শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শেয়ালের বাসস্থান ‘গণকবর’

শেয়ালের বাসস্থান ‘গণকবর’
  • অযত্ম অবহেলায় বেহাল দশা, দেখার কেউ নেই

জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের হাতে নির্মমভাবে নিহত শহীজামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়েদদের গণকবর। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও আজও অধিকাংশ গণকবরগুলো যথাযথ দেখভালের অভাবে রয়েছে অযত্ন, অবহেলা আর দৃষ্টিসীমার বাইরে। ওই সব স্থান এখন ঘাস, লতাগুল্মতে পরিপূর্ণ, অনেক স্থান পরিণত হয়েছে গোচারণ ভূমিতে। যেন দেখার কেউ নেই।

উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সূত্রে জানা যায়, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের অসংখ্য স্মৃতি ছড়িয়ে রয়েছে এ অঞ্চলটিতে। এখানকার অনেক যুদ্ধ ইতিহাসে জায়গা করে নিলেও এখানকার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের শহীদ হওয়ার স্থান, বধ্যভূমি আর গণকবরগুলো অযত্ন অবহেলায় হারিয়ে যেতে বসেছে। উপজেলার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সে সময়ে নির্মমভাবে নিহত শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষদের গণকবর ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজরিত বধ্যভুমি গুলো।

উপজেলার বারইপটল, ফুলদহের পাড়া, সরিষাবাড়ী মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চত্বর, আরামনগর আউটার সিগনাল, সাইঞ্চার পাড়, কান্দারপাড়া, চেচিয়াবাধা, পারপাড়া গণকবর রয়েছে। এছাড়া জগন্নাথগঞ্জ ঘাট এলাকায় রয়েছে বধ্যভুমি। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও অধিকাংশ গণকবর গুলোর চিহ্ন এখন আর নেই। অন্যদিকে সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে আজ  মুক্তিযুদ্ধের এই স্মৃতি চিহ্নগুলো চলে গেছে সবার দৃষ্টিসীমার বাইরে। ওই সব স্থান এখন ঘাস, লতাগুল্মতে পরিপূর্ণ। কিছু গণকবর চিহ্নিত করা হলেও যথাযথভাবে দেখাশোনার অভাবে তা অযত্ন অবহেলায় পরে রয়েছে।

এখন আর এসব গণকবর বা শহীদদের স্মৃতিচিহ্নে কেও শ্রদ্ধা জানাতে যায় না। নতুন প্রজন্ম জানেই না কোথায় শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গণকবর রয়েছে। বর্তমান সরিষাবাড়ী হাসপাতাল ছিলো তৎকালীন সময়ে রাজাকারদের ক্যাম্প। সেখানে প্রতিদিন মুক্তিবাহিনী ও মুক্তিকামী অসংখ্য সাধারণ মানুষকে ধরে এনে নির্যাতন করে হত্যা করা হতো। হত্যার পর লাশ সামনের সূবর্ণখালী নদীতে ফেলে দিতো। সেখানেও নির্মিত হয়নি কোন মুক্তিযোদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন।

আরও পড়ুনঃ  ‘কোন্টে কোনা রান্দিবারি খামো’

বীর মুক্তিযোদ্ধা লুৎফর রহমান লুলু বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও আজও অযত্ন অবহেলায় পরে আছে আমাদের শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা ভাইদের গণকবর ও যুদ্ধের স্মৃতি বিজরিত বধ্যভূমি গুলো। আমাদের দাবি, সরকারি ভাবে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গণকবর গুলো শুধু চিহ্নিত করাই নয়, এগুলোকে আগামী প্রজন্মের কাছে সঠিকভাবে তুলে ধরার ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলেই আগামী তরুণ প্রজন্ম এদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ, বিজয় ও দেশপ্রেমী মানুষের আত্মত্যাগ সম্পর্কে জানতে পারবে। যদি সংস্কার ও সংরক্ষন করার উদ্যোগ নেয়া না হয় তাহলে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও ইতিহাস রক্ষা করা সম্ভব না বলেও মনে করেন তিনি।

পিংনা ইউনিয়নের বারইপটল গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ গোলাম মোস্তফা কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, তৎকালীন এই এলাকাকে দ্বিতীয় ইন্ডিয়া বলা হতো।  ৭১ সালের ২৫ শে মার্চ এখানে পাক বাহিনীরা হামলা চালায়। ১১ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ হিন্দু মুসলমান মিলে তারা ৪৩ জনকে হত্যা করে। তারপর আমরা এই এলাকার কয়েকটি স্থানে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষদের গণকবর দেয়া হয়। আমরা আমাদের রক্ত দিয়ে দেশকে শত্রুমুক্ত করেছি। বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার ক্ষমতায় থাকার পরও এভাবে শিয়াল কুকুরের বাসস্থান হয়ে অবহেলায় পড়ে আছে আমাদের সহযোদ্ধা শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গণকবর গুলো। এই কষ্ট ও দুঃখের কথা আমরা কার কাছে বলবো।

পুঠিয়ার পাড় হিন্দুপাড়ার মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী বৃদ্ধা নিলিমা সাহা বলেন, ১৯৭১ সালের ২ জুলাই শুক্রবার রাতে আমরা জানতে পারি যে পাক বাহিনী আসতেছে। খবর পেয়ে আমরা জঙ্গলে আত্মগোপন করি। পরে রাত আনুমানিক সাড়ে ১২ টার দিকে হিন্দুপাড়ায় মতিলাল রায় এর বাড়ীতে তৎকালীন ক্যাপ্টেন শমসেদ এর নেতৃত্বে ও স্থানীয় রাজাকার, আলবদরদের সহায়তায় হামলা চালায়। আমরা জঙ্গলে লুকালেও বাড়ীতে থাকা চাদ মহন সাহা, সুরেশ সাহা, রাধা রমন ও ভোলানাথ সাহা পালাতে পারেনি। তাদের ধরে নিয়ে বাড়ীর সামনে রেল লাইনে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। পরে আমরা সেখানেই তাদের মাটি চাপা দিয়ে রাখি। মুক্তিযুদ্ধের এতোদিন পেরিয়ে গেলেও কোন সরকারের পক্ষ থেকে এখানে একটি স্মৃতিচিন্হ নির্মাণ তো দুরের কথা এটিকে সংরক্ষণের উদ্যোগ পর্যন্ত নেয়া হয়নি। 

আরও পড়ুনঃ  ভোগান্তির আরেক নাম ‘ভাঙাসেতু’

শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধে নিহত মুক্তিকামী মানুষদের এসব গণকবর এবং মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বধ্যভূমি গুলো সংস্কার ও সংরক্ষন করার উদ্যোগ নেয়া না হয় তাহলে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও ইতিহাস রক্ষা করা সম্ভব না বলেও মনে করেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা।

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন