শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
পুকুর-জলাশয় ভরাট----

ধ্বংসের মুখে জীববৈচিত্র্য

ধ্বংসের মুখে জীববৈচিত্র্য

পুকুর শূণ্য হতে চলেছে শেরপুর শহর। দেড়শ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী শেরপুর পৌরসভার পুকুর ও জলাশয় ভরাটে ভারসাম্য হারাচ্ছে পরিবেশ। প্রতিদিন ভরাট হচ্ছে শেরপুরের কোনো না কোনো জলাধার, নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য। ভূ-উপরিভাগের সংরক্ষিত পানির পরিমাণ কমে যাওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। এতে বছর বছর বাড়াতে হচ্ছে নলকূপের পাইপ। অন্যদিকে বর্ষা মৌসুমে পৌর এলাকায় দেখা দিচ্ছে জলাবদ্ধতা। জনসংখ্যাা বৃদ্ধির ফলে মানুষের আবাসিক সমস্যার সমাধানে এবং চাহিদার কারণে শেরপুর পৌরসভার বেশির ভাগ পুকুর বিগত মাত্র ১৫ থেকে ২০ বছরের ব্যাবধানে ভরাট হয়ে গেছে। শেরপুরের ঐতিহ্যবাহী ওইসব পুকুর ও জলাশয় ভরাট করে শুধু আবাসিক বাসা-বাড়িই নির্মাণ হয়নি, নির্মাণ করা হয়েছে শেরপুর জেলার অনেক সরকারি ও বেসরকারি অফিস বা ভবন।

ইতিমধ্যে ভরাট হয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী পুকুর ও জলাশয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, শত বছরের পুরনো পদ্মা পুকুর, শ্যামা পুকুর, রবি নিয়োগীর পুকুর, কানু সেনের পুকুর, জুইত্যা মিয়ার পুকুর, মিয়া বাড়ির পুকুর, নিউমার্কেট পুকুর, এসআর পুকুর, বিপিন সাহার জলাশয়, ডনো খাল, আমনকূড়া বিল, মোল্লা পাড়া দীঘি, কাজি বাড়ি পুকুর, তালুকদার পুকুর ইত্যাদি।

ইতিমধ্যে যেসব পুকুর ও জলাশয় ভরাট করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বাসা-বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে সেসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, শেরপুর পৌরসভার পুকুর ভরাট করে নির্মিত হয়েছে পৌর সুপার মার্কেট, এসআর পুকুর ভরাট করে ‘জেলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিস ভবন, মাধবপুর মহল্লায় আকতার ডাক্তারের পুকুর ভরাট করে  মার্কেট ও পাশে  বহুতল বানিজ্যিক ও আবাসিক ভবন (সেনালি ব্যাংকের ট্রেজারি, আঞ্চলিক ও সাধারণ শাখা), খান বাহাদুরের পুকুর ভরাট করে নির্মাণ করা হয়েছে শেরপুর ডায়াবেটিক সমিতির হাসপাতাল, জেলা আইনজীবী সমিতির

আরও পড়ুনঃ  যুবকের লিভার খেয়ে ফেলল মাছ!

পুকুর ভরাট করে নির্মাণ করা হয়েছে কমিউনিটি সেন্টার, বটতলা পুকুর ভরাট করে শেরপুর পৌরসভার অফিস ভবন নির্মাণ করা  হয়েছে। এছাড়া  এক শ্রেনির জমি ব্যবাসায়ী শহরের বিভিন্ন আনাচে-কানাচে এবং শহরের আশপাশের আবাসিক এলাকায় পুকুর-ভাগাড় ও জলাশয় কমমূল্যে কিনে  তা ভরাট করে প্লট আকারে বিক্রি করছেন।

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা মিউনিসিপালটি হওয়ার ৫ বছর পর অর্থাৎ ১৮৬৯ সালে তৎকালীন বৃটিশ সরকার শেরপুর শহরকে মিউনিসিপালটি ঘোষণা করেন। এরপর পর্যায়ক্রমে তৃতীয় শ্রেণির পৌরসভা থেকে সর্বশেষ  প্রথম শ্রেণির পৌরসভার মর্যাদা পেয়েছে  শেরপুর পৌরসভা। দীর্ঘ  ১৫৩ বছরে শেরপুর শহর তথা শেরপুর পৌরসভার লোক সংখ্যা বেড়েছ কয়েক গুণ। কালের আবর্তে এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে শেরপুর শহরের উপর মানুষের বসতি এবং আবাসিক ও অনাবাসিক বাসা-বাড়ির ব্যাপক চাহিদা বেড়ে যায়। বিশেষ করে  শেরপুর জেলা রূপান্তরিত হওয়ার পর এখানে ব্যাপকভাবে বাড়তে থাকে বাসা-বাড়ি ও সরকারী বেসরকারি ভবন নির্মাণের চাপ। শহরের নির্ধরিত জমি কমে যাওয়ায় বাসাবাড়ি নির্মাণের চাপ পড়ে শহরের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি পুকুরের উপর। এতে, ওইসব পুকুর ভরাট করে তৈরি করা হচ্ছে আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনসহ সরকারি ও আধা-সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং ভবন।

শেরপুর পৌর এলাকায় পকুরের সংখ্যার কোন পরিসংখান না থাকলেও শহরের বয়োবৃদ্ধ লোকদের মুখ থেকে জানা গেছে, ১৫৩ বছরের পুরনো শেরপুর শহর এলাকাতেই এক সময় শতাধিক পুকুর ছিল। বর্তমানে ওইসব পুকুরের বেশির ভাগই ভরাট হয়ে গেছে।

জেলার ইতিহাসবিদদের সূত্রে জানা গেছে, ৩ থেকে ৪ শ বছর আগে শেরপুর এলাকা ছিল খুবই নিচু। পরবর্তিতে এখানে জমিদারদের আগমন ঘটলে তারা তাদের রাজ প্রাসাদ ও তাদের উজির-নাজিরদের বাসা-বাড়ি তৈরির জন্য অসংখ্য পুকুর খনন করে ওই মাটি দিয়ে এখানকার নিচু এলাকা ভারাট করে তাতে প্রাসাদ ও বাসা-বাড়ি নির্মাণ করেন। ওইসময় অনেক পুকুরের নাম করণও করা হয় বিভিন্ন জমিদারের রানিদের নামে। যেমন, পদ্ম পুকুর, শ্যামা পুকুর ইত্যাদি।

আরও পড়ুনঃ  নগরকৃষির ব্যতিক্রমী পরিসেবা আনছে এসিআই

বর্তমানে ওইসব পুকুরের কোন অস্তিত্ব নেই। শেরপুর পৌর শহরে যেভাবে পুকুর ভরাটের হিড়িক লেগেছে তাতে আগামী ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে পুকুর ও জলাশয় বিলুপ্ত হয়ে যাবে বলে ধারনা করছে জেলার সচেতন মহল। তখন কেবল ভবিষ্যত প্রজন্ম ইতিহাসের পাতায় শেরপুর শহরের ঐতিহাসিক পুকুরের গল্প শোনা ছাড়া বাস্তবে পুকুর দেখতে পারবে না।  এদিকে ওইসব পুকুর ও জলাশয় ভরাটের কারণে শহরে মাছ উৎপাদনের পরিমাণ কমে গেছে। এছাড়া অপরিকল্পিতভাবে বাসা-বাড়ি ও বহুতল ভবন নির্মাণের কারণে বর্ষায় শহরের জলাবদ্ধতা বেড়ে যাচ্ছে। পানির উৎস কমে যাওয়ায় শহরের বাসা-বাড়িতে অগ্নিদুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণের কাজে ফায়ার সার্ভিস বাহিনীর বেগ পেতে হচ্ছে।

ইতিমধ্যে গত কয়েক বছরে শহরে আগুন নেভাতে গিয়ে পুকুর সংকটের কারণে হিমসিম খেয়েছে ফায়ার সার্ভিস বাহিনী। এসময় দুর থেকে পানি এনে আগুন নেভাতে গিয়ে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমানও বেড়ে যায়।

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন