শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বালুখেকোদের কবলে তিস্তাচর

বালুখেকোদের কবলে তিস্তাচর
  • প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার বালু উত্তোলন
  • বিপুল পরিমাণ রাজস্ব বঞ্চিত সরকার

নীলফামারীর ডিমলায় তিস্তা নদীর চরগুলো এখন বালুখেকোদের দখলে। নদীর বুক থেকে প্রতিদিন অবৈধভাবে লাখ লাখ টাকার বালু -পাথর উত্তোলন করছে প্রভাবশালী একটি সিন্ডিকেট। এসব বালু জেলার বিভিন্ন স্থানে নির্মাণাধীন স্থাপনা ও খাল ভরাটের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। এভাবে বালু উত্তোলন চলতে থাকায় নদী ও প্রকৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।ভাঙ্গনের মুখে পড়ছে নদীতীরবর্তী গ্রাম,ফসলি জমি,তিস্তা ব্যারেজ, সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা। অবৈধ বালু ও পাথর বাণিজ্যে সরকারও বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ ব্যাপারে প্রশাসনের অভিযান অব্যাহত থাকলেও বন্ধ হচ্ছে না বালু-পাথর উত্তোলন। স্থানীয় সচেতন মানুষ দাবি করেছেন তিস্তা নদী বাঁচাতে অবৈধ বালু বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। এটা সম্ভব হলে ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষা পাবে হাজার হাজার হেক্টর ফসলি জমি ও জনবসতি।

তিস্তা নদীবেষ্টিত ডিমলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বালু ও পাথর বাণিজ্যের উৎসব। নদীর বিভিন্ন স্থানে বোমা মেশিন (শ্যালো মেশিন) বসিয়েছে অসাধু বালু ব্যবসায়ী চক্র। কেউ কেউ শুকনো চর থেকে কোদাল ও বেলচা দিয়ে বালু উত্তোলন করছে। কেউ আবার নদীর তলদেশ খুড়ে উত্তোলন করছে পাথর। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি স্থানে মৎস্য প্রকল্প ও বসতভিটা উঁচু করনের নামে চলছে বোমা মেশিন দিয়ে খাল খনন। সেখান থেকে মাটি ও বালু উত্তোলন করে বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করা হচ্ছে।

নদী তীরবর্তী বাসিন্দারা জানান, তিস্তা নদী এলাকার তিস্তা ব্যারাজের আশেপাশে, আনন্দ বাজার, চড় খড়িবাড়ি, বাইশপুকুর,কালিগঞ্জ, পূর্ব ছাতনাই,পশ্চিম ছাতনাই,খগাখড়িবাড়ি এলাকায় বালু উত্তোলন হয়ে থাকে। ৪০ থেকে ৫০ জন অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত। তারা জানান, বেশিরভাগই বিভিন্নভাবে স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থেকে এ অবৈধ ব্যবসা করছে।

আরও পড়ুনঃ  পর্যটনের নতুন সম্ভাবনা রাঙ্গাবালী

সরজমিনে উপজেলার টেপাখড়িবাড়ি চরখড়িবাড়ি বিজিবি ক্যাম্পের পশ্চিম পাশে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কংক্রিটের সিসি ব্লক বসিয়ে তিস্তা নদীর বাম তীররক্ষা বাঁধ তৈরির কাজ চলছে।বাঁধের নিচে তিস্তা নদী থেকে বালু তোলার জন্য তিনটি ডিজেলচালিত খননযন্ত্র (বোমা মিশিন) আছে। একটি যন্ত্র দিয়ে বালু তোলা হচ্ছে। বড় লোহার পাইপ দিয়ে বালু তুলে পুকুর, বসতভিটা ভরাট করা হচ্ছে। আবার কোনো কোনো জায়গায় বালু ও পাথর জমা করে রাখা হচ্ছে বিক্রি করার জন্য। সেখানে থেকে বালু ট্রলিতে তোলা হচ্ছে। এ সময় যন্ত্রের কাছে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের কাছে বালুর মালিকের পরিচয় জানতে চাইলে তাঁরা খননযন্ত্রটি মালিক স্থানীয় বাসিন্দা সোলেমান আলী। এ বিষয়ে জানতে চাইলে খননযন্ত্রের মালিক সোলেমান আলী বলেন, বসতভিটা উঁচুকরনের জন্য বালু তোলা হচ্ছে।

ঝুনাগাছ চাপানি ইউনিয়নের তেল পাম্প এলাকায় পুকুর খননের নামে বোমা মিশিন বসিয়ে প্রায় দুই মাস ধরে বালু ও পাথর উত্তোলন করছে মাহবুবুর রহমান নামে এক ব্যক্তি। প্রশাসনের বাঁধায় বালু-পাথর উত্তোলন দুই একদিন বন্ধ থাকলেও আবার চালু হয়েছে উত্তোলন। কেউ কিছু বলেনি। মাহবুবুর রহমানের দাবি, প্রশাসনের কাছে মৌখিক অনুমতি নিয়ে অনুমতি নিয়ে তিনি বালু উত্তোলন করছেন। তবে স্থানীয়রা জানান, স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় মাহবুবর রহমান দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশ্যে দিনে বালু ও রাতে পাথর উত্তোলন করে আসছেন।

এর আগে পূর্ব ছাতনাই কালিগঞ্জ এলাকার মিজানুর ইসলাম ও রশিদুল ইসলাম আলী ওই এলাকার তিস্তা বেড়ি বাঁধের ধার থেকে দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে বালু-পাথর উত্তোলন করে তা বিক্রি করে আসছিল। প্রতিদিন বালুর ট্রলি চলাচলের কারণে এলাকার রাস্তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। এলাকার মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে উপজেলা প্রশাসনকে অবগত করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা  বেলায়েত হোসেন কালিগঞ্জ এলাকায় অভিযান চালিয়ে অবৈধভাবে বালু-পাথর উত্তোলন করায় দুটি খননযন্ত্র জব্দ করেন। পরে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। কিন্তু ১ সপ্তাহ না যেতেই ফের বালু উত্তোলন  করছে তারাসহ আরও ৮ থেকে ১০ জন।

আরও পড়ুনঃ  সৈয়দপুরে ক্লুলেস হত্যা মামলার রহস্য উদঘাটন : গ্রেফতার ৩

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন বলেন, স্থানীয় একটি প্রভাবশালী চক্র বালু-পাথর উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত। এ জন্য তাদের কেউ কিছু বলে না। নদীর চর থেকে প্রতি ট্রলি বালু বিক্রি হচ্ছে ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা করে। ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী আসফাউদদৌলা বলেন, চরখড়িবাড়ি এলাকায় নদীর তীর সংরক্ষণ বাঁধ নির্মাণের কাজ চলমান। এ মুহূর্তে তীর সংরক্ষণ বাঁধের কাছ থেকে বালু উত্তোলন করা হলে বর্ষা এলে বাঁধ তিস্তা নদীর ভাঙনে বিলীন হয়ে যাবে। উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে প্রায়ই ওই এলাকায় অভিযান পরিচালনা করা হয়। এরপরও তীরের পাশ থেকে কেউ বালু উত্তোলন করতে যাতে না পারে, সেদিকে তাঁরা লক্ষ রাখছেন।

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বেলায়েত হোসেন বলেন, গত মঙ্গলবার ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে বালু উত্তোলনের দায়ে আনন্দবাজার এলাকার সোলেমান আলীকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছ। এর আগেও অভিযান চালিয়ে অবৈধভাবে উত্তোলন করা বালু-পাথরসহ খননযন্ত্র জব্দ করা হয়েছে। অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলেও জানান তিনি।

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন