শুক্রবার, ২৬শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১১ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিএনপির গণসমাবেশ--

পদত্যাগের ঘোষণা এমপিদের

পদত্যাগের ঘোষণা এমপিদের

নানা নাটকীয়তা, জল্পনা-কল্পনা আর অনিশ্চয়তার মধ্যে অবশেষে বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। গতকার শনিবার বিকেল ৪টার দিকে রাজধানীর গোলাপবাগ মাঠে এ গণসমাবেশ হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন। গণসমাবেশ থেকে তিনি নতুন কর্মসূচি হিসেবে ১০ দফা ঘোষণা করেন। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এই ১০ দফা দাবি আদায়ে আগামী দিনে দলটি আন্দোলন করবে।

বিএনপির মিত্র রাজনৈতিক দল ও সংশ্লিষ্ট সব গোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনা করে এ ১০ দফা ঠিক করা হয়েছে বলে জানান খন্দকার মোশাররফ হোসেন। প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি বলেছেন, সরকার আজকের গণসমাবেশে বাধা দেওয়ার জন্য নানান ষড়যন্ত্র করেছে। আমাদের সাড়ে চারশোর বেশি নেতাকর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। তবে সব বাধা-বিপত্তি মোকাবিলা করে আজকের ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ সফল হয়েছে।

বিএনপির গণসমাবেশ থেকে ঘোষিত বিএনপির ১০ দফা দাবিগুলো হলো-
১. বর্তমান জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত করে ক্ষমতাসীন সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে।
২. ১৯৯৬ সালে সংবিধানে সংযোজিত ধারা ৫৮-খ, গ ও ঘ’-এর আলোকে একটি দল নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার/ অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন।
৩. নির্বাচনকালীন দল নিরপেক্ষ সরকার/ অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্ববধায়ক সরকার বর্তমান অবৈধ নির্বাচন কমিশন বাতিল করে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন, উক্ত নির্বাচন কমিশন অবাধ নির্বাচনের অনিবার্য পূর্বশর্ত হিসাবে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিশ্চিত করতে আরপিও সংশোধন, ইভিএম পদ্ধতি বাতিল ও পেপার ব্যালটের মাধ্যমে ভোটের ব্যবস্থা করা এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার বাতিল করা।
৪. খালেদা জিয়াসহ সব বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী, সাংবাদিক এবং আলেমদের সাজা বাতিল, সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও রাজনৈতিক কারাবন্দিদের অনতিবিলম্বে মুক্তি, দেশে সভা, সমাবেশ ও মত প্রকাশে কোনো বাধা সৃষ্টি না করা, সব দলকে স্বাধীনভাবে গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনে প্রশাসন ও সরকারি দলের কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ বা বাধা সৃষ্টি না করা, স্বৈরাচারী কায়দায় বিরোধী কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করার লক্ষ্যে নতুন কোনো মামলা ও বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার না করা।
৫. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ এবং বিশেষ ক্ষমতা আইন-১৯৭৪সহ মৌলিক মানবাধিকার হরণকারী সব কালা-কানুন বাতিল করা।
৬. বিদ্যুৎ, জ্বালানি, গ্যাস ও পানিসহ জনসেবা খাতের মূল্যবৃদ্ধির গণবিরোধী সরকারি সিদ্ধান্ত বাতিল।
৭. নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আনা, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারকে সিন্ডিকেট মুক্ত করা।
৮. গত ১৫ বছর ধরে বিদেশে অর্থ পাচার, ব্যাংকিং ও আর্থিক খাত, বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাত ও শেয়ার বাজারসহ রাষ্ট্রীয় সব ক্ষেত্রে সংঘটিত দুর্নীতি চিহ্নিত করতে একটি কমিশন গঠন/দুর্নীতি চিহ্নিত করে অতি দ্রুত যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ।
৯. গত ১৫ বছরে গুমের শিকার সব নাগরিককে উদ্ধার এবং বিচারবহির্ভূত হত্যা ও রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের প্রতিটি ঘটনার দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করে যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর, উপাসনালয় ভাঙচুর এবং সম্পত্তি দখলের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা করা।
১০. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন ও বিচার বিভাগকে সরকারি হস্তক্ষেপ পরিহার করে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেওয়া।

আরও পড়ুনঃ  পর্যটন খাতে ক্ষতি ১৪ হাজার কোটি, বেকার ৪০ লাখ

সাত এমপির পদত্যাগের ঘোষণা
সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপি থেকে নির্বাচিত সাত সংসদ সদস্য। গোলাপবাগ মাঠে বিএনপির গণসমাবেশ থেকে একে একে তারা পদত্যাগের বিষয়টি তাদের বক্তব্যে নিশ্চিত করেন। বিএনপির সাত এমপি হলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের উকিল আবদুস সাত্তার, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের হারুনুর রশীদ, বগুড়া-৬ আসনে গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ, বগুড়া-৪ আসনে মোশাররফ হোসেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনে আমিনুল ইসলাম, ঠাকুরগাঁও-৩ আসনে জাহিদুর রহমান জাহিদ ও সংরক্ষিত মহিলা আসনে রুমিন ফারহানা।

বক্তব্যে বগুড়া-৬ আসনে গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ বলেন, আমি অনির্বাচিত সংসদের নির্বাচিত সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করছি। ঠাকুরগাঁও-৩ আসনে জাহিদুর রহমান জাহিদ বলেন, এই সমাবেশকে সাক্ষী রেখে পদত্যাগ ঘোষণা করেছি। বগুড়া-৪ আসনে মোশাররফ হোসেন বলেন, আমাদের পদত্যাগে এই সরকারের হয়তো বোধদয় হবে। কিন্তু তাদের পরিবর্তন আসেনি। তারা জনগণের অধিকারকে তোয়াক্কা করে না। তাই এই গণতন্ত্রের জন্য সংসদ থেকে পদত্যাগ করলাম। সমাবেশে জানানো হয়, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের হারুনুর রশীদ বিদেশে আছেন। পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করে গেছেন। সংরক্ষিত মহিলা আসনের সদস্য রুমিন ফারহানা বলেন, খেলা তো শুরু হয় নাই। আপনারা মামলা-হামলা করে আমাদের দমন করতে পারেন নাই। এখানে মানুষ আর মানুষ। মানুষ আওয়ামী লীগকে লাল কার্ড দেখয়েছে।

পদত্যাগের চিঠি পাননি স্পিকার
জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, বিএনপির সংসদ সদস্যদের কোনও চিঠি আমি পাইনি। আমার কাছে কোনও চিঠি আসেনি। গোলাপবাগের সমাবেশে বিএনপির সাতজন সংসদ সদস্যের পদত্যাগ বিষয়ে স্পিকার বলেছেন, কোথায় বলেছেন বলতে পারি না। আজ তো অফিস বন্ধ। আমার কাছে কোনও চিঠি আসেনি।

আরও পড়ুনঃ  হজ নিয়ে সুখবর পররাষ্ট্রমন্ত্রীর

গণসমাবেশ আয়োজনে নানা ঘটনা
রাজধানীতে বিএনপির বিভাগীয় এই গণসমাবেশ আয়োজন নিয়ে বেশি কিছুদিন ধরেই সরকার ও বিএনপির মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়। বিএনপি নয়াপল্টনে সমাবেশ করতে চাইলেও সরকারের পক্ষ থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বা যেকোনো মাঠে করার কথা বলা হয়। বিএনপি নয়াপল্টনেই সমাবেশ করতে অনড় অবস্থানে থাকে। এ নিয়ে বিতর্ক ও আলোচনার মধ্যেই গত বুধবার বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংর্ঘষের ঘটনা ঘটে। এতে একজনের মৃত্যু এবং অনেকেই আহত হন। এরপর বিএনপি কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতাসহ অন্তত তিন শতাধিক কর্মীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সংঘর্ষের পর থেকে এখনও নয়াপল্টন পুলিশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

পরদিন বৃহস্পতিবার বিকেলে সমাবেশের স্থান নিয়ে ডিএমপি কমিশনারের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের ফের বৈঠকে হয়। বৈঠকে বিএনপি কমলাপুর স্টেডিয়াম এবং ডিএমপির পক্ষ থেকে বাঙলা কলেজ মাঠের প্রস্তাব করা হয়। রাতেই বিএনপির পক্ষ থেকে এই দুই স্থানের যেকোনো একটির বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণার কথা ছিল। কিন্তু শুক্রবার দুপুরে নতুন করে রাজধানীর গোলাপবাগ মাঠে সমাবেশের করতে চাইলে অনুমতি পায় বিএনপি।
যেখানে গতকাল শনিবার সকাল সোয়া ১০টায় কোরআন পাঠের মধ্য দিয়ে বিএনপির সমাবেশ শুরু হয়। গোলাপবাগ মাঠে জায়গা না পেয়ে রাস্তা ও আশপাশের এলাকায় অবস্থান নেয় নেতা-কর্মীরা। সমাবেশের মূল মঞ্চে ২টি চেয়ার ফাঁকা রাখা হয়েছিল। যার একটিতে খালেদা জিয়া ও অপরটিতে তারেক রহমানের নেমপ্লেট রাখা হয়েছিল।

এর আগে, সমাবেশে যোগ দিতে শুক্রবার বিকেল থেকেই সমাবেশস্থলে আসতে শুরু করেন দলটির নেতাকর্মীরা। রাতেই ভরে যায় গোলাপবাগ মাঠ। শনিবার ভোর হতেই খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে সমাবেশে যোগ দিতে থাকেন নেতাকর্মীরা। সমাবেশস্থল কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যাওয়ায় মানিকনগর বিশ্বরোড, ধলপুর রোডসহ কমলাপুর থেকে হানিফ ফ্লাইওভারের রাস্তা পর্যন্ত অবস্থান নেন বিএনপি নেতাকর্মীরা।

আরও পড়ুনঃ  রাজস্ব আদায়ে ৪৫ হাজার কোটি টাকা পিছিয়ে এনবিআর

আনন্দবাজার/শহক

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন