- বর্ষণে কয়রার বাঁধে ধস
- জলোচ্ছ্বাসে নোনা পানিতে প্লাবিত হওয়ার শঙ্কা
উপকূলের দিকে ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’। গতকাল সোমবার মধ্যরাত থেকে দক্ষিণ উপকূলীয় জেলা খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটে হালকা বৃষ্টিপাত শুরু হলেও দুপুরের পর থেকে মুষলধারায় রূপ নেয়। বাতাসের গতিবেগও সমানতালে বাড়ছে। নদীর পানিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে চরম আতঙ্কে রয়েছে উপকূলের জনপদ। তবে ঝড়ের চেয়েও নদী ভাঙনের আতঙ্ক বেশি বিরাজ করেছে মানুষের মধ্যে। বিশেষ করে খুলনার কয়রা, পাইকগাছা, দাকোপ, সাতক্ষীরার আশাশুনি ও শ্যামনগরের বেশ কিছু স্থানে নদীর বাঁধ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ থাকায় ভেঙে নোনা পানিতে প্লাবিত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
এদিকে, প্রাকৃতিক দুর্যোগে বার বার বিধ্বস্ত খুলনার কয়রা উপজেলার হরিণখোলা ও গাতিরঘেরী নামক স্থানে সোমবার ভোরে বাঁধে ভাঙন দেখা দিলেও সংস্কারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোনো ভূমিকা দেখা যায়নি। স্থানীয়রা স্বেচ্ছাসেবার মাধ্যমে সেখানে কিছুটা সংস্কার করলেও ঝুঁকি কাটেনি। খুলনার কয়রা, সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড -২ এর আওতায়। বাঁধ ও পানি বৃদ্ধির বিষয় জানতে সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী শাহনেওয়াজ তালুকদারকে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় মিডিয়ার কারো ফোনই তিনি ২ দিন ধরে রিসিভ করছেন না।
বন্ধ রয়েছে মোংলা বন্দরে পণ্য ওঠানামার কাজ। ঝড়ের কারণে গাড়িসহ পাঁচটি বাণিজ্যিক জাহাজ এই বন্দরে ঢুকতে পারেনি। এছাড়া পণ্য খালাস শেষ হওয়ার পরও তিনটি জাহাজ বন্দর ত্যাগ করতে পারেনি। চরম আতংকে রয়েছে মোংলাসহ সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষ। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১০৩টি সাইক্লোন শেল্টার প্রস্তত রাখা হয়েছে।
সোমবার সকালে কয়রার কপোতাক্ষ নদের পাড়ের গোবিন্দপুর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, নদীর চরে একটি খুপড়ির মধ্যে ছেলেকে নিয়ে গৃহবধূ বেবি খাতুন বসে আছেন। তিনি বলেন, স্বামী সুন্দরবনে কাঁকড়া ধরতে গেছে এক সপ্তাহ আগে। এখন কোথায় আছে জানেন না তিনি। মোবাইলে কল ঢুকছে না। তিনি জানান, ঝড়ের কথা শুনলে গা শিউরে ওঠে। ঝড় ঝাপটাতে নদীর তীরে অবস্থান করতে হয়। যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। বেশি সমস্যা হলে পাশের স্কুলে যেয়ে থাকেন। সেখানে আরও ৩/৪ টি পরিবারের দেখা মেলে।
পরে বেলা ২টার দিকে মদিনাবাদ লঞ্চঘাট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, নদীর চরে ৮/১০টি পরিবার বসবাস করছে। কথা হয় ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা জরিনার সাথে। তিনি জানান, ৩০ বছর যাবৎ সেখানে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন। ভয় হয় তবুও যাওয়ার জায়গা নেই। ঝড়ের খবর আসলে রাতে ঘুম হয় না। জোয়ারের পানি বৃদ্ধি হলে রাস্তার ওপর থাকেন, পানি নেমে গেলে আবার ঘরে ফিরে আসেন। সাইক্লোন শেল্টার দূরে থাকায় বাড়ি ফেলে রেখে সেখানে যান না। তিনি আরও জানান, তার কোনো ছেলে নেই। একমাত্র মেয়ে রেখে স্বামী মারা যায়। সেখান থেকে নদীতে জাল ধরাসহ নানা কাজ করে মেয়েকে বড় করেছেন। এখন মেয়ে-জামায়ের সংসারে থাকেন। ৬ সদস্যের পরিবার। মেয়ে নদীতে জাল টেনে পোনা সংগ্রহ করে ও জামাই নৌকা তৈরির কারিগর। খেজুরডাঙ্গ এলাকার নূরুল ইসলাম বলেন, ‘চরম আতঙ্কের মধ্যে আছি। সত্যি সত্যি যদি ঘূর্ণিঝড় হয় আর বাঁধ ভেঙে যায় তবে পুরো এলাকা লবণপানিতে তলিয়ে যাবে। গেল বছরও সব ভেসে গিয়েছিল।
এছাড়া, শ্যামনগরের দাতিনাখালী, পশ্চিম কৈখালীসহ জেলেখালী, নেবুবুনিয়া, পদ্মপুকুর ও গাবুরার অন্তত চারটি পয়েন্টের বাঁধ অত্যান্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এছাড়া আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের কুড়িকাউনিয়া, নাকনা, রুয়েরবিল, চুইবাড়িয়া, দৃষ্টিনন্দন ক্লোজার, হরিষখালী ও কামারখালী, আনুলিয়া ইউনিয়নের বিছট, নয়াখালী, কাকবসিয়ার দু’টি পয়েন্ট, মনিপুর, দক্ষিন একসরা ও নাংলা, শ্রীউলা ইউনিয়নের কোলা ও হাজরাখালী, খাজরা ইউনিয়নের গদাইপুর ও খাজরা ইউনিয়ন পরিষদের সামনে, বড়দল ইউনিয়নের কেয়ারগাতি এবং আশাশুনি সদরের বেশ কয়েকটি স্থানে বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ভাঙনকবলিত এসব এলাকা গুলো কপোতাক্ষ নদ ও খোলপেটুয়া নদী দ্বারা বেষ্টিত। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে এসব নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঝুকিপূর্ণ বাঁধ ভেঙে অথবা ছাপিয়ে এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়বে।
ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে শুরু হওয়া ভারী বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে খুলনা নগরীর নিম্নাঞ্চল। বাসাবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পানি প্রবেশ করায় দুর্ভোগে পড়েন মানুষ। জরুরী প্রয়োজনে যারা বাইরে বের হচ্ছেন, পড়ছেন বিপাকে। পরিবহন না পেয়ে বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি ও কর্মস্থলে যেতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। খুলনা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আমিরুল আজাদ জানান, সোমবার ভোর ৬টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত ১২২ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে।
খুলনা শহরের অধিকাংশ সড়কই পানির নিচে। বৃষ্টিতে খুলনা নগরীর শান্তিধাম মোড়, বাইতিপাড়া, লবণচরা, হরিণটানা, টুটপাড়া, পূর্ ও পশ্চিম বানিয়া খামার, চানমারী, মোল্লাপাড়া, বাস্তুহারা কলোনীসহ বিভিন্ন এলাকার বাসাবাড়ি এবং সড়কের পাশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পানির নিচে। পূর্ব বানিয়াখামারের জাহিদুল ইসলাম সাগর জানান, বৃষ্টিতে পানির রাইস মিল পানিতে তলিয়ে যায়। মিলের মধ্যে রাখা চাল ভিজে গেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, কয়রা উপজেলায় পাউবোর ১৫৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ২১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ এবং ১২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে বাড়লে এ সব বেড়িবাঁধ ভেঙে এলাকায় লবণাক্ত পানি প্রবেশ করতে পারে।
কয়রা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাসানুল বান্না জানান, সোমবার ভোর থেকে কয়রায় ৩০/৩৫ কিলোমিটার বেগে বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। মূল আঘাতের সময় বাতাসের গতিবেগ বৃদ্ধি পেয়ে ৯০/১০০ কিলোমিটার হতে পারে। তিনি আরও বলেন, বিদ্যুৎ না থাকায় রিপোর্ট প্রদানে সমস্যা হচ্ছে।
খুলনার কয়রা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এসএম শফিকুল ইসলাম বলেন, কয়রার হরিণখোলা ও গাতিরঘেরীর বাঁধে ভাঙন দেখা দেয়। স্থানীরা কিছুটা মেরামত করলেও ঝুঁকি রয়েছে। এছাড়া কয়রায় হোগলা, দোশহালিয়া, মদিনাবাদ লঞ্চঘাট, ঘাটাখালী, গাববুনিয়ার, আংটিহারা, ৪নং কয়রা সুতির গেট ও মঠবাড়ির পবনা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে বাড়লে এ সব বেড়িবাঁধ ভেঙে এলাকায় লবণাক্ত পানি প্রবেশ করতে পারে। প্রত্যেক ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের বলা হয়েছে স্ব স্ব এলাকার বাঁধের দিকে খেয়াল রাখার জন্য। সাইক্লোন শেল্টারগুলো প্রস্তুত রাখাসহ ১২টি মেডিকেল টিম গঠন, উদ্ধার টিম, শুকনো খাদ্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। মানুষকে সতর্ক করতে মাইকিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
কয়রা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রোকুনুজ্জামান বলেন, উপজেলা প্রশাসন ও সিপিপিসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবকেরা ঘূর্ণিঝড়ের বিষয়ে সতর্কতামূলক প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। কয়রা উপজেলাজুড়ে ১১৬টি আশ্রয়কেন্দ্রসহ বিভিন্ন বিদ্যালয় ভবন, পাকা ও নিরাপদ স্থাপনা প্রস্তুত রাখা হয়েছে আশ্রয়ের জন্য। নিরাপদ পানি ও খাদ্য মজুত করা হয়েছে। মানুষজন আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য মাইকিং করা হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা যায়, খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলায় বেড়িবাঁধ রয়েছে মোট ১ হাজার ৯১০ কিলোমিটার। ষাটের দশকে মাটি দিয়ে তৈরি এই বেড়িবাঁধ ছিল ১৪ ফুট উঁচু ও ১৪ ফুট চওড়া। এখন এই ২৪০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের উচ্চতা ও চওড়ার অর্ধেকও অবশিষ্ট নেই। তবে স্থানীয়দের ভাষ্য ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধের পরিমাপ আরও বেশি। এছাড়া কয়রা উপজেলায় পাউবোর ১৫৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ২১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ এবং ১২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ অধিক ঝুঁকিপূর্ণ।
এদিকে, প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাণহানি এড়াতে খুলনা জেলার ৪০৯টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। তবে সরেজমিন গতকাল সোমবার দুপুর ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত কয়রা উপজেলার ৫টি আশ্রয় কেন্দ্রে পরিদর্শন করে ৪টি বন্ধ পাওয়া যায়। দেয়াড়া পশ্চিমপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাসুদ বলেন, খুলে রাখার বিষয়ে প্রশাসন থেকে কোন নির্দেশনা দেয়া হয়নি। এছাড়া শিমলার আইট আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয়, খেজুরডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয় ও গাজী আব্দুল জব্বার মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র বন্ধ পাওয়া যায়। ফুলতলা প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা থাকলেও শৌচাগার বন্ধ তালাবদ্ধ দেখা যায়।
খুলনার জেলা প্রশাসক মো. মনিরুজ্জামান তালুকদার বলেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের বিশেষ কয়রা, পাইকগাছা ও দাকোপের কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। যারা ঝুঁকির মধ্যে আছে, তাদের যাতে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া যায়-সেজন্য সবাইকে সতর্ক থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, গেল বছর ইয়াসের খুলনার কয়রায় নদীর বাঁধের ১১ স্থান ভেঙে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনিতেও বাঁধ ভেঙে পানিতে প্লাবিত হয়। ২০২০ সালের ২০ মে সুপার সাইক্লোন আম্ফানের আঘাতে খুলনার কয়রা, পাইকগাছা, সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলা এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলা নামক দুর্যোগে খুলনা জেলার দাকোপে ৬৫ জন মৃত্যুবরণ করে। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সিডরে বাগেরহাটের শরণখোলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। খুলনার কয়রা, পাইকগাছা, দাকোপ ও বটিয়াঘাটা উপজেলাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।