শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সিসাদূষণে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি

সিসাদূষণে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি
  • ধোঁয়ায় জটিল রোগে মানুষ
  • ফসলের ব্যাপক ক্ষতি
  • কারখানায় পোড়ানো হয় পুরাতন ব্যাটারি
  • ৬ গ্রামের মানুষের জীবন দুর্বিষহ

বগুড়ার শিবগঞ্জে আমতলী বাজারের অদুরে শহরতলী (শরতলা) মোকামতলা- জয়পুরহাট রাস্তার পার্শ্বে চার ফসলি কৃষিজমিতে অনুমোদনহীন কারখানা স্থাপন করে পুরাতন ব্যাটারি পুড়িয়ে অবৈধভাবে সিসা সংগ্রহ করছে। এ অবৈধ কারখানাটির কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে এলাকাবাসী। অনুমোদনহীন কারখানায় পুরাতন ব্যাটারি পুড়িয়ে সিসা সংগ্রহ থেকে সৃষ্ট ধোঁয়ায় কারখানাটির আশে-পাশে বিভিন্ন জটিল ও কঠিন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে লোকজন। পাশাপাশি মাঠের বিভিন্ন ফসলের ব্যাপক ক্ষতি সাধন হচ্ছে।

কারখানাটির সৃষ্ট ধোঁয়ায় পরিবেশের চরম বিপর্যয় দেখা দিয়েছে আশে-পাশের কয়েকটি গ্রামে। বিভিন্ন রকমের অজানা রোগ আতঙ্কে আছে এলাকাবাসী। স্থানীয় প্রভাবশালীদের ভয়ে এ বিষয়ে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করতে না পারলেও অন্তরে প্রতিবাদের ঝড় বইছে স্থানীয়ভাবে বসবাসকারি ও কৃষকদের। প্রতিরাতে ব্যাটারি পুড়িয়ে সিসা সংগ্রহের জন্য চুল্লির নির্গত বিষাক্ত ধোঁয়ায় অনেক স্থানে মানুষের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে। দুর্বিষহ হয়ে উঠছে আশপাশের প্রায় ৬ গ্রামের হাজার হাজার মানুষের জীবন-যাপন। ব্যাটারি পুড়িয়ে সিসা সংগ্রহের বিষাক্ত ধোঁয়ায় মাঠের ফসল ও গবাদি পশুর ও মানুষের ফুসফুস, ত্বকসহ অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের জটিলতাসহ ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে বলে জানান, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকে।

সরেজমিনে দেখা যায়, দুইপাশে টিনের তৈরি বেড়া, দুইপাশে প্লাস্টিকের বস্তা দিয়ে বেড়া তৈরী প্রায় ৩৫-৪০ শতাংশ জমির উপর নির্মিত অবৈধ কারখানা স্থাপন করে পুরাতন ব্যাটারি পুড়িয়ে সিসা সংগ্রহের কাজ চলছে। ২৫ থেকে ৩৫ বছরের ১০ থেকে ১৫ জন শ্রমিক প্রতিদিনের ন্যায় আনুমানিক রাত ৯টার পর থেকে কোনো প্রকারের নিরাপত্তা ছাড়াই আগুন জালিয়ে পুরাতন ব্যাটারি পোড়ানোর কাজে ব্যস্ত। প্রাথমিকভাবে জানা যায়, তাদের সকলের বাড়ি গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলায়। এ কারখানার মালিক তারেকের বাড়িও একই এলাকায়। প্রতিরাতে একাধিক চুল্লিতে পুরাতন ব্যাটারি পোড়ানো হয়। পুরাতন ব্যাটারি পুড়িয়ে সেই ব্যাটারি থেকে সিসা সংগ্রহ করা হয়। সেই সিসাকে গলিত অবস্থায় লোহার তৈরি কড়াইয়ে ঢেলে পাটা তৈরি করা হয়। তৈরিকৃত প্রতিটি পাটার ওজন প্রায় ৩০ থেকে ৩২ কেজি। যেখানে পুরাতন ব্যাটারি পুড়িয়ে প্রতিদিন প্রায় একশ থেকে দুইশত সীসার পাটা সংগ্রহ করা হয়।

আরও পড়ুনঃ  বাউফলের ইউএনও আর নেই

স্থানীয়দের অভিযোগ, পুরাতন ব্যাটারি পুড়িয়ে সীসা সংগ্রহের কাজ চলে সাধারণত আনুমানিক রাত ৯টার পর থেকে ফজরের আগ পর্যন্ত, কারখানার কাজ চালু করলেই বিষাক্ত কালো ধোঁয়া চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। শ্বাস-প্রশ্বাসে ভেসে আসছে ঝাঁঝালো গন্ধ। ফলে স্থানীয়দের শ্বাস-প্রশ্বাসে বেশ কষ্ট করতেই হচ্ছে। এসকল অসুবিধার কারণে দিনের আলোতে তারা পরিপূর্ণভাবে কাজ না করলেও রাতের আঁধারে প্রশাসন এবং এলাকার জনগনের চোখ ফাঁকি দিয়ে অবৈধভাবে বিদ্যুৎ সংযোগের আলোতে কাজ করছে।

এ সময়ে আশপাশের এলাকাগুলোতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ঝাঁঝালো দুর্গন্ধযুক্ত ধোঁয়া। এতে আশপাশের মানুষের রাত পার করতে হয় দুর্বিষহ অবস্থার মধ্য দিয়ে। বিষাক্ত ধোঁয়ার কারণে ওইসব স্থানের বহু পাখি ও কীটপতঙ্গ মারা যাচ্ছে।

এখন আর আগের মতো পশু-পাখিও দেখা যাচ্ছে না এলাকায়। অর্থাৎ এর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে প্রাণিকূল তথা জীব-বৈচিত্রের উপরও। অর্থাৎ ব্যাপক পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা দেখা দিচ্ছে। যেখানে ব্যাটারি পোড়ানো হয় সেখানকার আশপাশের জমির ফসল ও ঘাস বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে। এ ঘাস গবাদিপশুর পেটে গেলেও তাদের মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে প্রায় শতভাগ। অভিযোগ ওঠেছে, স্থানীয় প্রভাবশালী উথলী গ্রামের মৃত সায়েক আকন্দের ছেলে আজিজার রহমানের জমির উপর গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলার তারেক রহমান তার লোকজন দিয়ে এভাবে চুল্লি বানিয়ে পোড়াচ্ছে পুরাতন এবং পরিত্যাক্ত ব্যাটারি। সাধারণ মানুষ প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছে না। ব্যাটারি পুড়িয়ে সিসা সংগ্রহের ধোঁয়ার কারণে কলা ও মরিচ ক্ষেতসহ সকল ধরণের ফসলের ব্যাপক ক্ষতি সাধন হচ্ছে।

আরও পড়ুনঃ  নওগাঁয় ছাত্রীকে ধর্ষণচেষ্টার মামলায় মাদ্রাসা শিক্ষকের জেল—জরিমানা

নারায়নপুর গ্রামের শ্রী চিকেষ্ঠ ঠাকুর বলেন, রাতের বেলা প্রচণ্ড ঝাঁঝালো গন্ধের কারণে আমরা স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারি না। গরু-ছাগলেরও খুব সমস্যা হয়।

নারায়নপুর নাথপাড়া গ্রামের শ্রী যোগেশ নাথ  প্রতিবেদককে বলেন, গত কয়েক দিন থেকে রাতের বেলা খুব গন্ধ পাচ্ছি। ভেবেছিলাম হয়তো কেউ কাপড়ে আগুন দিছে মশা তাড়াচ্ছে। কিন্তু প্রতিবেশীদের সাথে কথা বললে তারা জানায় ব্যাটারী পোড়ার কথা এবং আমি রাতের বেলা গিয়ে দেখি সত্যি সেখানে ব্যাটারী পোড়ানো হচ্ছে। খুব গন্ধ হচ্ছিল তাই বেশিক্ষণ থাকতে না পেরে চলে আসি। এই কারখানার নেই কোনও অনুমোদন। এমনকি স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের ট্রেড লাইসেন্সও নেই।

কারখানার অনুমোদন বিষয়ে কারখানা পরিচালনার দায়িত্বরত মোঃ তৌফিকুর রহমান এ প্রতিবেদক-কে বলেন, দেশের বিভিন্ন জায়গায় হাজার হাজার কারখানায় ব্যাটারী গলিয়ে সীসা তৈরী করা হয়। আর আমরা তৈরি না করলে আপনারা মোটরসাইকেল চালাবেন কি করে।  এটি তো অবৈধ ব্যাবসা এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন দেশের অনেক যায়গায় এরকম অনেক অবৈধ ব্যাবসা আছে আমরা করলে দোষের কি বলে তিনি পাল্টা প্রশ্ন ছোঁড়েন। পরিবেশ অধিদপ্তর বা প্রশাসন থেকে কোনও অনুমোদন আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোনও দপ্তর থেকেই অনুমোদন নেই। পরিবেশ অধিদপ্তর বা প্রশাসনের অনুমোদন ছাড়া আপনারা কিভাবে এই ব্যবসা পরিচালনা করছেন। জবাবে স্থানীয়ভাবে ম্যানেজ করে এই অবৈধ ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন বলে জানান তিনি।

পরিবেশ অধিদপ্তর বগুড়া জেলা কার্যলয়ের সহকারী পরিচালক মাহথীর বিন মোহাম্মদ এ প্রতিবেদক-কে বলেন, এই সীসা সংগ্রহের কারখানার বিষয়টি আমি জানি না বা কেউ কোনও অভিযোগ করেনি। বিষয়টি এখন জানলাম কারখানাটির বিরুদ্ধে পরিবেশ আইনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।

আরও পড়ুনঃ  বন্ধ হচ্ছে সরকারি কর্মচারিদের বিদেশ সফর

শিবগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ আল মোজাহিদ সরকার এ প্রতিবেদক-কে বলেন, ব্যাটারী পুড়িয়ে সীসা সংগ্রহে এলাকার চারপাশে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। যেকোনও ফসলের ফুল ফোটার আগে বা ফুল ফোটার সময় সীসার ঝাঁঝালো আবহাওয়ার কারণে সঠিকভাবে ফুল ফোটেনা এবং ফুল ফুটলেও

সঠিকমাত্রাই ফলন হয় না। সকল ফসলের মারাত্মকভাবে উৎপাদন ব্যাহত হয় এবং মাটির উর্বতা হ্রাস পায়।

শিবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. তারক নাথ কুন্ড এ প্রতিবেদককে বলেন, ব্যাটারির সিসা মানব শরীরের জন্য অনেক ক্ষতিকর। সীসার প্রভাবে মানব শরীরে বিষক্রিয়া শুরু হয়। শ্বাসকষ্ট  তথা ফুসফুসের রোগ এমনকি ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। অন্তঃস্বত্ত্বা নারীর গর্ভের শিশুর উপর ব্যপক প্রভাব ফেলে এবং বিকলাঙ্গ শিশু বা শিশুমৃত্যুরও কারন হতে পারে।

শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উম্মে কুলসুম সম্পা বলেন, ব্যাটারী পুড়িয়ে এই সীসা সংগ্রহ কারখানার বিষয়টি আমি জানি না বা কেউ আমাকে কোনও অভিযোগ করেনি। বিষয়টি এখন জানলাম কারখানাটির বিরুদ্ধে পরিবেশ আইনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন