মঙ্গলবার, ১৭ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২রা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নব্য কাবুলিওয়ালার দাপট

নব্য কাবুলিওয়ালার দাপট

বগুড়ায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছে দাদন ব্যবসায়ীরা। বিনা লোকসানে এ ব্যবসা করে রাতারাতি কোটিপতি বনে যেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে গ্রামগঞ্জের কিছু অসাধু প্রকৃতির মানুষ। কোনোরূপ নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করেই নিজের খেয়াল খুশি মতো উচ্চমাত্রার লাভে সুদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। শুধু তাই নয় সুদ গ্রহীতার কাছ থেকে ফাঁকা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর ও ফাঁকা চেক নিয়ে জিম্মি করছে তাদের। অনেক ক্ষেত্রে আসল ও কিছু সুদের টাকা পরিশোধ করলেও সুদের সুদ দিতে না পারলে ঐ দুই কাগজের বলে আইনের মার প্যাচে জেলে যেতে হচ্ছে অসহায় সুদ গ্রহিতাকে।

জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার পাড়ায় পাড়ায় চলছে সুদের ভয়াবহ আগ্রাসন। গুজিয়া, টেপাগারী,আলিয়ারহাট, দাড়িদহ, ভায়েরপুকুর, মোকামতলা, ভরিয়া, মালাহার, মুরাদপুর, রহবল, গাংনগর, বিহার, বড়িয়াহাটসহ বিভিন্ন এলাকায় দিন দিন সুদের ব্যবসা বেড়েই চলেছে। দৈনিক, সপ্তাহিক ও মাসিক হারে চলছে জমজমাট এ ব্যবসা।

ইতোপূর্বে উপজেলার অনেকেই সুদ মেটাতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন। সুদের টাকাকে কেন্দ্র করে খুন, অপহরণের মতো ঘটনাও ঘটেছে একাধিক। সুদখোরের লাথিতে অন্তঃসত্বা মায়ের গর্ভপাতের  ঘটনা ও সুদ গ্রহীতা ব্যক্তির জানাযা নামাজ আটকিয়ে সুদের দেন দরবার করার মতো অমানবিক কাজও ঘটেছে এর আগে।

সুদ গ্রহীতাদের বিভিন্নমুখী নির্যাতন ও সুদখোরদের এমন দৌড়াত্ব বন্ধে জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে প্রশাসন। তাদের দাবি সংবিধানে সুদখোরদের দৌরাত্ব বন্ধে কোন আইন না থাকলেও অভিযোগের ভিত্তিত্বে তারা ব্যবস্থা নিচ্ছেন।

সুদের ভয়াল ছোবলে নিঃস্ব হওয়া উপজেলার লস্করপুর গ্রামের মিজান মিয়া জানান, আমি বিপদে পরে এক সুদখোরের কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে ছিলাম। তারা আমার ব্যাংক চেক জমা ও সাদা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেয়। সেই টাকার ৫ গুণ লাভ দিয়েও ঋণের হাত থেকে রেহাই পাইনি। পরে সুদের টাকা শোধ করতে সমিতি থেকে কিস্তি তুলি। এভাবে দেনা বাড়তে বাড়তে  বাড়ির যায়গা পর্যন্ত বিক্রি করে এখন আমি নিঃস্ব।

আরও পড়ুনঃ  নিম্নমানের অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে

আমজানি গ্রামের ফজলার, কিচক মাঠিয়ান গ্রামের ইফসুফ, মোকামতলা চানপুর গ্রামের শিপন, টেপাগারী গ্রামের আব্দুল ওয়াহেদসহ অনেকেই জানান, সুদের টাকা দিতে দেরি হলে বিভিন্ন রকম হুমকি ধামকি ও অশ্লীল ভাষায় গালাগালিও করে সুদখোররা। প্রভাবশালী হওয়ায় ভয়ে প্রতিবাদও করা যায়না তাদের। সুদারুদের কাছে সর্বস্ব দিয়েও এর হাত থেকে রেহায় পাননি এসব মানুষ।

উপজেলার রহবল এলাকার পল্লী চিকিৎসক শ্রী মাধব চন্দ্র। মেয়ের বিয়ের সময় দেউলী এলাকার এক দাদন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে মাসে ২৫ হাজার টাকা সুদ দেয়ার শর্তে দুই লাখ টাকা নেয়। এজন্য দাদন ব্যবসায়ীকে দু’টি ব্যাংক চেক ও ফাঁকা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর দিতে হয়। ঋণের সেই টাকা শোধ করতে গত ২৪ মাসে প্রায় চার লাখ টাকা পরিশোধ করার পরও, বাকি সুদ ও আসল মিলে আরও চার লাখ টাকা দাবি করে মাধবকে হুমকি ও মারধর করা হয়েছিল। এ টাকা শোধ করতে গিয়ে দাদন ব্যবসায়ীদের (সুদারু) কাছে সুদে টাকা নিতে হয়েছে মাধবকে। চক্রবৃদ্ধিহারে সুদ দিতে দিতে ভিটে-মাটি বিক্রি করে তিনি এখন পথের ফকির। পালিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছিলেন তিনি। পরে পুলিশের হস্তক্ষেপে রক্ষা পায় মাধব।

শিবগঞ্জ উপজেলায় মাধবের মতো এমন অনেকেই আছেন, যারা দাদন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ঋণ নিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। তারপরও দাদনের টাকা পরিশোধ করতে পারেননি।

উপজেলার গাংনগর দাখিল মাদ্রাসার সুপার আব্দুল ওয়াহাব জানান, আমার প্রতিষ্ঠানের দু’জন শিক্ষক-কর্মচারী মোকামতলা এলাকার এক দাদন ব্যবসায়ীর কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছিল। পুরো চেক বইয়ের পাতা স্বাক্ষর করে দাদন ব্যবসায়ীকে দিতে বাধ্য হয়েছিল তারা। গত চার বছর ধরে বেতন তুলতে পারছিল না তারা। পরে ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির হস্তক্ষেপে তারা রক্ষা পায়।

আরও পড়ুনঃ  ট্রাক উল্টে কিশোর নিহত

এ ধরনের ভুক্তভোগীরা জানান, ঋণ নেওয়ার আগে দাদন ব্যবসায়ীর কাছে স্বাক্ষর করা চেক বা স্ট্যাম্প জমা রাখতে হয়। তারা চাকরি করলেও মাস শেষে ব্যাংক থেকে বেতনের টাকা তোলেন দাদন ব্যবসায়ীরা। ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে দাদন ব্যবসায়ীদের সুসম্পর্ক থাকায় তারা সহজে টাকা তুলে নিতে পারে।

এ প্রসঙ্গে দাদন ব্যবসায়ীরা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দাদন ব্যবসায়ী জানান, তারা দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংক থেকে সিসি লোন নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষকে আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে আসছেন। তার দাবি, ব্যাংক থেকেও তাদের সুদের হার কম।

এ প্রসঙ্গে শিবগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দীপক কুমার দাস দৈনিক আনন্দবাজারকে জানান, অসাধু সুদখোরদের ব্যাপারে অভিযোগ পাওয়া মাত্র আমরা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা থানায় লিখিত অভিযোগ কিংবা মামলা করতে রাজি হন না। এতে করে ঐ অসাধু দাদন ব্যবসায়ীরা পার পেয়ে যায়। তবে লিখিত অভিযোগ পেলে তাদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন