শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অরক্ষিত শেরপুরের গণকবর-বধ্যভূমি

অরক্ষিত শেরপুরের গণকবর-বধ্যভূমি

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে তুলতে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্নগুলো বিশেষ করে গণকবর ও বধ্যভূমিগুলো সম্পর্কে  ভবিষ্যত প্রজন্মকে অবহিত করা প্রয়োজন হয়ে উঠলেও শেরপুরের সেইসব স্মৃতিচিহ্ন, গণকবর ও বধ্যভূমিগুলো অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে। বিজয়ের ৫১ বছরেও যেন দেখার কেউ নেই। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দেশজুড়ে চালিয়েছে বীভৎস হত্যাযজ্ঞ। পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে প্রাণ দিয়েছেন শেরপুরের অসংখ্য নারী-পুরুষ। গণহত্যার পর কোথাও মাটিচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে, কোথাও লাশ ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে নদীতে। আবার কোথাও হত্যাযজ্ঞের পর স্থানীয় লোকজন লাশগুলো দাফন ও সৎকারও করেছেন। তবে, দেশ স্বাধীনের পর ওইসব বধ্যভূমি ও গণকবরগুলো সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। যে কারণে আজও নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের প্রগতিশীল আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবাহী স্থান, গণকবর ও বধ্যভূমিগুলো সরকারিভাবে সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছেন।

নাকুগাঁও: ১৯৭১ সালের ২৫ মে নালিতাবাড়ী উপজেলার নাকুগাঁও সীমান্তের ভোগাই নদী পার হয়ে পাকহানাদার বাহিনী ভারতের বারাঙ্গাপাড়া থানার ডালুতে গণহত্যা চালায়। ওই সময় বাংলাদেশ থেকে ডালুতে আশ্রয় নেওয়া মুক্তিকামী মানুষ ও ভারতীয় নাগরিকসহ ২ শতাধিক নারী-পুরুষ নিহত হয়। পাক হানাদারদের প্রতিরোধ করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন ৯ জন বিএসএফ সদস্য। ভারতের কাটাতার ঘেঁষা নাকুগাঁওয়ে গণহত্যার শিকার বাংলাদেশি মুসলমানদের লাশ দাফন করা হয়। এছাড়াও ৯ মাসে ওই স্থানে বিভিন্ন যুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবর দেয়া হয়।

স্বাধীনতার পর ভারত সরকার তাদের বিএসএফ সদস্যদের স্মরণে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করে। সেটিকে আরও বৃহৎ আকারে সংস্কার করে স্মৃতিস্তম্ভটি পুনঃনির্মাণ করে ভারত সরকার। তবে, নাকুগাঁওয়ের গণকবরটি এখনও অবহেলায় পড়ে আছে। ১৯৯৭ সালে এলজিইডির তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী নাকুগাঁও গণকবরটি এলজিইডির মাধ্যমে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেন। তবে, আজও তা আলোর মুখ দেখেনি।

উল্লেখ্য, সীমান্ত এলাকার কোল ঘেঁষে ‘নো ম্যান্স ল্যান্ড’ এলাকা হওয়ায় সেখানে স্মৃতিফলক নির্মাণ করা সম্ভব নয় বলে দায়িত্বশীলদের একটি মহল দাবি করলেও ওই বধ্যভুমির আশেপাশে বাংলাদেশ অংশে অনেক বাড়ি-ঘর এবং ভারতীয় অংশের বধ্যভূমিকে নদীর ভাঙন থেকে রক্ষা করতে সিমেন্ট ও কংক্রিটের পাইলিং করে তীর রক্ষা বাঁধ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেছে ভারত সরকার।

আরও পড়ুনঃ  সাড়া ফেলেছে ‘ইউটিউবার-চিরকুমার’

আহমদ নগর :  মুক্তিযুদ্ধকালীন ঝিনাইগাতী উপজেলার আহমদ নগর উচ্চ বিদ্যালয়ে শক্তিশালী ঘাঁটি স্থাপন করে হানাদার বাহিনী। সেটি ছিল পাক হানাদার

বাহিনীর আঞ্চলিক হেডকোয়ার্টার। পাকবাহিনী এবং তাদের দোসররা আহমদ নগর উচ্চ বিদ্যালয়কে নির্যাতন কেন্দ্র ও বধ্যভূমি হিসেবে ব্যবহার করে। একাত্তরে ৯ মাসই সেখানে চলে তাদের নৃশংসতা। পাকিস্তানি পশুরা নারী-পুরুষের ওপর অমানুষিক অত্যাচার চালানোর পর তাদের বগাডুবি ব্রিজে নিয়ে অথবা কোয়ারি রোড, জুলগাঁওয়ে হত্যার পর ওইসব লাশ মাটিচাপা দিয়ে অথবা নদীতে ভাসিয়ে দিত। স্বাধীনতার পর আহমদনগর স্কুল ও তার আশপাশ এলাকায় অসংখ্য কঙ্কাল পাওয়া যায়। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ঘাগড়া কোনাপাড়া বধ্যভূমির পাশে এলজিইডির অর্থায়নে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হলেও তা অসম্পূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। স্মৃতিস্তম্ভটি রক্ষণা-বেক্ষণের অভাবে তা এখন গো-চারণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে। আহমদনগর বধ্যভূমিতে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ ছাড়া এখানে আর কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

জগৎপুর : ঝিনাইগাতী উপজেলার জগৎপুর গ্রামে ১৯৭১ সনের ৩০ এপ্রিল গণহত্যা চালানো হয়। সেদিন ওই গ্রামের ৪২ জন হিন্দু পরিবারের সদস্যসহ মোট ৫৮ জন নারী-পুরুষকে হত্যা করা হয়। পুড়ে ছারখার করে দেয়া হয় বাড়িঘর। গণহত্যার ওইস্থানটিতে স্মৃতিস্তম্ভ বা শহীদদের স্বীকৃতি দেয়ার কোনো  উদ্যোগ আজও নেয়া হয়নি।

তন্তর : নালিতাবাড়ী উপজেলার রামচন্দ্রকুড়া-মন্ডালিয়াপাড়া ইউনিয়নের তন্তর

গ্রামটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অস্থায়ী ঘাঁটি। ১৯৭১ সালের ৩০ জুন পাকহানাদার বাহিনী আলবদর-রাজাকারদের নিয়ে ওই গ্রামে হামলা চালায়। ওইসময় ৩ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ মোট ৭ জন শহীদ হন। কিন্তু গ্রামবাসীদের অপরিসীম ত্যাগ ও শহীদদের স্মৃতি সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ-আয়োজন নেই আজও।

কাঁটাখালি ব্রিজ এবং রাঙ্গামাটি-খাটুয়ামারি গ্রাম :

শেরপুর-ঝিনাইগাতী-নালিতাবাড়ী সড়কের কাঁটাখালি ব্রিজটিই ছিল তখন সীমান্ত যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। তাই পাকহানাদারদের সীমান্ত এলাকায় অবাধ যাতায়াত বন্ধ করতে ওই ব্রিজটি ভাঙার সিদ্ধান্ত নেয় মুক্তিযোদ্ধারা। তবে, পর পর দু’বার অপারেশন করেও সফল না হওয়ার পর ওই ব্রিজ অপারেশনে আসেন ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি প্রকৌশল অনুষদের শেষ বর্ষের ছাত্র নাজমুল আহসান। ১৯৭১ সালের ৫ জুলাই রাতে তিনি তার ৫৩ জন সহযোদ্ধাদের নিয়ে কাঁটাখালি ব্রিজ এবং তিনানি ফেরি ধ্বংসের সফল অপারেশন শেষে ঝিনাইগাতীর রাঙ্গামাটি-খাটুয়ামারি গ্রামে আশ্রয় নেন। পরদিন ৬ জুলাই ওই গ্রামের দালাল জালাল মিস্ত্রির সহযোগীতায় পাকসেনারা ৩ দিক পানিবেষ্টিত গ্রামটিতে হামলা চালায়। ওই সময় সম্মুখ যুদ্ধে কোম্পানি কমান্ডার নাজমুল আহসান, তার চাচাতো ভাই মোফাজ্জল হোসেন,  ভাইপো আলী হোসেন শহীদ হন। আহত হন বেশ ক’জন। এছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেয়ার অপরাধে ৯ জন গ্রামবাসীকে নৃশংসভাবে হত্যা ও ৬ জন নারীকে ধর্ষণ করা হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধে অপরিমেয় ত্যাগ স্বীকার করা ওই গ্রামটির ৪ জন বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি, শহীদ নাজমুল আহসানের নামে নালিতাবাড়ীতে একটি কলেজ এবং শহীদ নাজমুল আহসানকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করা হলেও  রাঙ্গামাটি-খাটুয়ামারি গ্রামে প্রতিষ্ঠা পায়নি আজও কোনো স্মৃতিস্তম্ভ।

আরও পড়ুনঃ  জাককানইবির ছাত্র তৌহিদ হত্যায় জড়িত যুবক গ্রেফতার

সোহাগপুর বিধবা পল্লী : নালিতাবাড়ী উপজেলার কাকরকান্দি ইউনিয়নের সোহাগপুর গ্রামে ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা তাণ্ডব চালায়। ওইদিন সোহাগপুরের ১৮৭ জন নিরীহ পুরুষকে গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে তারা। ওইসময় হায়েনাদের পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন স্থানীয় ১৩ জন নারী। স্বাধীনতার পর গ্রামটি বিধবাপল্লী হিসেবে দেশ-বিদেশে পরিচিতি লাভ করে। ওই গ্রামে এখনো রয়েছে ৫৯টি গণকবর। আলোচিত এই গ্রামটিকে এক নজর দেখার জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ আসে। কিন্তু ওই গ্রামে গিয়েও তারা হতাশ হন। কারণ এখানে সেই ভয়াবহ গণহত্যার স্মৃতি মনে রাখার মতো কিছুই নেই। রয়েছে একটি স্মৃতিফলক আর বসার জন্য একটি ঘর। বিধবা পল্লীর ৬ জন বীরাঙ্গনা নারীকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি ও পল্লীর বিধবারা সরকারি-বেসরকারি সাহায্য-সহায়তা পেলেও সেখানে আজ হারাতে বসেছে সোহাগপুর বিধবা পল্লীর সেই রক্তস্নাত ইতিহাস। মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ধরে রাখতে সেখানে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি জাদুঘরসহ নানা কিছু করা যেতে পারে। এজন্য শহীদ পরিবারের সদস্যরা জমি দিতেও ইচ্ছুক। কিন্তু নেই কোনো কার্যকর উদ্যোগ।

সূর্যদি গ্রাম : চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের মাত্র ২১ দিন আগে শেরপুর সদর উপজেলার সূর্যদি গ্রামে ঘটে এক নারকীয় গণহত্যা। ১৯৭১ সনের ২৪ নভেম্বর ওই গ্রামে পাক হানাদার ও তাদের দোসরদের নারকীয়তার শিকার হন একমুক্তিযোদ্ধাসহ ৬২ জন গ্রামবাসী। এখানে শহীদদের কবর সংস্কার কিংবা সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেই।

রামচন্দ্রকুড়া ফরেস্ট ক্যাম্প : নালিতাবাড়ী উপজেলার ওই ফরেস্ট ক্যাম্পটি ছিল পাকসেনাদের ঘাঁটি। যুদ্ধের ৯ মাস এখানে বহু মানুষকে নির্য়াতন চালিয়ে হত্যা করা হয়। ধর্ষণ করা হয় নারীদের। স্বাধীনতার পর সেখানকার কূপ থেকে উদ্ধার করা হয় অসংখ্য কঙ্কাল। কালের সাক্ষী ওই ক্যাম্পটির স্মৃতি আজ হারাতে চলেছে।

আরও পড়ুনঃ  পাঁচবিবিতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মাঝে অনুদানের চেক বিতরণ

অন্যান্য : শেরপুর শহরের শেরীব্রিজ, সুরেন্দ্র সাহার বাড়ির আলবদরদের টর্চার সেল, সদর থানার সামনে অ্যাডভোকেট এম এ সামাদ সাহেবের বাড়ির বধ্যভূমি, জেলা প্রশাসকের বাংলোর পাশে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির কার্যালয়, ঝিনাইগাতী উপজেলার নকশী ও নকলার নারায়ণখোলায় গণকবর, শ্রীবরদীর কাকিলাকুড়া গ্রামে রয়েছে বীর বিক্রম শাহ মুতাসীন বিল্লাহ খুররমের সমাধিস্থলসহ জেলার আরও কিছু জায়গায় মহান মুক্তিযুদ্ধের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তবে, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবাহী ওইসব স্থান সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেই।

এ প্রসঙ্গে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের  সাবেক কমান্ডার নুরুল ইসলাম হিরো বলেন,  মুক্তিযুদ্ধের গণকবর ও বধ্যভূমিসহ স্মৃতিচিহ্নগুলো আমাদের ইতিহাসের সাক্ষী। বর্তমান সরকার যখন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত ভবন, স্থাপনা, বধ্যভূমি ও স্মারকসমূহ সংরক্ষণে সচেষ্ট, ঠিক তখনও শেরপুরের ওইসব স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণে কার্যকর কোন পদক্ষেপ না থাকার বিষয়টি দুঃখজনক। তবে আহম্মদনগরসহ জেলার অন্যান্য বধ্যভূমি ও গণকবরের স্থানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য ইতোপূর্বে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছিল। তিনি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণ এবং বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের স্বার্থে ওইসব স্মৃতিচিহ্নগুলো সরকারি উদ্যোগে সংরক্ষণের দাবি জানান।

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন