শুক্রবার, ২৬শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১১ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হামার বেটা আলাল-দুলাল পাঁচ ক্লাস পাস

হামার বেটা আলাল-দুলাল পাঁচ ক্লাস পাস

কাবিলপুর চর থেকে নদীপার হয়ে একা একা স্কুলে যেতে ভয় লাগে। মমেনা খাতুন ব্রহ্মপুত্র নদের তীরবর্তী গুনভরি উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে লেখাপড়া করতো। আঁকাবাকা ফাঁকা জনমানবহীন রাস্তায় কখন কোনো দুর্ঘটনা ঘটবে এ ভয়ে এক বছর পড়ার পর যাতায়াত সমস্যায় প্রায় ৪ কিলোমিটার দূরে হওয়ার কারণে আর স্কুলমুখো হয়নি।

মমেনা বলেন, সহপাঠি হাসনা, রেখা ও তাহেরাসহ অনেকে ৫ম শ্রেণি পাশ করার পর কেউ আর স্কুলে যায় না। আমার ইচ্ছে ছিল লেখাপড়া করে অনেক বড় হবো, কিন্তু সে স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। শুধু মমেনা খাতুন নয়, গজারিয়া ইউনিয়নের চর কটকগাছা গ্রামের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র আয়নাল মিয়া বলেন, হামরা গরিব মানুষ। বাহিরে নেখা পড়া করাইতে অতো ট্যাকা কই পাবো। পড়াশুনার খরচা, নাও ভারা দেওন নাগে। নদী পার হতে যাইয়া কখন কী হয়। এ কারণে বাবা কইচে তোর পড়ার দরকার নাই। চরে মাধ্যমিক বিদ্যালয় না থাকায় মমেনা ও আয়নালের মত অনেকেই পঞ্চম শ্রেণি পাশ করার পরেই ঝরে পড়ছে। এদের মধ্যে ছেলেরা নিয়োজিত হচ্ছে কৃষিকাজে আর মেয়েদেরকে বসতে হচ্ছে বাল্যবিবাহের পিড়িতে।

ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদী দ্বারা বিচ্ছিন্ন গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার চরাঞ্চলের তিনটি ইউনিয়ন ফজলুপুর, এরেন্ডাবাড়ী, ফুলছড়ি। এছাড়া কঞ্চিপাড়া, উড়িয়া, উদাখালী ও গজারিয়া ইউনিয়নের বেশ কিছু এলাকা চরাঞ্চলে হওয়ায় এখানকার শিক্ষার্থীরাও উচ্চ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এসব ইউনিয়নের বিশাল জনগোষ্ঠী কেবল শিক্ষাই নয়, বঞ্চিত সব রকমের সুযোগ সুবিধা থেকে। ফলে প্রাথমিকের গন্ডি পেরোতেই ঝরে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। এ অঞ্চলের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরই উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন থাকলেও ঝরে পড়ছে অকালে। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে জেলার সামগ্রিক শিক্ষা ও আর্থ সামাজিক অবস্থার উপর। আবার অনেকেই জড়িয়ে পড়ছে বাল্যবিবাহসহ শিশুশ্রমে। এদিকে যে চরগুলোতে মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা যাবে, তার একটি তালিকা করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর আশ্বাস দিয়েছে সংশ্লিষ্ট দপ্তর।

আরও পড়ুনঃ  অগ্নিকাণ্ডে বাড়ি পুড়ে ১০ লক্ষ টাকার ক্ষতি

ফুলছড়ি, সাঘাটা, সুন্দরগঞ্জ ও গাইবান্ধা সদর উপজেলার বুক চিড়ে বয়ে যাওয়া ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, যমুনা নদীর জেগে উঠা ছোট বড় সব মিলিয়ে ১৬৫টি চর ও দ্বীপচর রয়েছে। এসব চরে বসবাস করে প্রায় ৪ লক্ষ মানুষ। তাদের একমাত্র প্রধান পেশা হচ্ছে কৃষি। কৃষির উপর নির্ভর করেই তারা বেঁচে থাকেন। সরকারি পরিসংখ্যানে গাইবান্ধা জেলায় শিক্ষার হার ৬৬ ভাগ। ফুলছড়ি উপজেলার চরাঞ্চলে মাধ্যমিক বিদ্যালয় ৪টি ও দাখিল মাদ্রাসা রয়েছে মাত্র ২টি। উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের তথ্য অনুযায়ী ফুলছড়ি উপজেলার চরাঞ্চলে ৭৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এছাড়াও নদীভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। চরাঞ্চল থেকে প্রায় ৮০ ভাগ ছাত্র-ছাত্রীরা প্রাথমিকের গন্ডি পাস করলেও অর্ধেকের বেশি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে না। চরাঞ্চলের শিক্ষা নিম্ন হারের কারণে উপজেলায় বাড়ছে দারিদ্রতা, বেকারত্ব, বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রম। এ চরাঞ্চলগুলোতে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের স্থাপনের দাবি অবিভাবকদের। উপজেলার কাবিলপুর চরের জুনাইদ সিদ্দিকি পড়ে গাইবান্ধা সরকারি কলেজে। তিনি বলেন, ওই চর থেকে গত বছর ২৩ জন শিক্ষার্থী পঞ্চম শ্রেণি পাস করলেও হাই স্কুলে ভর্তি হয়েছে মাত্র ৭ জন। চর এলাকায় হাই স্কুল না থাকাই ঝরে পড়ার মূল কারণ। অনেকেই হাই স্কুলে ভর্তি হলেও মাঝপথে ঝরে পড়ে যাতায়াত ও আবাসন সংকটের কারণে। চর কাবিলপুর গ্রামের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী রবিউল হাসান বলেন, পড়তেতো ইচ্ছে করে, কিন্তু হামঘরে (আমাদের) চরে বড় স্কুল নাই। তাই বাবা কইচে আর পড়তে হবে না। তুই হামার সাথে খেতোত (জমিতে) কাম করবু। তখন থ্যাকা বাধ্য হয়া আব্বার সাথে জমিত কাজ করি। কালাসোনা চরের হবিবুর রহমান বলেন, হামার দুই বেটা(ছেলে) আলাল ও দুলাল। ওরা দু’জনেই ৫ ক্লাস পাস করিসে। ওর উপরে আরও কোন স্কুল চরে না থাকায় দুই পোলা স্কুলে যাইতে পারে নাই। ওরা এখন কৃষি কাজে যুক্ত হয়েছে। আর মাইয়া হাবিবা খাতুন বাড়ির কাছে স্কুল থাকায় সে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ালেহা করছে। হাতের উপর সংসার, ওদের যদি বড় স্কুলে ভর্তি করায়, তাহলে নদী পার হতে হবে, নৌকা ভাড়া লাগবে, দুপুরে খাওন দিতে হইবো। মেলা খরচা হবো, আমি একা কিভাবে সামলামু। এ প্রসঙ্গে মানবাধীকার কর্মী আব্দুল কাদের ভূইয়া আকাশ বলেন দুর্গম চরে যাতায়াত সমস্যা প্রকট। মাধ্যমিক শিক্ষার সুযোগ নেই। যেহেতু চরগুলো প্রায় নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়ে সেক্ষেত্রে দুই তিনটি চরে মিলে একটি করে মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হলে ওইসব এলাকার ছাত্র-ছাত্রীদের অকালে ঝড়ে পড়া থেকে রক্ষা হতো।

আরও পড়ুনঃ  সড়কে বাসস্ট্যান্ড, যানজটে ভোগান্তি

শিক্ষাবিদ জহুরুল কাউয়ুম বলেন, চরাঞ্চলে পর্যাপ্ত মাধ্যমিক স্কুল না থাকার কারণে এমনটি ঘটছে। দুই তিনটি চর এলাকার সাথে সমন্বয়ে মাধ্যমিক বিদ্যালয় গড়ে তোলা হলে চরে উন্মোচিত হতে পারে শিক্ষার নতুন দিগন্ত। তখন চরাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা শিক্ষার সুযোগ পেয়ে বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রম ও অপরাধের মত কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকবে।

ফুলছড়ি উপজেলা মাধ্যমিক কর্মকর্তা সৈয়দ মনিরুজ্জামান বলেন, উপজেলার চরাঞ্চলের এরেন্ডবাড়ী ইউনিয়নে হরিচন্ডী জিয়াবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়, জিগাবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয় ও আলগারচর নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এছাড়া উড়িয়া ইউনিয়নে চিকির পটল দাখিল মাদ্রাসা, ফুলছড়ি ইউনিয়নে ফুলছড়ি নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় ও টেংরাকান্দি এমএ সবুর দাখিল মাদ্রাসা রয়েছে। ফজলুপুর ইউনিয়নের কোন মাধ্যমিক  বিদ্যালয় কিংবা মাদ্রাসা নেই।

গাইবান্ধা জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার এনায়েত হোসেন বলেন, কোন কোন চরে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই। যে কয়টি বিদ্যালয় আছে তা নদী তীর ঘেষে। আর যে চরগুলোতে মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করার উপযোগী, সেই চরগুলোর একটা তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। তালিকাটি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন