ্যতা ধরা হয়েছে বিজ্ঞান বিভাগে ৮ পয়েন্ট। কলা অনুষদে ৭ পয়েন্ট। ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদে ৭ দশমিক ৫ পয়েন্ট। সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদে ৭ পয়েন্ট। চারুকলা অনুষদের জন্য ইউনিট ৬ দশমিক ৫ পয়েন্ট।
২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষার ছয় থেকে সাত মাস পর শুরু হয় প্রথম বর্ষের পাঠদান। ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে ভর্তির জন্য ১০টি মেধাতালিকা দিয়েও কাঙ্ক্ষিত শিক্ষার্থী পাওয়া যাচ্ছিল না বিশ্ববিদ্যালয়টিতে। ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষেও দেয়া হয় গণবিজ্ঞপ্তি। এভাবে বহু সমালোচনার পর চলতি শিক্ষাবর্ষ একক ভর্তি পরীক্ষায় ফিরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। শুধু ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মাস পর শুরু করে ক্লাস। এভাবেই বিগত গুচ্ছে কালক্ষেপণ হয়েছে আরও বেশি। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ভর্তি প্রক্রিয়ায় কার্যকর সমন্বয়ের অভাবে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা বিভ্রান্তি ও অনিশ্চয়তায় ভুগেছেন। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক সিনিয়র শিক্ষকরাও বহুবার নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন গুচ্ছ নিয়ে। তারা অনেকেই বলছেন তোষামোদি করে কিংবা সরকারি সিদ্ধান্তে না বলার সাহস না থাকায় এতদিন গুচ্ছ থেকে বের হতে পারছিল না জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
জিপিএ শর্ত কমেছিল কিভাবে এ বিষয়ে জানতে কলা অনুষদের সাবেক ডিন ড. রইছ উদ্দীনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, আমাদের কোনো সিদ্ধান্ত বা মতামত গুচ্ছে মানা হতো না। গুচ্ছ কর্তৃপক্ষ যা নির্দেশনা তৈরি করে দিত আমাদের সে অনুযায়ী কাজ করতে হতো।
এছাড়া গুচ্ছে থাকাকালীন প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে কিংবা একটি নোটিশেও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বলা হতো না। গুচ্ছের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য শিক্ষার্থীদের যে স্বপ্ন ছিলো তা এখন আর নেই বললেই চলে। গুচ্ছ পরীক্ষা দিয়ে কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেলেই হলো। গুচ্ছে থেকে বিগত বছরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে পড়তে হয়েছে নানা সমালোচনার মুখে, পোহাতে হয়েছে কত বিশৃঙ্খলা। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষার্থীরা এতে ক্ষুব্ধ। বর্তমানে আবার জবি সহ ২৪ বিশ্ববিদ্যালয়কে গুচ্ছে ফিরতে নির্দেশ দেয় মন্ত্রণালয় তবে সে দিকে যাবে না বলে সাফ জানিয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য ড. রেজাউল করিম।
উপাচার্য জানায়, আমাদের ভর্তি কার্যক্রমের সকল প্রক্রিয়া প্রায় শেষ। এখন আমাদের গুচ্ছে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সরকারের কাছে আমরা বিষয়গুলো জানিয়েছি। আশা করি তারা আমাদের সাহায্য করবে।
শিক্ষক সমিতির ২০২৩ কার্যনির্বাহী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. আবুল কালাম মো. লুৎফর রহমান জানান, আমাদের সময় সরকারের চাপের কারণে সম্ভব না হলেও এ বছর গুচ্ছ থেকে জবি বেরিয়ে গেছে। এটা সাবেক শিক্ষক নেতাদের পরিশ্রমের ফসল। বিগত গুচ্ছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় যে পাওনা রয়েছে সেগুলোও বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি কখনোই। গুচ্ছের হিসেব এখনো পরিষ্কার না। তিনি জানান, সাবেক ভিসি সাদেকা হালিমের সময়ও শুনেছিলাম দুই থেকে আড়াই কোটি টাকা পাওনা রয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়৷ তবে গুচ্ছ থেকে পাওনার বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো পরিমাণের কথা বলতে পারেননি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান অর্থ পরিচালক ড. রফিকুল ইসলাম। এদিকে জবিকে নতুন করে গুচ্ছ অন্তর্ভুক্তির চেষ্টার বিষয়ে একজোট হয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থী ও ছাত্র সংগঠনের নেতারা।
শাখা শিবির সভাপতি আসাদুল ইসলাম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেন, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় যদি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজপথের ভূমিকা ভুলে না যায় তাহলে আশা করা যায়, তারা কোন ভুল সিদ্ধান্ত নেয়ার চিন্তা মাথায় আনবেন না। শাখা ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি রাকিব এক পোস্টে লিখেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নিবে এটাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। এর বাহিরে কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলে জবিয়ানরা এর উপযুক্ত জবাব দিবে। ইনশা-আল্লাহ। এছাড়া ছাত্রদলের নেতাকর্মীরাও গুচ্ছের বিপরীতে একক ভর্তি পরীক্ষা পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। জবিকে নিয়ে নতুন পায়তারার বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন সাবেক সমন্বয়ক মাসুদ রানা বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা গুচ্ছতে নিতে ইউজিসি যদি চাপ দেয় আমরা শিক্ষার্থীরা মিলে কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তুলবো। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী।
সূত্র: চ্যানেল ২৪
আনন্দবাজার/ এমকে