শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

তিস্তার ভাঙনে নিঃস্ব হচ্ছে মানুষ

তিস্তার ভাঙনে নিঃস্ব হচ্ছে মানুষ

নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে তিস্তা নদী । প্রতি বছর এ নদীর ভাঙনে বিলীন হচ্ছে বসতভিটা ও আবাদি জমি। বাসিন্দারা বসতভিটা হারিয়ে আশ্রয় নিচ্ছেন বেড়িবাধের ওপর ও আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে।

পাউবো সূত্র জানায়,চলতি বন্যা মৌসুমে তিস্তা নদীর ভাঙন দেখা দিয়েছে ৮টি পয়েন্টে।গত জুন মাস থেকেই নদী ভাঙ্গন শুরু হয়েছে।

স্থানীয়রা বলছেন, এ বছর ছয়বার প্লাবিত হয়েছে তিস্তা তীরবর্তী গ্রাম ও নিম্নাঞ্চল। বালু -পলি জমে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গভীরতা কমেছে। এতে নদীর গতিপথ বদল হয়ে সীমানা বাড়ছে। ফলে দুইপাড়ে ভাঙ্গন তীব্র আকার ধারণ করেছে। পাউবো কর্তৃপক্ষ বালুর বস্তা ফেলে ভাঙ্গন রোধের চেষ্টা করছে। তবে তা কাজে আসছে না। উল্টো বালুর বস্তায় স্রোতের ঘূর্ণি সৃষ্টি হয়ে ভাঙ্গন আরো বাড়ছে।

গত একমাসে বিলীন হয়ে গেছে নদী তীরবর্তী ছোটখাতা ও উত্তর গয়াবাড়ি গ্রামের প্রায় এক কিলোমিটার এলাকার ফসলি জমি ও ভিটেমাটি। এতে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে শতাধিক পরিবার। ভাঙন আতঙ্কে দিন পার করছে আরও পাঁচ শতাধিক পরিবার।

ছোটখাতা গ্রামের বাসিন্দা আলী আকবরের (৬০) বসতভিটা থেকে মাত্র ৫ মিটার দূরে চলে এসেছে নদীর ভাঙন। যেকোনো সময় তার বসতভিটা নদীতে বিলীন হতে পারে। এই দুশ্চিন্তায় নির্ঘুম রাত কাটছে তার পরিবারের ৭ সদস্যের। গত সপ্তাহে নদীভাঙনে তার ২ বিঘা আবাদি জমি চলে গেছে তিস্তার গর্ভে ।

আলী বলেন, এ বসতভিটা নদীতে চলে গেলে ভূমিহীন ও গৃহহীন হয়ে পড়ব। চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে বাঁচতে হয় আমাদের।

আরও পড়ুনঃ  চলন্ত ট্রেনের ধাক্কায় নিহত ৫, আহত ২০

আলীর মতোই নির্ঘুম রাত কাটছে তফেল উদ্দিন, আমজাদ ,আমির আলী, সামছুলসহ অন্তত ৫০টি পরিবারের সদস্যদের। তাদের বসতভিটা থেকে তিস্তা নদীর ভাঙনের দূরত্ব এখন ৪-৫ মিটার।
কৃষক নজরুল ইসলাম জানান, তার জীবনে তিনি ১০ -১২ বার বসতভিটা হারিয়েছিলেন। সর্বশেষ বসতভিটায় বসবাস করছেন ৪ বছর ধরে। এই বসতভিটাও যেকোনো মুহূর্তে নদীগর্ভে চলে যেতে পারে। জমি কিনে নতুনভাবে বসতভিটা তৈরির সামর্থ্য আমার নেই। নদীর ভাঙন আমার সবকিছু কেড়ে নিয়েছে বলেন তিনি।

দুই সপ্তাহ আগে নিজের বাড়ি হারিয়ে নদী পাড়ে বসে আছেন মুন্সিপাড়া এলাকার ওমর আলী। তিস্তার পাড়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি হাত দিয়ে দেখালেন, ওই যে দুরে যেখানে স্রোত পাক খাচ্ছে, সেখানেই ছিল আমার বাড়ী। গাছপালা, গোয়ালঘর সবই ছিল, কিন্তু এখন আর কিছুই নেই।

তিনি বলেন, নদীর ভাঙ্গন বাড়ির কাছাকাছি চলে আসায় তিনি কোনমতে একটি ঘর ভেঙে সরিয়ে নেন। ওই দিন রাতেই তার ভিটেমাটিসহ ঘর নদীতে তলিয়ে যায়। এখন তিনি বেড়িবাধে আশ্রয় নিয়েছেন।

৩৫ বছরে ১১বার নদীর ভাঙ্গনের কবলে পড়ে নিঃস্ব হয়েছেন উত্তর গয়াবাড়ির সমেজউদ্দিন । তাঁর নিজের ২০ বিঘা জমিসহ বাড়িঘর নদীতে তলিয়ে যায়।

সমেজউদ্দিন জানান , ১৯৮৮ সাল থেকেই তিনি ভাঙনের মুখোমুখি হচ্ছেন। সেই থেকে একের পর এক নদী ভাঙনে বারবার তার ভিটা বদল করতে হয়েছে।গত বছরের নদী ভাঙ্গনে নিঃস্ব সমেজ এখন অন্যের জমিতেই বসবাস করেন।

ছোটখাতা গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য তফেল উদ্দিন বলেন, দুই বছর আগেও তাদের গ্রাম থেকে তিস্তা নদীর দুরত্ব ছিল দুই কিলোমিটার।নদী ভাঙতে ভাঙতে তাদের গ্রামটি এখন বিলীন হওয়ার পথে। তফেল জানান, নদীর ভাঙনে গ্রামের আবাদি জমি, বসতভিটা চলে যাচ্ছে নদীগর্ভে। ভাঙন হুমকিতে পড়েছে শতাধিক বসতভিটা। যেকোনো সময় নদীভাঙনে তার বসতভিটাও চলে যেতে পারে তিস্তার উদরে।

আরও পড়ুনঃ  সতর্ক থাকার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর

তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও আন্দলোনের কেন্দ্রীয় সদস্য সোহেল হোসেন বলেন,গেলো কয়েক বছরে উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নে জমি-জমা ও বসতভিটা হারিয়ে বহু পরিবার এখন নিঃস্ব। এদের মধ্যে পশ্চিম ছাতনাই ইউনিয়নের জিরো পয়েন্ট থেকে ঝুনাগাছ চাপানী পর্যন্ত ৪০ কিলোমিটার বেড়িবাধ অংশে আশ্রয় নিয়েছে সহস্রাধিক পরিবার। অনেকেই সরকারি খাস জমি অথবা আত্মীয়-স্বজনের জমিতে আশ্রয় নিয়েছেন।

তিনি বলেন, নদী খনন না করে প্রতি বছর ভাঙন রোধে জিও ব্যাগ ফেলার নামে বিপুল পরিমান অর্থ খরচ করা বিলাসিতা। মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন ছাড়া কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে অপরিকল্পিত প্রকল্প কোন কাজেই আসবে না।

উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, ভাঙনের শিকার পরিবারগুলোকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে চাল, ঢেউটিন ও নগদ অর্থ সহযোগিতা করা হয়।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নুর-ই-আলম সিদ্দিকী বলেন, ভাঙনকবলিত পরিবারগুলোর জন্য জরুরি সহায়তার জন্য বরাদ্দ সাপেক্ষে সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়া হবে।

তবে ত্রাণের পরিবর্তে ভাঙন রোধে নদীর তীরে স্থায়ী বাঁধ চান ভুক্তভোগী বাসিন্দারা। নদী ভাঙনের শিকার এজাজ উদ্দিন বলেন, আমরা চাল-ডাল সহযোগিতা চাই না। ভাঙন রোধে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হোক। আমরা যারা ভিটেমাটি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছি, সরকারে পক্ষ থেকে স্থায়ী একটি থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হোক।

ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আসফাউদদৌলা জানান, তিস্তার ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় ভাঙন ঠেকাতে জিও ব্যাগ ফেলছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। ছোটখাতা ও গয়াবাড়ির ভাঙনপ্রবণ জায়গায় জিও ব্যাগ ও টিউব ফেলা হচ্ছে।নদীর ডান তীরে সাড়ে চার কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানান তিনি।

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন