ঢাকা | শুক্রবার
২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রাজনীতির ধকলে ঢাকা

রাজনীতির ধকলে ঢাকা

দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে গত এক দেড় মাস থেকেই। ঢাকার বাইরে বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশ ঘিরে উত্তেজনার পারদ ঊর্ধ্বমুখী হতে থাকে। এসব উত্তেজনার মধ্যে বহু নাটকীয়তার পর অবশেষে গতকাল শনিবার বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে রাজধানীর গোলাপবাগ মাঠে। সমাবেশে যোগ দিতে ঢাকার বাইরে থেকে নেতাকর্মীরা আগেভাগে আসতে শুরু করে। তবে এই গণসমাবেশ ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে যতটা না উত্তেজনা ছড়ায় তারচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পড়তে হয় নগরবাসী ও সাধারণ মানুষকে।

গতকালের বিএনপির গণসমাবেশ ঘিরে নাশকতার আশঙ্কায় কয়েক ঘণ্টা আগে থেকেই রাজধানীতে গণপরিবহন বন্ধ হয়ে যায়। কোনো ঘোষণা ছাড়াই গতকাল শনিবারও বন্ধ থাকে গণপরিবহন। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয় সাধারণ মানুষকে। সকালে ঘর থেকে বের হয়েই বাস সংকটে পড়তে হয়। অফিসগামীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। বাস না পেয়ে অনেককে পিকআপ ভ্যানে করে গন্তব্যে যেতে দেখা গেছে।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, সকাল থেকে রাজধানী ঢাকায় গণপরিবহন সংকট দেখা দেয়। যাতে দুর্ভোগ পোহাতে হয় পথচারী ও অফিসগামীদের। ঢাকার কয়েকটি রুটে বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। কিছু সিএনজি অটোরিকশা চলল করলেও তারা স্বাভাবিক ভাড়ার চেয়ে দুই থেকে তিনগুণ বেশি ভাড়া দাবি করেছে। সড়কে রিকশা, লেগুনা চলাচল করলেও স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ভাড়া আদায় করা হয়েছে।

অন্যদিকে, আগে থেকেই বন্ধ ছিল দূরপাল্লার বাস চলাচল। ঢাকা থেকে কোনো বাস ছেড়ে যায়নি। কোনো বাস ঢাকাতেও প্রবেশ করেনি। বিএনপির সমাবেশের দিন ঢাকা, শহরতলী এবং আন্তঃজেলা রুটে গণপরিবহন চলাচল স্বাভাবিক থাকবে বলে আগেরদিন জানিয়েছিলেন ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির নেতারা। তবে পরদিন দেখা গেছে উল্টো চিত্র। গতকাল ঢাকার মহাখালী, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে কোনো দূরপাল্লার বাস ছাড়তে দেখা যায়নি।

সায়েদাবাদ, মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে কোনো বাস না ছাড়ার কারণে বিপাকে পড়েন সাধারণ মানুষ। অনেকে নিরুপায় হয়ে কয়েকগুন বেশি ভাড়া দিয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, রিকশা ও মোটরসাইকেলে করে গন্তব্যে গেছেন। মহাখালী বাস টার্মিনালে এক যাত্রী বলেন, আমি যেতে চেয়েছিলাম ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে। খুব সকালেই বাস টার্মিনালে এসে দেখি বাস বন্ধ। টার্মিনালের বাইরে অপেক্ষা করেও কোনো লোকাল গাড়ি পর্যন্ত পাইনি।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা এক যাত্রী অফিস থেকে ছুটি নিয়েছিলেন ময়মনসিংহে তার বাড়ি যাওয়ার জন্য। সকালে মহাখালী টার্মিনালে এসে দেখেন সব বাস বন্ধ। ঢাকা থেকে ময়মনসিংহগামী কোনো বাসের কাউন্টারই খোলা নেই। এ অবস্থায় বিপাকে পড়েন তিনি। সিএনজিচালিত অটোরিকশায় দ্বিগুণ ভাড়া দিয়ে টার্মিনালে পৌঁছালেও তিনি থমকে ছিলেন। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, পেপারে পড়েছিলাম বাস চলবে। এখন এসে দেখি সব বাস বন্ধ। ভাবছিলাম ঢাকায় প্রবেশে বাধা থাকতে পারে কিন্তু ঢাকা ছাড়তেও যে বাধা সেটা বুঝে উঠতে পারিনি।

অতি পরিচিত এক পরিবহন কোম্পানির কাউন্টারের একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বললেন, সিদ্ধান্ত ছিল বাস বন্ধ হবে না। সকালে বাস সিরিয়ালেও লাগিয়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করে ঘোষণা আসে বাস চলবে না। পরে সব বন্ধ রাখা হয়। তবে কী কারণে বন্ধ রাখা হয় তা জানানো হয়নি। তবে বাসের এক চালক বললেন, আজ তেমন একটা যাত্রী নেই। তাছাড়া সমাবেশের কারণে যদি বাস ভাঙচুর হয়, সেজন্য বাস রেখেছি। সামান্য কয়টা টাকার জন্য যদি বাসে ক্ষতি হয় তাহলে তো সব শেষ। আমার মতো সবাই ভয়ে গাড়ি চালাচ্ছে না।

তবে মহাখালী বাস টার্মিনাল সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম গণমাধ্যমকে বলেন, বাস বন্ধ নেই। তবে যাত্রীর অভাবে বাস ছাড়ছে না। তেলের দাম বেড়ে যাওয়াতে পরিবহন খরচ বেড়েছে। হাতেগোনা যাত্রী নিয়ে বাস চালালে জ্বালানি খরচই উঠবে না।

এদিকে, ঢাকায় বিএনপির গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে গতকাল ভোর থেকেই বুড়িগঙ্গা নদীর নৌকা পারাপার বন্ধ ছিল। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বসিলা সেতু দক্ষিণ প্রান্ত থেকে খোলামোড়া ঘাট, মান্দাইল মসজিদ ঘাট, জিনজিরা ফেরীঘাট, বাঁশপট্টি ঘাট, আগানগর ব্রীজ ঘাট, কালীগঞ্জ ঘাট, তেল ঘাট, কোন্ডা ঘাটসহ ১০ থেকে ১৫টি ঘাটের নৌকা সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। ফলে ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়েন।

সদরঘাটের এক পোশাক ব্যবসায়ী বলেন, আমরা তো কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত নই। ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে যেতে পারছি না। নৌকার এক মাঝি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কেরাণীগঞ্জের নেতাদের নির্দেশনায় শত শত নৌকা বন্ধ রয়েছে। আমার একদিনে যে আয় হতো তা এখন কে দেবে। আমরা শুধু বলির পাঠা হচ্ছি। আমাদের দেখার কেউ নেই। নৌকা বন্ধ থাকায় মাঝিরা হতাশা প্রকাশ করেন। আয়বঞ্চিত হওয়ায় তাদের অনেকে ক্ষুব্ধ।

এদিকে, বিএনপির গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে ঢাকার প্রধান প্রবেশপথ আবদুল্লাহপুরে পুলিশের তল্লাশি চলে। পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মীদের মোটরসাইকেল মহড়া এবং প্রতিবাদ সভাও হয়। পুলিশ সূত্রমতে, সমাবেশকে কেন্দ্র করে সন্দেহভাজন হিসেবে গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ১০৩ জনকে লোকজন আটক করা হয়েছে। এর মধ্যে উত্তরা বিভাগের বিমানবন্দর থানায় ৩১ জন, উত্তরা পূর্ব থানায় ৩০, দক্ষিণখান থানায় ২ ও উত্তরখান থানায় ৪০ জনকে আটক করা হয়।

অন্যদিকে, গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে সকাল থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতির লাইফলাইনখ্যাত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জ অংশে দূরপাল্লার যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে। পাশাপাশি আঞ্চলিক যানবাহনগুলো মহাসড়কে কম চলাচল করতে দেখা যায়। ফলে জরুরি কাজে রাস্তায় বের হওয়া লোকজনকে পড়তে হয় চরম ভোগান্তিতে। তবে বেলার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মহাসড়ক প্রায় যানবাহনশূন্য হয়ে যায়। একই সঙ্গে যাত্রীদের আনাগোনাও কমে যায়। গতকাল দুপুরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল, মৌচাক, সাইনবোর্ড পয়েন্টে সরেজমিনে এমন চিত্রই দেখা গেছে। তবে বিকেলের দিকে যানবাহনের চাপ বেড়ে যায়।

তবে পুলিশি তল্লাশির মধ্যেই গতকাল বিকেল পৌনে তিনটার দিকে রাজধানীর কমলাপুরে ফুটওভার ব্রিজের নিচে মুগদা হাসপাতালের পাশে দুটি মোটরসাইকেলে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

এদিকে যেকোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি ঠেকাতে রাজধানী জুড়ে প্রায় ৩০ হাজার পুলিশ সদস্য, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) ও আনসার সদস্য মোতায়েন করা হয়। ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দাপ্রধান হারুন-অর-রশীদ সাংবাদিকদের বলেছেন, গোলাপবাগের বিভাগীয় সমাবেশ ঘিরে ঢাকায় নাশকতার কোনো আশঙ্কা নেই। তবু জননিরাপত্তার স্বার্থে শহরজুড়ে ২০ হাজার পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।

ডিবিপ্রধান বলেন, ঢাকা শহরে কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলা নেই। বিএনপির লোকজন শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশে যেতে পারছে। নিরাপত্তায় প্রচুর পুলিশ কাজ করছে। ঢাকা শহরের প্রতিটি এলাকায় পুলিশ ঘোরাঘুরি করছে। কোথাও কোনো ঝামেলা নেই। মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে চলাফেরা করছে। বিএনপির যে মিছিল যাওয়ার কথা, সেটিও ভালোভাবে মাঠে গেছে। কোথাও কোনো ঝামেলা নাই। যানজট নাই।

নিরাপত্তার কারণে বিএনপির প্রধান কার্যালয়ের স্থান নয়াপল্টনে সড়ক বন্ধ রাখা হয়েছে। এ ব্যাপারে ডিবিপ্রধান বলেন, সমাবেশটি হচ্ছে গোলাপবাগ মাঠে, আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করছে। আমাদের সামনে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অনেক স্থাপনা আছে তাই। তবে আপনারা যেতে পারবেন। আমাদের কাজটি হচ্ছে তাদের সমাবেশটা সুন্দর করার জন্য যা যা নিরাপত্তা দেওয়া দরকার, শান্তিপূর্ণ করার জন্য সেটা আমরা করছি।

হারুন-অর-রশীদ বলেন, জনসমাবেশের জন্য ২০ হাজারের বেশি পুলিশ কাজ করছে। শুধু নিরাপত্তার জন্য। কোথাও যানজট-বিশৃঙ্খলা নাই। যানবাহনের সংখ্যা কমের যাওয়া বিষয়ে ডিবিপ্রধান বলেন, শনিবার মানুষ চলাচল কম করে। বিএনপির পার্টি অফিসের সামনে যে ঘটনা ঘটছে, যে উত্তেজনা ছিল, তার মানে যাদের কাজ কাম নেই তারা বের হয় নাই।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন