শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শ্রমশোষণে নারী নিপীড়ন

শ্রমশোষণে নারী নিপীড়ন

এইচএসসির ফরম পূরণের সময় অনিমা ওরাঁওয়ের পরিবারে নগদ অর্থকড়ি ছিল না। অনিমার মা অঞ্জনা ওরাঁও দিনমজুরি করে যা আয় করেন তাতে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকাই কঠিন। সেই অভাবের সংসারে অনিমার মা ফরম পূরণের টাকার যোগান দিতে ব্যর্থ হন। কিন্তু লেখা-পড়ার প্রতি অনিমার ঝোক ছিল প্রবল। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি আর মেয়ের লেখাপড়ার খরচ যোগাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে তাকে। নিজের ফরম পূরণের টাকা যোগাতে অনিমা অগ্রিম শ্রম বিক্রি করেন। গ্রাম্য মহাজনের কাছ থেকে অর্ধেক মজুরিতে অগ্রিম শ্রম বিক্রি করে, সেই টাকাতেই অনিমার ফরম পূরণ হয়।

এসএসসিতে অনিমা বেশ ভালো ফলাফল করেছে। কলেজে ভর্তির আগে মহাজনের সেই টাকা পরিশোধে অনিমা কৃষি জমিতে কাজ করছেন। তবে অনিমা বলছিলেন-অভাবে পড়ে তিন মাস আগে ২শ টাকা মজুরিতে অগ্রিম শ্রম বিক্রি করতে হয়েছিল। সময় মতো শ্রম বিক্রি করলে মজুরি হতো ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। সেটাও পুরুষের তুলনায় অপ্রতুল।

অনিমা আক্ষেপ করে বলেন, একই সমান কাজ করে পুরুষ শ্রমিকরা ৩শ থেকে ৪শ টাকা মজুরি পেয়ে থাকেন। তাদের ক্ষেত্রে একই কাজ করে মজুরি হয় অর্ধেক। বেঁচে থাকার আকুতি জানিয়ে অনিমা তথাকথিত এই বৈষম্যপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন দাবি করেন।

ঘরে বাইরে সামাল দিয়েই একজন নারীকে এগিয়ে যেতে হয় প্রতিনিয়ত। এরপরও নারীকে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হয় প্রতিটি ধাপে। ঘরের কাজে যেমন স্বীকৃতি নেই, তেমনি বাইরের কাজেও দেওয়া হচ্ছে কম মজুরি। মুখে সমাজ সমান অধিকারের কথা বললেও সমধিকার পাচ্ছেন না নারীরা। বেশির ভাগ নারী কৃষি কাজে নিয়োজিত।

আরও পড়ুনঃ  উচ্চশুল্কে লাভজনক মদ!

নাটোরের চলনবিলাঞ্চলের বিভিন্ন মাঠে ও বাসাবাড়িতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় পুরুষের চেয়ে নারী শ্রমিকরাই বেশি মজুরি বৈষম্যে শিকার। নারী শ্রমিকরা জানান, কর্মক্ষেত্রে মজুরির বৈষম্য জেনেও জীবিকার তাগিদে তারা কাজ করে যাচ্ছেন। তবে পুরুষ শ্রমিকের সঙ্গে সমান তালে কাজ করলেও কখনও কখনও পুরুষ সহকর্মী কিংবা মালিক পক্ষের হাতে লাঞ্ছনায় শিকার হতে হয় তাদের। এমনকি অনেক সময় নারী বলে কাজে নিতেও আপত্তি জানান মালিক পক্ষ।

কাজের ধরন ও সময় অনুসারে মজুরি নির্ধারণ করা হলেও নারীরা প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে পুরুষ শ্রমিকের অর্ধেক কিংবা তার চেয়েও কম মজুরী পান। পুরুষ শ্রমিক দৈনিক ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা মজুরী পেলেও নারী শ্রমিককে দেওয়া হয় ১৫০থেকে ২৫০ টাকা। শুধু কর্মক্ষেত্রে নয়,অনেক ক্ষেত্রে ঘরেও বঞ্চনায় শিকার হন তারা। তারা সরকার এবং দেশের সচেতন মহলের কাছে এই বৈষম্যের প্রতিকার চান।

চলনবিল এলাকায় অনেক নারী শ্রমিককে দেখা যায়। কেউ রসুনের জমিতে আগাছা পরিষ্কার করছে কেউ বা আবার ধানের জমি পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছে। মজুরি কত পান জানতে চাইলে আমেনা, রাজিয়া, মনিষাসহ কয়েক জন নারী শ্রমিক জানান, মজুরি পাই ১৫০ টাকা থেকে ২৫০ টাকা। কিন্তু পুরুষদের দেওয়া হয় দিগুনেরও বেশি মজুরি। কাজ একই রকম করলেও নারী বলেই কম মজুরি পাবো এটা ঠিক না। তারা আরও বলেন, সংসারের যাবতীয় কাজ ছাড়াও পুরুষের সাথে পাল্লা দিয়ে কাজ করি মাঠে ঘাটে সর্বত্র।

চলনবিলে কাজ করতে আসা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারী শ্রমিক শ্যামলী রানী ও কুমারী আল্পনা রানী জানায়, সকাল থেকে ৪টা পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন শ্রম দিয়ে তারা নামমাত্র মজুরি পাচ্ছেন। তাতে কোনো রকমে বেঁচে রয়েছেন তারা।

আরও পড়ুনঃ  সংশোধন করা হয়েছে ‘শেখ হাসিনা তাঁতপল্লী স্থাপন’ প্রকল্প

গুরুদাসপুরের চাপিলা ইউনিয়নের আদিবাসী সুমতী মাহাতো জানান, বছরের অধিকাংশ সময়ই তাদেও হাতে কোনো কাজ থাকে না। ওই সময়গুলোতে অর্থ সংকটে পড়ে অল্প দামে অগ্রিম শ্রমও বিক্রি করতে হয়। কখনো বাা চড়া সুদে টাকা নিয়ে সংসার চালাতে গিয়ে অনেকেই ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ক্ষুদ্র ন-ৃগোষ্ঠীর ওই দলের অনিমা ওঁড়াও ও রুপালী কেরকাটা জানায়, দ্রব্যমুল্যের দাম যে হারে বাড়ছে তার তুলনায় আমাদের এই মজুরিতে সংসার চলে না। তাই মজুরী বৈষম্য থেকে মুক্তি চান তারা।

নাটোরের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক মো. আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, কৃষি কাজে নিয়োজিত নারী-পুরুষের মজুরি বৈষম্য নিরসনে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। সেই সাথে শ্রম আইন মেনে নারী শ্রমিকদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্বীকৃতি দিলে সমাজে সচেতনতা বৃদ্ধি পেলে নারীদের মজুরি বৈষম্য কমে আসবে। দেশও হবে স্বনির্ভর।

আনন্দবাজার/শহক

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন