মঙ্গলবার, ১৭ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২রা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শঙ্কার মধ্যেও সম্ভাবনা

শঙ্কার-মধ্যেও-সম্ভাবনা

চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত দক্ষিণ কোরিয়ায় ৪ হাজারের বেশি কর্মী পাঠানোর রেকর্ড করেছে বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেড (বিওইএসএল)। এসব কর্মী পাঠানো হয় কোরিয়ান এমপ্লয়মেন্ট পারমিট সিস্টেম (ইপিএস) এর আওতায়। এতে করে তারা উচ্চ বেতন, শ্রম অধিকারসহ অন্যান্য সুবিধা পাবে। আর ইউরোপীয় গন্তব্যগুলির মধ্যে– ইতালি চলতি বছরে ৫ হাজারের বেশি বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ দিয়েছে। সরকারি তথ্যানুসারে, ১৯৭৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিদেশে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ বাংলাদেশির। যদিও এখনও আন্তর্জাতিক জনশক্তি বাজারে বাংলাদেশ স্বল্প-দক্ষ (বা অদক্ষ) কর্মী উৎস হিসেবেই পরিচিত।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে যাওয়া বেশিরভাগ কর্মী অদক্ষ ও স্বল্প-দক্ষতার হওয়ায়–মানসম্পন্ন জনশক্তি রপ্তানি এখনও নিশ্চিত করা যায়নি। রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট (রামরু)-র তথ্যমতে, ২০২১ সালে বিদেশে যাওয়া ৭৪ শতাংশ শ্রমিকই ছিল অদক্ষ। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের খুব সীমিত সংখ্যক কর্মী দক্ষ এবং প্রবাসে ভালো চাকরি করে। এরা মোট প্রবাসী কর্মীর মাত্র ১০ শতাংশ। অন্যদিকে, বাকি ৯০ শতাংশই হলেন শ্রমিক। দক্ষ কর্মী পাঠানো গেলে রেমিট্যান্সও বাড়তো।

সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেছেন, প্রবাসী শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া মানেই অদক্ষ শ্রমিক পাঠানো নিরুৎসাহিত করা নয়। কারণ অদক্ষ কর্মীদের মাধ্যমে তুলনামূলক বেশি আয় দেশে আসে। তবে অনেক প্রবাসী কর্মী অনানুষ্ঠানিক চ্যানেল বা হুন্ডির মাধ্যমে আয় পাঠানোর দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ায়– বাংলাদেশমুখী প্রবাসী আয় প্রবাহ (আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে) ব্যাপকভাবে কমেছে।

আরও পড়ুনঃ  যতদিন বেঁচে আছি যেন সম্মানের সাথে বাঁচতে পারি: প্রধানমন্ত্রী

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদেশি বিভিন্ন সংস্থায় চাকরি করা দক্ষ কর্মীরা আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠালে– প্রতি ডলারের বিনিময় দর ১০৭ টাকা পান। অন্যদিকে, অদক্ষ শ্রমিকরা যাদের বেতন হয় ব্যাংকের চেকে, পান মাত্র ৯৯ টাকা। গত নভেম্বরে প্রবাসী বাংলাদেশিরা আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে ১৫৫ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। যা আগের মাসের চেয়ে কমেছে ৫.৪৮ শতাংশ। বছরওয়ারি হিসাবে এই পতন ২৬ শতাংশ।

জনশক্তি রপ্তানি সংশ্লিষ্টরারা বলছেন, বিশ্ব অর্থনীতির মন্দাবস্থায় বাংলাদেশমুখী রেমিট্যান্স প্রবাহ কমলেও– চলতি বছর বৈদেশিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি– সাম্প্রতিক রেকর্ডগুলো ভেঙে নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। এই প্রবণতার জন্য তারা মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার পুনরায় চালু হওয়া এবং জ্বালানি তেলের চড়া দামের সুবাদে মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতিগুলো চাঙ্গা থাকার কথা বলছেন। এছাড়া, করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় কর্মীরা কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে যেতে পারছেন।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যমতে, চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত বিদেশে গিয়েছেন ১০.২৪ লাখ বাংলাদেশি কর্মী। ২০২২ সালে প্রতি মাসে গড়ে ৯৩ হাজার কর্মী বিদেশে গেছেন। করোনা মহামারির আগের সময়ে মাসিক গড় ছিল প্রায় ৬০-৭০ হাজার। বিএমইটি মহাপরিচালক জানান, শুধু নভেম্বরেই ৭৬ হাজারের বেশি কর্মী বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি করা হয়েছে। ঊর্ধ্বমুখী এই ধারা অব্যাহত থাকলে, ডিসেম্বর শেষে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ১১ লাখে পৌঁছানোর রেকর্ড করবে।

এদিকে, সৌদি প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগের কোটা ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪০ শতাংশ করার ঘটনায় জনশক্তি রপ্তানির রেকর্ড প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখছে। এর আগে ২০১৭ সালে বার্ষিক ১০ লাখ ছাড়িয়ে যায় বৈদেশিক কর্মসংস্থান। কিন্তু, পরের বছরগুলিতে তা পতনের দিকে যেতে থাকে। আর ২০২০ সালে মহামারিজনিত বিধিনিষেধের ফলে তা কমে দাঁড়ায় মাত্র ২.১৭ লাখে।

আরও পড়ুনঃ  সাধারণ ছুটির আওতায় থাকবে কেবল রেড জোন

প্রবাসী বাংলাদেশিদের শীর্ষ গন্তব্য সৌদি আরব, অক্টোবরে মোট বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ৫৭ শতাংশ হয়েছে সৌদিতে। এরপর ছিল ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর, কাতার, কুয়েত, মালয়েশিয়া ও জর্ডান। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অভ ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) কর্মকর্তারা বলছেন, কোভিডের পর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় শ্রমিক চাহিদা বাড়ায়– বাংলাদেশ থেকে রেকর্ড সংখ্যক কর্মী পাঠানো সম্ভব হচ্ছে। তাছাড়া, মালয়েশিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতেও নতুন কর্মীরা যাচ্ছে।

যদিও মালয়েশিয়ায় এখনও প্রত্যাশিত সংখ্যায় কর্মী পাঠানো যাচ্ছে না। গত ছয় মাসে মালয়েশিয়ায় আমরা দুই লাখের বেশি কর্মী পাঠানোর কথা ছিল। তবে এপর্যন্ত গেছে মাত্র ২৫ হাজার। দেশটিতে কর্মী পাঠানোর দায়িত্ব পাওয়া ২৫ সংস্থা যথাযথভাবে কাজ করতে পারছে না। অন্যদিকে, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতেও আমাদের দক্ষ শ্রমিক পাঠানোর দিকে মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে না।

রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকরা বলছেন, সৌদি আরব ও ওমানে বেশিরভাগ শ্রমিক গেছে পরিচ্ছন্নতা কর্মী, নির্মাণ কর্মী ও গৃহস্থালি কর্মী হিসেবে, তাদের মাসিক বেতন ২৫-৩০ হাজার টাকা। এছাড়া, সংযুক্ত আরব আমিরাতে অনেকে নিরাপত্তা রক্ষী ও ড্রাইভার হিসেবে গেছে, তাদের মাসিক বেতন ৩৫-৪০ হাজার টাকা। এছাড়া কিছু দক্ষ ও আধা-দক্ষ কর্মী বিভিন্ন দেশে প্লাম্বার এবং রেফ্রিজারেটর ও এয়ার কন্ডিশনারের ইলেকট্রিশিয়ান বা টেকনিশিয়ান হিসেবে গেছে।

আনন্দবাজার/শহক

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন